বুড়িগঙ্গা নদীর সদরঘাটে যাত্রী কোলাহল কমে গেছে। পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া, বাংলাবাজার-শিমুলিয়া নৌরুট নেই কোলাহল। নেই গাড়ির অপেক্ষায় ফেরি; ট্রাক টার্মিনাল ফাঁকা, হোটেল রেস্তোরাগুলো সুনসান, হকার ব্যবসায়ীরা বিপাকে, ঘাট থেকে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে রাজস্ব আয় কমেছে ৫০ ভাগ। ঘাট এলাকায় নেই যানজট এবং বাড়তি চাপে নেই ট্রাফিক পুলিশ। পদ্মা সেতু উদ্বোধন হওয়ার কারণে নতুন করে ফেরির রুট নিয়ে ভাবতে শুরু করেছে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহণ করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি)। দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানী ঢাকার ব্যস্ততম নৌরুট পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের আগে ২১টি জেলার মানুষের যাতায়াতের অন্যতম ভরসা ছিলো নৌপথ। সেতু উদ্বোধনের পর এ নৌপথে গাড়ি এবং দূরপাল্লার পরিবহনের চাপ একেবারেই কমে গেছে। মাদারীপুর শিবচরের বাংলাবাজার-শিমুলিয়া নৌরুট। কয়েক দিন ধরে যানবাহনের তেমন চাপ নেই বাংলাবাজার ঘাটে। ঈদের চাপ শেষে কয়েক দিন ধরে যাত্রী পারাপার কমে গেছে এ নৌপথে। পারাপারের অপেক্ষায় থাকতে হচ্ছে না ঢাকাগামী কোনো যানবাহনেরও। ধারণ ক্ষমতার কম যানবাহন নিয়ে ফেরিগুলো শিমুলিয়ার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাচ্ছে। এ কারণে পুরাতন কয়েকটিসহ মোট ১৪টি নতুন রুটের সিদ্ধান্ত হয়েছে বিআইডব্লিউটিসি।
এদিকে উত্তরাঞ্চলের রৌমারী-চিলমারী, বারাশিঘাট গাইবান্ধা ও বাহাদুরাবাদ জামালপুর, রাঙ্গাবালীর আগুনমুখা নদীতে পানপট্টি-কুড়ালিয়া, সন্দ্বীপ-হাতিয়া-মনপুরা-তজুমদ্দিন, নোয়াখালী-মনপুরা-হাতিয়া-তজুমদ্দিন, মনপুরা-ভোলা, পায়রা নদীর ওপর বগিবাজার-চালিতাতলি বরগুনা সদর, ভোলার লালমোহন থেকে নাজিরপুর-কালাইয়া, চট্টগ্রাম-সন্দ্বীপ, চাঁদপুর-শরীয়তপুর পুরাতন ঘাটে ফেরির সংখ্যা দ্বিগুণ করা হবে। রাজবাড়ীর পুরানো রুট ধাওয়াপাড়া-নাজিরগঞ্জ আরও ফেরি দেওয়া হবে। আরও বেশ কিছু প্রস্তাব পাওয়া গেছে বলে জানা গেছে। তবে এসব পয়েন্টে রাস্তার উন্নয়ন কাজের জন্য ফেরি চলাচল অপেক্ষা করছে সংস্থাটি।
চলতি বছরের জুন মাসে পাটুরিয়া ঘাট দিয়ে ৬ হাজার ৬৭৩টি ট্রিপে এক লাখ সাত হাজার চারটি যানবাহন নৌরুট পারাপার করেছে। এর মধ্যে ১৭ হাজার ৬০৩টি পরিবহন বাস, ৩৮ হাজার ৯০০ ট্রাক, ৪৬ হাজার ৩৩৪টি ছোট গাড়ি ও ৪ হাজার ১৬৭টি মোটরসাইকেল ছিল। এসব যানবাহন পারাপার থেকে রাজস্ব আয় হয়েছে ১১ কোটি ৮৮ লাখ ৪৬ হাজার ৫ টাকা। চলতি বছরের জুলাই মাসে ঈদে ঘরমুখো মানুষের ভিড় থাকায় পাটুরিয়া ঘাট দিয়ে ৫ হাজার ৩৫২টি ট্রিপে ৯১ হাজার ৭১০টি যানবাহন পারাপার হয়েছে। এর মধ্যে ১৭ হাজার ৭১৩টি বাস, ২২ হাজার ২২টি ট্রাক, ৩৬ হাজার ৪৭২টি ছোট গাড়ি ও ১৫ হাজার ৫০৩টি মোটরসাইকেল। এসব যানবাহন থেকে রাজস্ব আয় হয়েছিল ১০ কোটি ১৫ লাখ ৭৭ হাজার ৭০ টাকা। ঈদ মৌসুম হওয়া সত্ত্বেও তা ছিল স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে কম। তবে আগষ্ট মাসে রাজস্ব আয়ের পরিমাণ স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ৫০ ভাগ কমে গেছে বলে জানিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
বিআইডব্লিউটিসির চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত সচিব) আহমদ শামীম আল রাজী ইনকিলাবকে বলেন, পদ্মা সেতু উদ্বোধন হওয়ার কারণে নতুন করে ফেরির রুট নিয়ে কাজ শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে পুরাতন কয়েকটিসহ মোট ১৪টি নতুন রুটের সিদ্ধান্ত হয়েছে। রুটগুলো চালু হলে বেশ কয়েকটি জেলায় বসবাসকারীদের ঢাকায় আসা-যাওয়া করতে সময় কমে আসবে কয়েক ঘণ্টা। আয় বৃদ্ধিতে এসব রুট সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। সেখানে এখনো আমাদের স্থাপনা আছে। জনবল ও ফেরি আছে। কিন্তু রুটটি আপাতত বন্ধ আছে। এই রুটটি বন্ধ হয়ে যাবে আগে থেকেই আমরা জানতাম। তাই নদীর সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রত্যেক জেলা প্রশাসক, ইউএনও এবং সংসদ সদস্যদের চিঠি দেওয়া হয়েছিল। তারা চিঠির উত্তরে বেশ কিছু প্রস্তাব পাঠিয়েছেন। তাদের প্রস্তাবের ওপর ভিত্তি করে জরিপ পরিচালনা করে আমরা নতুন-পুরানো মিলিয়ে ১৪টি ঘাট পেয়েছি। এসব রুটে অত্যাধুনিক ফেরি চলাচল করবে। রুটগুলো চালু হলে বেশ কয়েকটি জেলায় বসবাসকারীদের ঢাকায় আসা-যাওয়া করতে সময় কমে আসবে কয়েক ঘণ্টা। আয় বৃদ্ধিতে ভবিষ্যত কর্মপরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে।
আহমদ শামীম আল রাজী বলেন, উত্তরাঞ্চলের রৌমারী-চিলমারী, বারাশিঘাট গাইবান্ধা ও বাহাদুরাবাদ জামালপুর, রাঙ্গাবালীর আগুনমুখা নদীতে পানপট্টি-কুড়ালিয়া,সন্দ্বীপ-হাতিয়া-মনপুরা-তজুমদ্দিন,নোয়াখালী-মনপুরা-হাতিয়া তজুমদ্দিন, মনপুরা-ভোলা, পায়রা নদীর ওপর বগিবাজার-চালিতাতলি বরগুনা সদর, ভোলার লালমোহন থেকে নাজিরপুর-কালাইয়া, চট্টগ্রাম-সন্দ্বীপ, চাঁদপুর-শরীয়তপুর পুরাতন ঘাটে ফেরির সংখ্যা দ্বিগুণ করা হবে। আমাদের মোট ৩০টি ফেরি প্রয়োজন- এসব নতুন পুরানো রুট চালু রাখতে। যার মধ্যে ১২টি নতুন ফেরি এ বছরেই পেয়ে যাব আশা করছি। মাওয়া-কাঁঠালবাড়ী থেকে পাব ৯টা। পাটুরিয়া-দৌলতদিয়ায় যানবাহন কমে গেছে।
জানাগেছে, ঈদ, পূজা, উৎসব ও ছুটির দিনগুলোতে প্রাইভেটকার, হায়েস বা ছোট গাড়ি দিয়ে পাটুরিয়া পার হতে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেননি এমন লোক খুবই কম আছে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পাটুরিয়া ঘাটের ৫ নম্বর ঘাট এলাকা ছোট গাড়িগুলো পারাপারে ব্যবহার করা হয়। বিগত বছরগুলোতে এ ঘাট এলাকা থেকে নালী বাজার হয়ে ৫/৬ কিলোমিটার এলাকায় সহস্রাধিক ছোট গাড়ি সিরিয়ালে পার হয়েছে। তবে পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর গত ঈদ উৎসবে এ ঘাট এলাকায় দেখা যায়নি ভোগান্তির চিরচেনা রূপ। সেতু উদ্বোধনের পর ৫ নম্বর ঘাট এলাকায় ছোট গাড়ির চাপ না থাকায় সরাসরি পার হওয়া যাচ্ছে। এক সময়ে পাটুরিয়া ফেরিঘাটের অন্যতম চেনা রূপ ছিল যানজট। ঘণ্টার পর ঘণ্টা এ ঘাটে বসে থাকা ছিল নিত্যদিনের ব্যপার। ফলে যানজট সামাল দিতে বেগ পেতে হতো ট্রাফিক পুলিশকে। ঘাটের আরসিএল মোড়, জিরো পয়েন্ট, ট্রাক টার্মিনাল এলাকায় পর্যাপ্ত ট্রাফিক পুলিশ থাকার পরও বাড়তি যানবাহনের চাপে তাদের নাজেহাল অবস্থা হয়ে যেতো। বর্তমানে যানবাহনের চাপ না থাকায় শান্তিতে নিজেদের পেশাগত দায়িত্ব পালন করে চলেছেন ট্রাফিক পুলিশের সদস্যরা।
লোকাল বা বিভিন্ন উৎসবের সময় ঘরমুখো কাটা বাসের (ভেঙে ভেঙে যাওয়া) যাত্রীদের বেশিরভাগ পাটুরিয়া দৌলতদিয়া নৌরুটের লঞ্চ পারাপারে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন। এ নৌরুটে ২১/২২টি লঞ্চ সব সময় চলমান থাকতো। এখন লোকাল বা কাটা বাসের যাত্রী কমে আগের সেই কোলাহল এখন আর নেই।
পাটুরিয়া দৌলতদিয়া নৌরুটে স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিন ৩ থেকে সাড়ে ৩ হাজার গাড়ি পারাপার হয়। উৎসব বা ছুটির দিনে গাড়ি পারাপারের হার আরো বাড়ে। পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর এই নৌরুটে ট্রাক পারাপার কিছুটা কমলেও দূরপাল্লার পরিবহন বাস ও ছোট গাড়ি পারাপার একেবারেই কমে গেছে।
পাটুরিয়া দৌলতদিয়া নৌরুটে স্বাভাবিক সময়ে ১৬/১৭টি ফেরি চলাচল করে। ছুটির দিন বা উৎসবে এ নৌরুটে ২০/২১ টি ফেরি চলাচল করে। তারপরও এ নৌরুটে যাত্রী ও যানবাহনের চাপ সামাল দিতে ঘাট কর্তৃপক্ষকে বেগ পেতে হয়েছে। পর্যাপ্ত ফেরি থাকার পরও যানবাহনগুলো অর্ধবেলা থেকে পুরো দিন ফেরি পেতে অপেক্ষা করতো। তবে এখন ঘাটের চিত্র পুরোই উল্টো। গাড়িকে ফেরির জন্য অপেক্ষা করতে হয় না বরং ফেরিগুলো গাড়ির জন্য অপেক্ষা করে।
পাটুরিয়া ঘাট পার হতে সবচেয়ে বেশি ভোগান্তিতে পড়তো ট্রাক চালকরা। এ নৌরুটে যানবাহনের চাপ বেড়ে গেলে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস ও ছোট গাড়ি পারাপার করা হয়। ফলে ট্রাক চালকদের কখনও কখনও এ নৌরুট পার হতে দুই থেকে তিন দিন পর্যন্ত সময় লেগেছে। পাটুরিয়া দুটি ট্রাক টার্মিনাল, টার্মিনাল থেকে আরসিএল মোড় হয়ে ফায়ার সার্ভিস পর্যন্ত সড়কে শত শত ট্রাক পারের অপেক্ষায় থাকতো। এখন দূরপাল্লার পরিবহন বাস ও ছোট গাড়ির চাপ না থাকায় ট্রাক চালকদের ভোগান্তি কমেছে। ট্রাক টার্মিনাল বেশিরভাগ সময় ফাঁকা হয়ে পড়ে থাকে।
গত দুই দশকে পাটুরিয়া ঘাট এলাকার গড়ে ওঠে কয়েক শো খাবারের দোকান, রেস্তোরাঁ। এসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে কাজ করে সংসার চালান অনেক শ্রমিক। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর থেকে এসব দোকান ও খাবারের হোটেলের বেচাকেনা কমে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা লোকসানে পড়েছেন। লোকসান এড়াতে এসব দোকান ও খাবার হোটেল মালিকরা জনবল শ্রমিক কমিয়েছে। ফলে কাজ হারিয়ে বিপাকে পড়েছেন শ্রমিকরা। ঘাট এলাকায় গাড়ি কমে যাওয়ায় এসব দোকান হোটেলে মানুষের আনাগোনা কমেছে।
পাটুরিয়া ঘাট এলাকায় গাড়ি ও ফেরিতে বই, চকলেট, শনপাপড়ি, আমড়া, পেয়ারা, ডিমসহ একাধিক পণ্য নিয়ে কয়েকশো হকার হকারি করতেন। যানবাহনের চাপ কমে যাওয়ায় এদের বিক্রি তলানিতে ঠেকেছে। অনেকেই পেশা বদলে অন্য পেশায় চলে যেতে শুরু করেছেন।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীন নৌপরিবহন করপোরেশন (বিআইডব্লিউটিসি) আরিচা কার্যালয়ের মহাব্যবস্থাপক (ডিজিএম) শাহ মো.খালেদ নেওয়াজ ইনকিলাবকে বলেন, পাটুরিয়া দৌলতদিয়া নৌরুটে ২০টি ফেরি রয়েছে। তবে যাত্রী ও যানবাহন না থাকায় ১০টি ফেরি চলাচল করছে। পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর এ নৌরুটে সব ধরনের যানবাহন পারাপারের হার কমেছে। চলতি মাসে রাজস্ব স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে ৫০ ভাগ কমে গেছে। এ নৌরুটের কয়েকটি ফেরি বিভিন্ন নৌরুটে সংযুক্ত করার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন