দিল্লীর সম্রাট আলাউদ্দীন খিলজির আদেশানুযায়ী কাজ করা হল। ঝড়ের শেষে দেখা গেল একজন সেনাপতির তাবুতেই প্রদীপ জ্বলছে। তাঁর নাম সৈয়দ নাসির উদ্দীন রহ.। কর্তব্য পরায়নতা ও সাধুতার জন্য তিনি ইতিপুর্বে সকলের নিকট মশহুর ছিলেন। সেনাবাহীনির ছাউনিতে সৈন্যগন এশার নামাজ আদায় করে শুয়ে পড়ত। শেষ রাতে তাহাজ্জোদ নামাজের ওযু করার সময় খালী সুহরাইয়া গুলি পানিতে ভরা থাকত (লম্বা মুখ ওয়ালা মাটির কলস কে সুহরাইয়া বলা হয়)। কে এ কাজ গোপনে করে যেত তা কেউ জানত না। লোকজনের কাছে শুনে ইতিপুর্বে বাদশাহ একদিন নিজে রাতভর পাহাড়া দিয়ে দেখলেন কোন্ ব্যক্তি এই কাজ করেন। তার সাধু হৃদয়ের পরিচয় পেয়ে সবাই মুগ্ধ হয়ে গেলেন। অধীনস্ত সৈন্যগণ এমনিতেই তাঁকে আগে থেকেই পীরের মত শ্রদ্ধা করতেন। সম্রাট সৈয়দ নাসির উদ্দীন রহ. কে রাজদরবারে আহব্বান করলেন এবং অনেক সম্মান প্রদর্শন করে তাকে প্রধান সিপাহসালার পদে নিযুক্ত করেন। সিপাহসালার এমন একটি পদ যা সালতানাতের সকল সেনা সদস্যদের ও সেনাপতিদের উপর আধিপত্য করে। ইতিপুর্বে প্রেরিত বাদশার ভাগিনা সিকান্দার গাজীকে সৈন্যসামন্ত সহ সিপাহসালার সৈয়দ নাসিরুদ্দীনের বাহিনীর অধিনস্ত করে বিরাট সৈন্যবাহিনী দিয়ে সুসজ্জিত করে দিল্লীর বাদশাহ রাজদন্ড হাতে দিয়ে সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীন রহ.কে সিলেট অভিমুখে প্রেরন করেন।
অলিত্বের বিভিন্ন পরীক্ষায় উত্তীর্ন হয়েই সম্রাটের আদেশানুযায়ী রাজদন্ড হাতে নিয়ে সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীন রহ.সিলেট বিজয়ের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। অন্যদিকে দিল্লীর সম্রাট আলাউদ্দীন খিলজীও একজন আওলাদে রাসুলের হাতে সিলেট বিজয়ের দাযয়িত্ব অর্পন করে খুবই আশান্বিত হয়ে সস্থি অনুভব করে,সিলেট বিজয়ের নতুন সিপাহসালারকে বিদায় জানান। অন্যদিকে বাংলা মুল্লুকে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে সুদুর ইয়ামেন থেকে হযরত শাহজালাল রহ. এলাহাবাদে এসে পৌছান। পথিমধ্যে এলাহাবাদে সৈয়দ নাসির উদ্দীন রহ.ও শাহজালাল রহ.এর সাথে পরস্পরের সাক্ষাৎ হয়। একজন রাজদন্ড হাতে অন্যজন ইলহামী আদেশে এত সোনায় সোহাগা। দুজনই একই উদ্দেশ্যের কথা ও মনোভাব জানতে পারলেন। কর্তব্য সাধনে কাল বিলম্ব না করে উভয়ে সিলেট অভিমুখে রওয়ানা হলেন। উল্লেখ্যযে হযরত শাহজালাল রহ.এর সাথে ৩৬০জন সাথি ছিলেন, এরা সকলেই কামেল অলি উল্লাহ ছিলেন। সিলেটে ইসলামের প্রচার প্রসারে তাদের অবদান সে এক গৌরবোজ্জল ভিন্ন ইতিহাস।
এদিকে অধিকতর সাহায্যের আশায় সিলেট বিজয়ের জন্য দিল্লীর বাদশাহ কর্তৃক ইতিপুর্বে প্রেরিত বাদশাহর ভাগিনা সিকান্দর শাহ যখন খুবই উৎকন্ঠিত তখনই সংবাদ পেলেন বিরাট সৈন্য বাহিনী সহ সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীন রহ. সিলেট বিজয়ের সেনাপ্রধান হিসাবে নিয়োগ প্রাপ্ত হয়ে আগমন করেছেন। তাদের আগমনে যেন সিকান্দর শাহ গাজীর নব আশার সঞ্চার হল। এবার তারা সিলেটের দিকে রওয়ানা হলেন।
সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীন রহ. সিলেট প্রবেশের পূর্বে ইহা ছিল পৌত্তলিক ও বিধর্মীদের চারণ ক্ষেত্র। রাজা গৌড় গোবিন্দের ঈর্ষা ও প্রবল প্রতাপে মুসলমানদের সেখানে বসবাস করাই অসম্ভব হয়ে উঠেছিল। তারা নিজেদের ধর্মকর্মও নির্বিগ্নে সমাধা করতে পারত না। মুসলমানদের বিভিন্ন ভাবে নাজেহাল করত পৌত্তলিক রাজা গৌড় গোবিন্দ। প্রকাশ্যে নামাজ রোজাও কেউ আদায় করতে পারত না। গুপ্তচরের মাধ্যমে গৌড় গোবিন্দ বিরাট মুসলীম বাহীনির আগমন সংবাদ শোনে ভীত সন্ত্রস্থ হয়ে পড়ল। আত্মরক্ষার জন্য সে নানা রূপ কুট চক্রান্তের আশ্রয় নিল। মুসলীম বাহীনি যেন নদী পার হতে না পারে সেজন্য সে নদীতে নৌকা চলাচল বন্ধ করে দিল। সিকান্দর শাহ গাজী নদী পারাপারের কোন ব্যবস্থা না দেখে চিন্তিত হয়ে পড়েন। কথিত আছে হযরত শাহ জালাল রহ. নদীর উপর জায়নামাজ বিছিয়ে সিপাহসালার নাসির উদ্দীন রহ. এর সেনা বাহিনী ও উনার অনুচরবর্গ সহ অনায়াসেই নদী পার হয়ে যান।
কাপুরুষ গৌড় গোবিন্দ আগে থেকেই প্রস্তুত ছিল। সে বুঝতে পেরেছিল নদী পথে আটকিয়ে মুসলীম বাহীনির গতিরোধ করা সম্ভব নয়। তাই পূর্বের মতই সৈন্য দল গুপ্ত স্থানে লুকিয়ে রেখে হঠাৎ করে আক্রমন করার হুকুম দিয়ে রেখেছিল। এরই মধ্যে সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীন রহ. তার সেনা বাহীনি সহ সিলেটের অনতিদূরে এসে উপস্থিত হন। পূর্ব প্রস্তুতি অনুযায়ী গৌড় গোবিন্দের সৈন্যগণ সহসা গুপ্ত স্থান হতে অতর্কিতে মুসলীম সেনাবাহীনিকে আক্রমন করল। আষাঢ়ে বৃষ্টির মত চারদিক থেকে বিষাক্ত তীর নিক্ষেপ করতে লাগল। সহসাই এক আশ্চর্য্য ঘটনা পরিলক্ষিত হল, যারা তীর নিক্ষেপ করছিল উল্টো সেই তীর তাদেরই গায়ে লাগতে আরম্ভ করল। তা দেখে ধুর্ত গৌড় গোবিন্দের সৈন্যগন রণভঙ্গ দিয়ে পালাতে লাগল। গৌড় গোবিন্দ অনেক চেষ্টা করেও পলায়নরত সৈন্যদের একত্র করতে পারল না, এদিকে মুসলীম বাহীনি বিজয় উল্লাসে মাতুয়ারা হয়ে তুমূল বিক্রমে আক্রমন করে পলায়ন রত শত্রু সৈন্যদের মুহূর্তেই নিঃশেষ করে ফেলল। কাপুরুষ গৌড় গোবিন্দ অবস্থা বিবেচনায় কোন রূপে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে গেল।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন