শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১, ২৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

জাতীয় সংবাদ

সিন্ডিকেটে অস্থির রডের বাজার

কাঁচামাল আমদানি বন্ধ হয়ে যাওয়া, ডলার সঙ্কট ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধিতে রেকর্ড দাম ১ সপ্তাহে ৫ হাজার থেকে ৭ হাজার টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে হ ঝুঁকির মুখে উন্নয়ন কাজ, দরপত্রের মূল্য

অর্থনৈতিক রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ২১ আগস্ট, ২০২২, ১২:০০ এএম

আবাসন খাতসহ অন্যান্য খাতে নির্মাণসামগ্রীর অন্যতম উপাদান হচ্ছে রড। রডের দাম গত বৃহস্পতিবার সর্বকালের সর্বোচ্চে পৌঁছেছে। এ দিন মিল গেটে প্রতি টন ৭৫ গ্রেডের এমএস (মাইল্ড স্টিল) রড বিক্রি হয়েছে ৯০ হাজার থেকে ৯৩ হাজার টাকায়। যা গত সপ্তাহের তুলনায় প্রায় ৫ হাজার টাকা বেশি। অটো অথবা সেমি-অটো মিলে উৎপাদিত ৬০ গ্রেডের এমএস রডের দামও প্রত টনে ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়ে গেছে। এর আগে ২০২০ সালের নভেম্বর থেকে প্রায় দেড় বছর টানা বেড়ে চলতি বছরের মার্চে ৭৫ গ্রেডের এমএস রডের দাম ঠেকে টনপ্রতি ৯২ হাজার টাকায়। এপ্রিল মাস থেকে কমে জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহে রডের দাম নেমেছিল টনপ্রতি ৮২-৮৪ হাজার টাকায়। অবশ্য ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত অন্যতম এই কাঁচামালের দাম ৫৫ হাজার টাকার আশপাশেই ওঠানামা করছিল। রডের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় সরকারের চলমান উন্নয়নকাজ ও বেসরকারি পর্যায়ে আবাসনশিল্প বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

দফায় দফায় নির্মাণসামগ্রীর দামসহ সরবরাহ খরচ বাড়ায় পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন অনুযায়ী দরপত্রের মূল্য সমন্বয়ে একাধিকবার দাবি জানিয়েছে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কনস্ট্রাকশন ইন্ডাস্ট্রি (বিএসিআই)। কারখানা মালিকরা জানান, ডলার সঙ্কটে পণ্য আমদানির কড়াকড়িতে প্রধান কাঁচামাল স্ক্র্যাপের আমদানি কমে যাওয়া এবং সাম্প্রতিক জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির কারণে রডের দাম আবারও রেকর্ড ছাড়িয়েছে। যদিও স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, রডের মূল্য বেড়েছে কারখানা মালিকদের কারণে। যদিও বিষয়টি মানতে নারাজ কারখানা মালিকরা।

কবির স্টিল রোলিং মিলস্সের (কেএসআরএম) ম্যানেজার বিজনেস ডেভলপমেন্ট জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ইনিকলাবকে বলেন, রড তৈরির কাঁচামাল লোহা-লক্কর ও স্টিলজাত সামগ্রীর দাম বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। তাই ইস্পাত খাত এখন দুঃসময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। ডলারের বিনিময়মূল্যের অস্বাভাবিক উত্থানে আমদানি দায় পরিশোধের সময় লোকসান দিতে হচ্ছে। ডলার-সঙ্কটে নতুন করে কাঁচামাল আমদানিতেও এখন আগের চেয়ে বেশি সময় লাগছে। তিনি বলেন, আবার গ্যাসের চাপ কম থাকায় এবং বিদ্যুৎ-সঙ্কটে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় উৎপাদন খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এসবই রডের মূল্যবৃদ্ধির কারণ বলে উল্লেখ করেন তিনি। জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, শনিবার রডের নতুন রেট দেয়া হয়নি। আগের রেট চট্রগ্রাম থেকে ঢাকায় পৌঁছে দেয়া পর্যন্ত ৯১ হাজার টাকা পড়ছে। আজ রোববার নতুন রেট নির্ধারণ করে রড বাজারে ছাড়া হবে।

ইস্পাত খাতের আরও কয়েকজন উদ্যোক্তা ও ব্যবসায়ীরা জানান, প্রায় তিন মাস নিম্নমুখী থাকার পর গত এক মাস ধরে ফের বাড়তে শুরু করে রডের বাজার। এই এক মাসের মধ্যে রডের দাম বেড়েছে ১০ হাজার টাকা। চট্টগ্রাম নগরীর কর্ণেল হাট এলাকার রড ব্যবসায়ী ও মেসার্স খাজা মেটালের স্বত্বাধিকারী হুমায়ুন কবির বলেন, মাঝখানে তিন মাস নিম্নমুখী থাকলেও মূলত গত দেড় বছরের বেশি সময় ধরে অস্থির ছিল ইস্পাতের বাজার। তিনি বলেন, ডলার সঙ্কট ও জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির প্রভাবে রডের দাম কিছুটা বাড়বে, স্বাভাবিক। কিন্তু তার চেয়ে বেশি অস্থির হয়েছে রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর সিন্ডিকেট করে কারসাজির কারণে।

সূত্র মতে, একসময় শুধু চট্টগ্রামেই ছোট-বড় অর্ধশতাধিক রড উৎপাদনকারী কারখানা ছিল। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন বন্ধ রয়েছে। এখন রডের বাজার ১০-১৫টি প্রতিষ্ঠানের আধিপত্য। এদিকে বেড়ে গেছে স্থানীয় স্ক্র্যাপ, প্লেট ও বিলেটের দামও। গত এক সপ্তাহে এসব কাঁচামালের দাম টনে ৫ হাজার থেকে ৭ হাজার টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বর্তমানে ইয়ার্ডে প্রতি টন স্ক্র্যাপ বিক্রি হচ্ছে ৬৫ হাজার টাকা দামে। অথচ ঈদুল আজহার আগেও প্রতি টন স্ক্র্যাপের দাম ছিল মাত্র ৪৫ হাজার টাকা।

স্ক্র্যাপের পাশাপাশি বেড়েছে ইস্পাতের কাঁচামাল প্লেট ও বিলেটের দামও। প্লেট ও বিলেটের দাম টনে বেড়েছে ৬-৭ হাজার টাকা। বর্তমানে বাজারে প্রতি টন প্লেট ৮০ হাজার টাকা ও বিলেট ৮১ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। এক সপ্তাহ আগে বাজারে প্রতি টন প্লেট ৭৩ হাজার টাকা ও বিলেট ৭৫ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। ঈদুল আজহার আগে প্রতি টন প্লেট ৬০ হাজার টাকা ও বিলেট ৬২ হাজার টাকায় বিক্রি হতো।

রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে স্ক্র্যাপ সরবরাহকারী শিপ ব্রেকিং খাতের উদ্যোক্তারা জানিয়েছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে চলতি বছরের মার্চ থেকে এপ্রিল পর্যন্ত স্ক্র্যাপ জাহাজের বুকিং দর বেশি থাকায় আমদানি কিছুটা কম হয়েছে। তবে মে মাসের শুরু থেকে বিশ্ববাজারে স্ক্র্যাপের দাম উল্লেখযোগ্য হারে কমে যাওয়ায় এই সময়ে বাংলাদেশে আমদানি বৃদ্ধি পাওয়ায় কথা। কিন্তু তা না হয়ে উল্টো এই সময়েও পণ্যটির আমদানি কমে গেছে।
মহরম শিপ রিসাইক্লিং ইন্ডাস্ট্রিজের স্বত্বাধিকারী কামাল পাশা বলেন, ডলার সঙ্কটের কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী পণ্য আমদানিতে কড়াকড়ি করছে বাণিজিক ব্যাংকগুলো। এতে অন্যান্য পণ্যের মতো গত তিন মাসে ইস্পাতের কাঁচামাল স্ক্র্যাপের আমদানিও উল্লেখযোগ্য হারে কমে গেছে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে স্ক্র্যাপের বড় দরপতন হলেও দেশীয় বাজারে উল্টো বেড়ে গেছে পণ্যটির দাম। সেই প্রভাবে বেড়েছে এমএস রডের দামও।

কে আর শিপ ব্রেকিং ইয়ার্ডের স্বত্বাধিকারী সেকান্দার হোসেন জানান, বিশ্ববাজারে গত তিন-চার মাস ধরে স্ক্র্যাপ ও পুরোনো জাহাজের দাম অনেক কমেছে। এখন আমদানি বাড়াতে পারলে স্ক্র্যাপ ও রড দুটোর দামই কমে আসত স্থানীয় বাজারে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ও শাহরিয়ার স্টিল মিলসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মাসুদুল আলম মাসুদ ইনকিলাবকে বলেন, রডের কাঁচামাল আমদানিতে ব্যাংকগুলোর এলসি খোলায় অনাগ্রহ এবং ডলার সঙ্কপের কারণে রডের কাঁচামাল শর্টেজ হয়ে গেছে। বিশেষ করে গত ১ মাস কোন এলসি খুলতে পারেনি আমদানিকারকরা। এখন কিছুটা এলসি খোলা শুরু হয়েছে। পাশাপাশি বিদ্যুৎ, গ্যাস ও জ্বালানীর দাম বাড়ার প্রভাবে রডের দাম বেড়েছে। দেশের সবকিছু স্বাভাবিক হলেই কেবল এ পরিস্থিতির উন্নতি ঘটতে পারে। অন্যথায় নয় বলে উল্লেখ করেন তিনি।

বিএসিআই’র সাবেক সভাপতি শেখ মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, সরকারের বিভিন্ন ভৌত অবকাঠামোসহ উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডে সহায়ক হিসেবে কাজ করি। আমরা ঠিকাদাররা কেউ কেউ দেউলিয়া হওয়ার পথে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, নির্মাণ প্রকল্পগুলোর মূল উপকরণ রড, সিমেন্ট, পাথর, লোহা, ইট প্রভৃতির বাজারদর বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাশাপাশি নতুন করে জ্বালানির দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় আমাদের পণ্য সরবরাহের খরচ আরো বেড়ে গেছে। এ অবস্থায় সরকারি নিয়ম অনুযায়ী দরপত্রে মূল্য সমন্বয় করা জরুরি।
তিনি বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমরা চলমান প্রকল্পের কাজ চালিয়ে যেতে পারছি না এবং নতুন কোনো দরপত্রে অংশগ্রহণ করার সাহসও পাচ্ছি না। তাই চলমান কাজে মূল্য সমন্বয় না করলে সব নির্মাণকাজে স্থবিরতা দেখা দেবে এবং প্রকল্প বাস্তবায়ন অসম্ভব হয়ে পড়বে।

রিয়েল এস্টেট অ্যান্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (রিহ্যাব) সভাপতি ইনকিলাবকে বলেন, আবাসন সংশ্লিষ্টরা খুবই বিপাকে আছি। হিমশিম খাচ্ছি। রড উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর নির্ভর করছে দাম বাড়া-কমা। তারাও স্বপক্ষে যুক্তি দিচ্ছে। এগুলোও কতটুকু যুক্তিসঙ্গত সেটাও দেখতে হবে। তিনি বলেন, আমাদের বিক্রি আগে, তারপর নির্মাণ করে গ্রাহককে হস্তান্তর। তৈরির ৬ মাস আগেই অধিকাংশ ফ্ল্যাট বিক্রি করা হয়েছে। সবকিছুর দাম যেভাবে বাড়ছে তাতে কিভাবে এটা সমন্বয় করবো এটা নিয়ে সবাই বিপাকে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (3)
Ak Zaman ২১ আগস্ট, ২০২২, ৬:৫০ এএম says : 0
গোষ্ঠীবাদি ক্ষমতার আগ্রাসনে এসব সিন্ডিকেট টিকে আছে, দ্রুত এদের আইনের আওতায় নিয়ে আসুন
Total Reply(0)
Zillur Rahaman Kanchon ২১ আগস্ট, ২০২২, ৬:৫০ এএম says : 0
এই দেশে সব কিছু সিন্ডিকেট এর দখলেই।ডিম,আলু,চাল,ডাল থেকে রড পর্যন্ত। কোন জিনিসটা সিন্ডিকেট এর বাইরে আছে। এত মন্ত্রণালয় থেকে লাভ কি?
Total Reply(0)
Nuruzzaman Shawn ২১ আগস্ট, ২০২২, ৬:৫১ এএম says : 0
আওয়ামীলীগ কে আবারো ভোট দেন। সামনে এরকম আরো সুফল পাবেন।
Total Reply(0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন