শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

ইসলামের দৃষ্টিতে নামাজ

আবদুল কাইয়ুম শেখ | প্রকাশের সময় : ২৭ আগস্ট, ২০২২, ১২:০০ এএম

নামাজ শব্দটি ফার্সি। বহুকাল যাবৎ এটি আরবি সালাত শব্দের সমার্থক রূপে বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত হয়ে আসছে। সালাত শব্দের আভিধানিক অর্থ হলো প্রার্থনা, ইবাদত ও নামাজ। শরিয়তের পরিভাষায় নামাজ বলা হয় নির্ধারিত কথা ও কাজ বিশিষ্ট এমন এক ইবাদতকে ইসলাম ধর্মের বিধানমতে তাকবিরে তাহরিমার মাধ্যমে যার সূচনা হয় এবং সালাম ফিরানোর মাধ্যমে যার পরিসমাপ্তি ঘটে। ইসলামের পঞ্চস্তম্ভের দ্বিতীয় স্তম্ভ নামাজ। একটি প্রাসাদের কোন স্তম্ভ যদি না থাকে, তাহলে সেটি যেমন শ্রীহীন ও অপূর্ণাঙ্গ থাকে ঠিক তেমনিভাবে যেসব মুসলমান নামাজ আদায় করে না তাদের ইসলামও শ্রীহীন এবং অপূর্ণাঙ্গ রয়ে যায়! তাই প্রতিটি মুসলমানকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে নামাজ আদায়ে যত্নবান হতে হবে।

নামাজ ফরজ হবার প্রমাণ : প্রাপ্তবয়স্ক জ্ঞানবান মুসলমানদের উপর পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা ফরজ। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ হলো ফজর, জুহর, আসর, মাগরিব ও ইশা। এই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ হবার ব্যাপারে আল্লাহ তাআলা বলেন : 'আপনার পালনকর্তার প্রশংসা, পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করুন সূর্যোদয়ের পূর্বে, সূর্যাস্তের পূর্বে এবং পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করুন রাত্রির কিছু অংশ ও দিবাভাগে।' (সুরা তহা, আয়াত : ১৩০) উল্লিখিত আয়াতে সূর্যোদয়ের পূর্বে বলে ফজরের নামাজের কথা বলা হয়েছে। সূর্যাস্তের পূর্বে বলে আসরের নামাজের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। রাতের কিছু অংশের কথা বলে মাগরিব ও ইশার নামাজের কথা বলা হয়েছে। দিবাভাগের কথা বলে জুহর নামাজের উল্লেখ করা হয়েছে। হাদিস শরিফেও পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ হওয়ার বিষয়টি স্পষ্টভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। 'হযরত আনাস ইবনু মালিক রা. বলেন, মেরাজের রাতে নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উপর পঞ্চাশ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করা হয়েছিল। অতঃপর কমাতে কমাতে পাঁচ ওয়াক্তে সীমাবদ্ধ করা হয়। এরপর ঘোষণা করা হলো, হে মুহাম্মাদ! আমার নিকট কথার কোন পরিবর্তন নাই। তোমার জন্য এই পাঁচ ওয়াক্তের মধ্যে পঞ্চাশ ওয়াক্তের পুণ্য রয়েছে।' (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ২১৩)।
নামাজ আদায়ের গুরুত্ব : ইসলাম ধর্মে নামাজ আদায় করার গুরুত্ব অপরিসীম। কুরআন শরিফের বহু আয়াতে মহান আল্লাহ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নামাজ আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। নামাজ কায়েম করার আদেশ দিয়ে মহান আল্লাহ বলেন : 'আর নামাজ কায়েম কর, জাকাত দান কর এবং নামাজে অবনত হও তাদের সঙ্গে, যারা অবনত হয়।' (সুরা বাকারা, আয়াত : ৪৩)। আল্লাহ তাআলা আরও বলেছেন : 'সমস্ত নামাজের প্রতি যত্নবান হও, বিশেষ করে মধ্যবর্তী নামাজের ব্যাপারে। আর আল্লাহর সামনে একান্ত আদবের সঙ্গে দাঁড়াও।' (সুরা বাকারা, আয়াত : ২৩৮)। অনুরূপভাবে বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অসংখ্য হাদিসেও নামাজ আদায়ের প্রতি গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। 'হযরত মালেক ইবনে হুয়াইরিস রা. বলেন, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের বলেছেন : তোমরা এমনভাবে নামাজ আদায় করো যেমন আমাকে নামাজ আদায় করতে দেখতে পাও।' (সুনানে কুবরা বায়হাকি, হাদিস : ৩৮৫৬)।
নামাজের ফজিলত : নামাজ এক মর্যাদাপূর্ণ ও ফজিলতময় আমল। নিয়মতান্ত্রিকভাবে নামাজ আদায় করার মাধ্যমে অশ্লীল কর্মকাণ্ড ও গর্হিত কার্যাবলি হতে নিবৃত্ত থাকা যায়! এ প্রসঙ্গে মহাগ্রন্থ আল কুরআনে এসেছে, 'নিশ্চয়ই নামাজ অশ্লীল ও গর্হিত কার্য থেকে বিরত রাখে।' (সুরা আনকাবুত, আয়াত : ৪৫)। নিয়মতান্ত্রিকভাবে নামাজ আদায় করার দরুন পাপমোচন হয় ও সম্মান বৃদ্ধি পায়। 'হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি বাড়ি থেকে পাক-পবিত্র হয়ে কোন ফরজ নামাজ আদায় করার জন্য হেঁটে আল্লাহর ঘর মাসজিদে যায় তার প্রতিটি পদক্ষেপের বিনিময়ে একটি পাপ ঝরে যায় এবং অপরটির বদৌলতে একটি মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।' (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৪০৭)। অন্য একটি হাদিসে এসেছে, 'হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, আমি আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, 'বলতো যদি তোমাদের কারো বাড়ির সামনে একটি নদী থাকে, আর সে তাতে প্রত্যহ পাঁচবার গোসল করে, তাহলে কি তার দেহে কোন ময়লা থাকবে? তারা বললেন, তার দেহে কোনরূপ ময়লা বাকি থাকবে না। আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এ হলো পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের উদহারণ। এর মাধ্যমে আল্লাহ নিজের বান্দার গুনাহসমূহ মোচন করে দেন।' (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৫২৮)।
নামাজের নির্দেশ দান : নিজে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে নামাজ আদায় করতে হবে। সঙ্গে সঙ্গে আত্মীয়-স্বজন এবং পরিবার পরিজনকেও নামাজ আদায় করার নির্দেশ দিতে হবে। বিশ্বপ্রতিপালক আল্লাহ মহানবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সম্বোধন করে বলেন : 'আপনি আপনার পরিবারের লোকদেরকে নামাজের আদেশ দিন এবং নিজেও এর ওপর অবিচল থাকুন।' (সুরা তহা, আয়াত : ১৩২)। বিশ্বনবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও সন্তান সন্ততি এবং পরিবার পরিজনকে নামাজ আদায় করার নির্দেশ দেয়ার জোর তাগিদ প্রদান করেছেন। ‘হযরত আমর ইবনু শু‘আইব রহ. পর্যায়ক্রমে তার পিতা ও তার দাদার সূত্রে বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, তোমাদের সন্তানদের বয়স সাত বছর হলে তাদেরকে নামাজের জন্য নির্দেশ দাও। যখন তাদের বয়স দশ বছর হয়ে যাবে তখন নামাজ আদায় না করলে তাদেরকে প্রহার করবে এবং তাদের ঘুমের বিছানা আলাদা করে দেবে।' (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস : ৪৯৫)।
নামাজের সময় : মুসলমানদের উপর যে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করা হয়েছে সেগুলোর জন্য সময় নির্দিষ্ট রয়েছে। শরিয়ত কর্তৃক নির্ধারিত সময়েই নামাজ আদায় করা বাঞ্ছনীয়। কুরআন শরিফে এসেছে : 'নিশ্চয় নামাজ মুসলমানদের উপর ফরজ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে।' (সুরা নিসা, আয়াত : ১০৩)।
হাদিস শরিফেও নামাজের সময় নির্দেশ করা হয়েছে : ‘হযরত আবদুল্লাহ ইবনু আমর রা. বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, জুহরের নামাজের ওয়াক্ত শুরু হয় যখন সূর্য মাথার উপর থেকে পশ্চিম দিকে হেলে পড়ে এবং মানুষের ছায়া তাঁর দৈর্ঘ্যের সমান হয়। আর আসরের নামাজের সময় না হওয়া পর্যন্ত তা থাকে। আসরের নামাজের সময় থাকে সূর্য বিবর্ণ হয়ে সোনালি বা তাম্রবর্ণ ধারণ না করা পর্যন্ত। মাগরিবের নামাজের সময় থাকে সূর্যাস্তের পর সন্ধ্যা গোধূলি বা পশ্চিম দিগন্তে উদ্ভাসিত লালিমা অন্তর্হিত না হওয়া পর্যন্ত। ইশার নামাজের সময় থাকে মধ্যরাত পর্যন্ত। আর ফজরের নামাজের সময় ফজর বা ঊষার উদয় থেকে শুরু করে সূর্যোদয় পর্যন্ত।' (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১২৭৫) উল্লেখ্য যে, হানাফি মাজহাব মতে প্রতিটি বস্তুর মূল ছায়া ব্যতীত তার ছায়া দ্বিগুণ হওয়া পর্যন্ত জুহরের নামাজের সময় বাকি থাকে।
সর্বপ্রথম হিসাব নামাজের : নামাজ আদায় করা ও না করার উপর মুসলমানদের পারলৌকিক সফলতা ও ব্যর্থতা বহুলাংশে নির্ভর করে। যারা নিয়মতান্ত্রিকভাবে নামাজ আদায় করবে তারা সফল হবে ও মুক্তি পাবে! পক্ষান্তরে যারা নামাজ আদায় না করবে তারা ব্যর্থ হবে! কেননা কেয়ামতের দিন সর্বপ্রথম হিসাব হবে নামাজের। যারা প্রথম হিসাবে আটকে যাবে তাদের সফলতা ও মুক্তির পথ কণ্টকাকীর্ণ হয়ে যাবে! 'হযরত আবু হুরায়রা রা. বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, কেয়ামতের দিন বান্দার কাজসমূহের মধ্যে সর্বপ্রথম নামাজের হিসাব নেওয়া হবে। যদি ঠিকমত নামাজ আদায় করা হয়ে থাকে তবে সে নাজাত পাবে ও সফলকাম হবে। যদি নামাজ নষ্ট হয়ে থাকে তবে সে ব্যর্থ ও বিপর্যস্ত হবে। যদি ফরজ নামাজের মধ্যে কিছু কমতি হয়ে থাকে তবে মহান আল্লাহ বলবেন, দেখ, বান্দার কোন নফল নামাজ আছে কি না। থাকলে তা দিয়ে ফরজের ঘাটতি পূরণ করা হবে।' (সুনানে তিরমিজি, হাদিস : ৪১৩)
নামাজ বর্জন করার পরিণাম : নামাজ বর্জন করার পরিণাম অত্যন্ত ভয়ঙ্কর ও বিভীষিকাময়! যারা বিনা ওজরে নামাজ বর্জন করবে তাদের জন্য রয়েছে নিদারুণ নরকযন্ত্রণা! জান্নাতের অধিবাসী লোকেরা জাহান্নামিদের জিজ্ঞাসা করবে 'তোমাদেরকে কিসে জাহান্নামে আবদ্ধ করেছে? তারা বলবে, আমরা নামাজ পড়তাম না!' (সুরা মুদ্দাস্সির, আয়াত : ৪২-৪৩)। তাই নামাজ আদায়ে যত্নবান হতে হবে এবং আল্লাহ তাআলাকে সন্তুষ্ট করার মানসে নামাজ পালনে ব্রতী হতে হবে। মহান আল্লাহ বলেন : 'দুর্ভোগ সেসব নামাজির, যারা তাদের নামাজ সম্বন্ধে বে-খবর; যারা তা লোক-দেখানোর জন্য করে।' (সুরা মাউন, আয়াত : ৪-৬)।
যেসব লোক নামাজ আদায় করে না তাদের হাশর-নাশর বড় বড় কাফের বেঈমানের সঙ্গে হওয়ার প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। 'হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. বলেন, আল্লাহর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদিন নামাজের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, যে ব্যক্তি নামাজ আদায়ে যত্নবান থাকে; কেয়ামতের দিন এই নামাজ তার জন্য নুর এবং হিসাবের সময় দলিল ও নাজাতের কারণ হবে। পক্ষান্তরে যে ব্যক্তি নামাজ আদায়ে যত্নবান হবে না- কেয়ামতের দিন নামাজ তার জন্য নুর, দলিল ও নাজাতের কারণ হবে না। বরং ফেরাউন, হামান ও উবাই ইবনে খালফের সঙ্গে তার হাশর হবে!’ (সহিহ ইবনু হিব্বান, হাদিস : ১৪৬৭)। তাই আসুন! নামাজের গুরুত্ব অনুধাবন করে নিয়মিতভাবে নামাজ আদায় করায় সচেষ্ট হই। মহান আল্লাহ আমাদের সকলকে সময়মত নামাজ আদায় করার তৌফিক দান করুন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন