মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

সন্ত্রাস মোকাবেলায় মহানবী সা.-এর কার্যক্রম

| প্রকাশের সময় : ৪ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান

॥ তিন ॥
এত মর্যাদাবান ও অনুগ্রহপুষ্ট শ্রেষ্ঠত্বের অধিকারী সমগ্র মানবজাতির কোন এক সদস্যের প্রাণহাণী ঘটানোকে সমগ্র মানবজাতির প্রাণহানী ঘটনার সাথে তুলনা করে আল্লাহ বলেন: “এই কারণেই বনী ইসরাঈলের প্রতি এই বিধান দিলাম যে, নরহত্যা অথবা দুনিয়ায় ধ্বংসাত্মক কাজ করা ব্যতীত কেউ কাউকেও হত্যা করলে সে যেন দুনিয়ার সকল মানুষকেই হত্যা করল।” অন্য আয়াতে আল্লাহ ইচ্ছাকৃত কোন মু‘মিনকে হত্যা করলে তার শাস্তি জাহান্নাম; সেখানে সে স্থায়ী হবে এবং আল্লাহ তার প্রতি রুষ্ট হবেন, তাকে লা’নত (অভিশাপ) করবেন এবং তার জন্য মহাশাস্তি প্রস্তুত রাখবেন।”] সম্প্রতি সন্ত্রাসীদের উদ্দেশ্য অর্জনে আত্মঘাতী হামলার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। এই হামলার মাধ্যমে সন্ত্রাসী তার নিজে জীবনকে ধ্বংস করে ফেলে। অথচ আল-কুরআনে নিজেকে ধ্বংস করতে নিষেধ করা হয়েছে। ইসলামের দৃষ্টিতে আত্মঘাতী হামলা আত্মহত্যার শামিল, আর উভয়ই স্পষ্ট হারাম। আল্লাহ বলেন: “নিজেদের হাতে নিজেদেরকে ধ্বংসের মধ্যে নিক্ষেপ কর না। তোমরা সৎকাজ কর, আল্লাহ সৎকর্মপরায়ণ লোকেদের ভালবাসেন।” এভাবে আল-কুরআনুল কারীমে অসংখ্য আয়াতে অন্যায়ভাবে মানব হত্যা, আহত করা, আহত্যা করা, অন্যের সম্পদ লুট করা, পৃথিবীতে বিপর্যয় সৃষ্টি করা, বিশৃঙ্খলা ঘটানোসহ সন্ত্রাসের বিভিন্ন রূপ, প্রকৃতি, বৈশিষ্ট্য, পরিণাম, প্রতিরোধ, শাস্তি সম্পর্কে নির্দেশনা এসেছে। এসব আয়াতের ব্যাখ্যা হিসাবে রাসূল (সা.)-এর হাদীসে এ প্রসঙ্গে আরো বিস্তারিত নির্দেশনা পাওয়া যায়।
সন্ত্রাস প্রতিরোধে আল-কুরআনে বর্ণিত নির্দেশনার আলোকে আল-হাদীসেও ব্যাপক নির্দেশনা এসেছে। প্রাসঙ্গিক কারণে কিছু হাদীস নিম্নে পেশ করা হলো- রাসূল (সা.) বলেন: “বিবাহিতা ব্যভিচারী, হত্যার বদলে হত্যা এবং দ্বীন (ইসলাম) ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার অপরাধ ব্যতীত ‘আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং আমি আল্লাহর রাসূল’ এ সাক্ষ্য দানকারী কোন অমুসলিমের রক্ত বৈধ নয়।” সন্ত্রাস অর্থই হচ্ছে ত্রাস, ভয় আতঙ্ক সৃষ্টি করা, অন্যকে আতংকিত করা। কিন্তু আল-হাদীসের স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে যে, কোন মুসলিমকে আতংকিত করা বৈধ নয়। এ প্রসঙ্গে রাসূল (সা.) বলেন: “কোন মুসলিমের জন্য অপর মুসলিম ভাইকে আতংকিত বা সন্ত্রস্ত করা বৈধ নয়। সন্ত্রাস একটি অন্যায় কর্ম। যে কোন অন্যায় কর্ম দেখে তা প্রতিরোধ করা প্রত্যেক মুসলিমের দায়িত্ব। সাধ্যানুযায়ী প্রতিরোধ প্রচেষ্টা পরিচালিত করার নির্দেশনা প্রদান করে রাসূল (সা.) বলেন: “তোমাদের মধ্যকার যে ব্যক্তি অন্যায় করতে দেখবে, সে যেন তাঁকে তার হাত দ্বারা প্রতিহত করে। যদি সম্ভব না হয় তাহলে কথা দ্বারা প্রতিবাদ করবে, তাও সম্ভব না হলে অন্তর দ্বারা প্রতিবাদ করবে। এটিই হচ্ছে সবচেয়ে দুর্বল ঈমানের পরিচায়ক।”
সন্ত্রাস সম্পর্কে উল্লেখিত আলোচনা থেকে স্পষ্টতই প্রমাণ হয় যে, সন্ত্রাসী কর্মকা- ইসলাম সমর্থনেতো করেই না, বরং তা প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করে। যারা মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও মুসলিমের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করে কিংবা ভীতি প্রদর্শন করে তারা প্রকৃত পক্ষে মুসলিম নয়। তারা ইসলামের তথা কুরআন ও হাদীসের রীতিনীতি ও নির্দেশনাকে বিসর্জন দিয়েছে। তেমনি বর্তমানে যারা ধর্মের নামে বিভিন্ন স্থানে বোমা হামলা করে নির্বিচারে নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করছে এবং বিভিন্ন ধরনের হুমকি দিয়ে মানুষের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করছে তারা মুসলিমদের দলভুক্ত নয়। তাদেরকে ইসলামী দলের অন্তর্ভুক্ত মনে করে তাদের কোনো সহযোগিতা করা যাবে না। আল্লাহ তা’আলা বলেন: “তোমরা সৎ ও তাকওয়াভিত্তিক কাজে একে অপরকে সহযোগিতা কর, পাপ ও সীমালঙ্ঘনের কাজে একে অপরকে সহযোগিতা কর না।” বরং তাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে তাদের প্রতিরোধ করতে হবে।
মহান আল্লাহ তাঁর রাসূলকে অশান্ত ও বিশৃঙ্খল পৃথিবীতে শান্তি, শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছেন। আল্লাহ : “আমি তো তোমাকে বিশ্বজগতের প্রতি কেবল রহমতরূপেই প্রেরণা করেছি।” এজন্য তিনি সর্বদাই বিশ্বে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য সচেতন ও তৎপর ছিলেন এবং সন্ত্রাস, অন্যায়, অনাচার, অত্যাচার প্রতিরোধে সমগ্র জীবন বিভিন্ন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করেছেন। রাসূল (সা.) একদিকে ছিলেন শান্তি স্থাপনকারীদের জন্য সুসংবাদদানকারী অপরদিকে সন্ত্রাস সৃষ্টিকারীদের জন্য ছিলেন সতর্কবাণী। আল্লাহ বলেন: “হে নবী! আমি তো আপনাকে পাঠিয়েছি সাক্ষীরূপে এবং সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারীরূপে, আল্লাহর অনুমতিক্রমে তাঁর দিকে আহবানকারীরূপে এবং উজ্জল প্রদীপরূপে।” উজ্জ্বল প্রদীপরূপী রাসূল (সা.) তাঁর সমগ্র জীবনে যে আদর্শ বাস্তবায়িত করেছেন, তা অনুসরণের মাধ্যমে আজো পৃথিবীতে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা ও সন্ত্রাস প্রতিরোধ করা সম্ভব। জীবনের সকল ক্ষেত্রে আদর্শ অনুকরণীয় হিসেবে রাসূল (সা.) কেই গ্রহণ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে আল্লাহ বলেন: “তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও আখিরাতকে ভয় করে এবং আল্লাহকে অধিক স্বরণ করে, তাদের জন্য রাসূল সা.এর মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ।”
সামাজিক বন্ধনহীন পরিস্থিতি, অস্থির ও বিশৃঙ্খলাপূর্ণ পরিবেশ, বলগাহীন নেতৃত্ব, শঠতা, প্রবঞ্চনা, হত্যা, লুটতরাজ প্রভৃতি অকল্যাণকর কার্যকরণের ফলশ্রুতিতে আরবের গোত্রে গোত্রে কলহ বিবাদ, যুদ্ধ বিগ্রহ সর্বত্র স্বাভাবিক ঘটনায় পরিণত হয়েছিল। মানুষের শান্তিময় জীবন মারাত্মকভাবে লংঘিত হতে থাকলে জনসাধারণ এই অশান্ত অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য উদ্বিগ্ন হয়ে উঠে। উদ্বিগ্ন মানুষের উদ্বেগকে দূর করার জন্য রাসূল (সা.) যে কার্যক্রমসমূহ গ্রহণ করেছিলেন তার মধ্যে সর্বপ্রথম দূর করার জন্য রাসূল (সা.) যে কার্যক্রমসমূহ গ্রহণ করেছিলেন তার মধ্যে সর্বপ্রথম ছিল “হিলফুল ফুযুল” নামক চুক্তি সম্পাদন। রাসূল (সা.)-এর বয়স যখন ১৫ বছর, এই যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তনকারী হাশিম সম্প্রদায়ের নেতা আব্দুল মুত্তালিবের পুত্র জুবাইরের প্রস্তাবে মক্কার আব্দুল্লাহ ইবনে জাদ’আনের বাসভবনে বনী হাশিম, বনী যুহরা, বনী তাঈম, বনী মুত্তালিব, বনী আসাদ গোত্রের সকললে সম্মিলিতভাবে অন্যায়, অত্যাচার, সন্ত্রাস প্রতিরোধ করতে ঐকমত্যে উপনীত হয় এবং শান্তি প্রতিষ্ঠায় ও সন্ত্রাস প্রতিরোধে একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়। মুহাম্মাদ (সা.) এই চুক্তিতে অংশগ্রহণ করেন। চুক্তিটিকে ইতিহাসে ‘হিলফুল ফুযুল’ নামে অভিহিত করা হয়। এই চুক্তিতে আবদ্ধ গোত্রসমূহ যে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তার সারমর্ম হলো: আমরা দেশের অশান্তি দূর করার নিমিত্ত যথাসাধ্য চেষ্টা করব। বিদেশী লোকদের ধন-প্রাণ ও মান-সম্ভ্রম রক্ষা করার জন্য আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করব। দরিদ্র ও অসহায় লোকদের সহায়তা করতে আমরা কখনই কুণ্ঠিত হবো না। অত্যাচারী ও তার অত্যাচারকে দমাতে ও ব্যাহত করতে এবং দুর্বল দেশবাসীদেরকে অত্যাচারীর হাত থেকে রক্ষা করতে প্রাণপণ চেষ্টা করব। এই প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী হিলফুল ফুযুলের সদস্যগণ বহুদিন যাবত কাজ করতে থাকেন। এই সেবা- সংঘের প্রচেষ্টায় দেশের অত্যাচার অবিচার বহুলাংশ হ্রাস পেলো, রাস্তাঘাট নিরাপদ হয়ে উঠল। রাসূল (সা.)-এর প্রতিষ্ঠিত হিলফুল ফুযুল সংঘ ইসলামের অভ্যুদয়ের পূর্ব পর্যন্ত বলবৎ ছিল। ইসলামের আগমনের পর এই সেবা সংঘ নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ল। কারণ, সকল প্রকার অন্যায়, অমঙ্গল ও পাপের মূলোৎপাটন করার এবং সর্বাধিক ন্যায়, মঙ্গল ও পুণ্য সাধনের দায়িত্ব নিয়ে যখন ‘ইসলাম’ আত্মপ্রকাশ করল তখন আর উক্ত সেবাসংঘের কোন প্রয়োজনই রইল না।
সন্ত্রাস প্রতিরোধে তরুণ বয়সে মুহাম্মদ (সা.) যে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন তার বাস্তবায়ন তার সমগ্র জীবনে পরিলক্ষিত হয়। তিনি নবুওয়াত পাওয়ার পরেও এই প্রতিজ্ঞার কথা ভুলেননি। তিনি নবুওয়াত প্রাপ্তির পর কোন একদিন বলেন: “আজও যদি কোন উৎপীড়িত ব্যক্তি “হে ফুযুল প্রতিজ্ঞার ব্যক্তিবর্গ’ বলে ডাক দেয়, আমি অবশ্যই তার ডাকে সাড়া দেব। কারণ, ইসলাম এসেছে ন্যায়কে প্রতিষ্ঠিত করতে এবং উৎপীড়িত, অত্যাচারিতকে সাহায্য করতে। এভাবে মহানবী (সা.) মক্কানগরী থেকে অন্যায়, অত্যাচার ও সন্ত্রাস দূর করে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং পরবর্তী সময়ের জন্য সন্ত্রাস প্রতিরোধের আদর্শ রেখে গিয়েছেন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন