দীর্ঘ ২৫ বছর পর সোনারগাঁ থানা আওয়ামী লীগের সম্মেলনে একই মঞ্চে নারায়ণগঞ্জের আলোচিত দুই রাজনীতিবিদ নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য ও প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমান এবং নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াত আইভী উপস্থিত হয়েছেন। একই দলের রাজনীতি করলেও দুজনের মধ্যকার বিরোধের কারণে তারা একই সভা-সমাবেশে আসতেন না। তবে এবার দলের স্বার্থে এক মঞ্চে উপস্থিত হয়েছেন তারা।
শনিবার (৩ সেপ্টেম্বর) দুপুরে সোনারগাঁ উপজেলার সম্মেলন কক্ষে আয়োজিত এক সম্মেলনে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে উপস্থিত হন এই দুই নেতা। থানা আওয়ামী লীগের ওই সম্মেলনে তারা দুজনই বক্তব্য রেখেছেন। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী বলেন, ইতিহাস-ঐতিহ্যে নারায়ণগঞ্জের কমতি নেই। তারপরও সোনারগাঁ আওয়ামী লীগ বরাবরই অবহেলিত, অত্যাচারিত ও নিপীড়িত হয়েছে। এই নারায়ণগঞ্জ থেকে জোহা-চুনকার মিছিল না গেলে ঢাকায় মিছিল জমত না, আদমজীর মিছিল না গেলে ঢাকার মিছিল জমে উঠত না।
কেন্দ্রীয় নেতাদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, দল টিকে আছে তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের জন্যই, সবার যথাযথ মূল্যায়ন হওয়া উচিত। আপনি যত বড় নেতাই হোন না কেন তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের অসম্মান করার অধিকার আপনার নাই। এই সোনারগাঁতে আলী আহাম্মদ চুনকার নেতৃত্বে সাদেক আলী মোক্তার ও মোবারক ভাইয়েরা দেশকে ভালবেসে রাজনীতি করেছিলেন। যারা দলের দুঃসময়ে ছিল তাদের যেন কমিটিতে স্থান দেওয়া হয়।
সোনারগাঁ আসনে নৌকার প্রার্থী চেয়ে মেয়র আইভী বলেন, সোনারগাঁয়ে আওয়ামী লীগে কী এতই ঘাটতি পড়েছে যে, বারবার এখানে সংসদীয় আসন জাতীয় পার্টির হাতে তুলে দিতে হবে? নারায়ণগঞ্জ-৫ আসন নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে ষড়যন্ত্র চলছে। সেখানে না হয় জোহা কাকার ছেলেকে জাতীয় পার্টির আসন দিতে হবে। কিন্তু সোনারগাঁ কী কারণে জাতীয় পার্টিকে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে? এখানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যার হাতে নৌকা তুলে দেবেন, তিনিই হবেন নৌকার মাঝি। এখানে গত দশ বছর যাবৎ আওয়ামী লীগ অবহেলিত হচ্ছে। এখানে আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ নেতৃত্বে আসা উচিৎ বলে আমি মনে করি।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা ও নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য একেএম শামীম ওসমান বলেন, আমি গত মাসের ২৭ তারিখ সমাবেশের ডাক দিয়েছিলাম। দলের একটা অংশ বলে সেটা আওয়ামী লীগের সভা ছিল না, সেটা ছিল শামীম ওসমানের জনসভা। যাই হোক, আমি শামীম ওসমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কর্মী ছিলাম, আছি এবং শেখ হাসিনার কর্মী হয়েই মরব। আমি আপনাদের সেই শামীম ওসমান যে ২০০১ সালে বোমা হামলার শিকার হয়ে ২০ জন ভাইকে হারিয়েছি। আমরা সেই আওয়ামী লীগ কর্মী যখন মৃত্যুর মুখে সাংবাদিকরা জিজ্ঞেস করেছিল কিছু বলবেন, তখন একটা কথাই বলেছিলাম- ‘শেখ হাসিনাকে বাঁচান’। শরীর থেকে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ খুলে গিয়েছিল।
শামীম ওসমান বলেন, এখনো অনেকে পরীক্ষা নেওয়ার কথা বলেন। অবস্থান পরিষ্কার করার কথা বলেন। অবশ্যই অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে, ওই বিএনপি-জামায়াত আর সুশীলদের বিরুদ্ধে অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে। কোথায় কী করবেন সেটা নেত্রীর সিদ্ধান্ত, তার কৈফিয়ত চাওয়ার ক্ষমতা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কারও নেই। যদিও এখানে নিজেদের মধ্যে কিছু বিরোধ আছে, আমি সবাইকে নিয়ে কথা বলেছি। সব বিরোধ ভুলে এখানে আমাদের ক্যান্টনমেন্ট করতে হবে। ক্যান্টনমেন্ট হবে আওয়ামী লীগের, ক্যান্টনমেন্ট হবে শেখ হাসিনার।
সামনে কঠিন সময় আসছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, সামনের কঠিন সময় মোকাবিলা করতে দরকার একটা সুশৃঙ্খল দল, দরকার ঐক্যবদ্ধ আওয়ামী লীগ। এখানে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারা বিভেদ ভুলে সবাই মিলে একটা ঐক্যবদ্ধ সোনারগাঁ গড়ে তুলব। প্রয়োজনে আমি শামীম ওসমান প্রতিটা ঘরে ঘরে যেয়ে কাজ করব। এই নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁ আওয়ামী লীগের ছিল, ভবিষ্যতেও থাকবে ইনশাআল্লাহ। তিনি আরও বলেন, জাতির পিতার কন্যা শেখ হাসিনা তিনটি কথা বলেছেন, যা খুবই অর্থবহ। তিনি (প্রধানমন্ত্রী) বলেছেন, আরেকটি ৭৫ ঘটানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, আরেকটি ২১ আগস্ট ঘটানোর পরিকল্পনা হচ্ছে এবং তিনি এও বলেছেন, চতুর্দিক থেকে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। বাংলাদেশে হাজার বছরে একটা বঙ্গবন্ধু আসতো, আর শত বছরে একটা মীরজাফর-মোস্তাক আসতো। এখন জেলায় জেলায় পাড়া-মহল্লায় মোস্তাক সৃষ্টি হয়ে যায়। কখন পেছন দিয়ে ছুরি মারে বলা যায় না।
বিএনপি আজকে হুঙ্কার মারে রাজপথ দখল করবে, সেজন্যই রাজপথে নেমেছিলাম। তাদের বলেছিলাম, সব অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে, সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ও যারা আগুন দিয়ে মানুষ পুড়িয়ে মেরেছে তাদের বিরুদ্ধে খেলা হবে। এই খেলা হবে বাংলাদেশকে মাথা উচু করে দাঁড়াতে। আসেন নিজেদের বিরোধ ভুলে এক হই। বাংলাদেশকে বাঁচাতে হলে আমার নেত্রী শেখ হাসিনাকে দরকার।
এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সরকারের কৃষিমন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক। এ ছাড়া উপস্থিত ছিলেন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক স্থায়ী কমিটির সভাপতি অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, আইন বিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট নবিউল্লাহ হিরু, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম এমপি, মুন্সীগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য মৃণাল ক্রান্তি দাস, নারায়ণগঞ্জ-২ আসনের সংসদ সদস্য নজরুল ইসলাম বাবু, নারায়ণগঞ্জ-৩ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য কায়সার হাসনাত, সোনারগাঁ উপজেলা চেয়ারম্যান শামসুল ইসলাম, নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল হাই, সাধারণ সম্পাদক আবুল হাসনাত শহিদ মো. বাদল, নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন, সাধারণ সম্পাদক খোকন সাহা, নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের শিল্প বিষয়ক সম্পাদক এস এম জাহাঙ্গীর, নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আনিসুর রহমান দিপু প্রমুখ।
প্রসঙ্গত, এর আগে নারায়ণগঞ্জের প্রভাবশালী এ দুই নেতা গত রোজায় জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনের ইফতার মাহফিলে একই টেবিলে বসে ইফতার করেন। তবে এক টেবিলে বসলেও তাদের মধ্যে কথোপকথন দেখা যায়নি। এরপর চির প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে পরিচিত এ দুই জনপ্রতিনিধির দেখা মেলেনি আর কোনো সভা কিংবা দলীয় অনুষ্ঠানে। তবে একসঙ্গে শামীম ওসমান ও আইভীর উপস্থিতি দলীয় নেতা-কর্মীদের কাছে ভিন্ন এক দৃশ্যের অবতারণা করেছে। কারণ, বেশ কয়েকদিন ধরে শামীম ওসমান ও আইভীর বক্তব্যে নারায়ণগঞ্জের রাজনীতি সরগরম হয়ে উঠেছে। তাদের এক মঞ্চে পেয়ে আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরাও বেশ চাঙ্গা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন