দীর্ঘসূত্রতার পেছনে দক্ষ লোকবল অবকাঠামো সঙ্কট : সমন্বয়হীনতা আমলাতান্ত্রিক জটিলতা : শুল্ককর, ফি, চার্জ, মাশুল পরিশোধ করেই প্রাপ্য সেবা চান আমদানি-রফতানিকারকেরা
দেশের প্রধান সমুদ্র বন্দরভিত্তিক সবচেয়ে বড় রাজস্ব আদায়কারী প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে ডিজিটাল উন্নয়নের ছোঁয়া লাগলেও শুল্কায়নপ্রক্রিয়ায় গতি আসেনি। আমদানি পণ্যের চালান খালাসে লেগে যাচ্ছে প্রায় ১২ দিন। এই ধীরগতির কারণে আমদানি ব্যয় এবং সেইসাথে বাড়ছে ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পের উৎপাদন ব্যয়। তার খেসারত দিচ্ছেন আমদানিকারক, শিল্পোদ্যোক্তা থেকে শুরু করে সাধারণ ভোক্তারা। শিল্পের কাঁচামাল ও ক্যাপিটাল মেশিনারিজ খালাসে সময়ক্ষেপণ দেশে শিল্পায়ন, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। বন্দর এবং কাস্টম হাউসের যাবতীয় ফি, মাশুল, ট্যাক্স, চার্জেজ পরিশোধ করার পরও আমদানিকারক তথা বন্দর ব্যবহারকারীরা যথাসময়ে পণ্য ছাড়করণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
চট্টগ্রাম বন্দর, কাস্টমস, সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট এসোসিয়েশন, শিপিংসহ আমদানি-রফতানির সাথে সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায়, চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে দক্ষ লোকবল ও অবকাঠামো সঙ্কট, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা, হয়রানি, বিভিন্ন সংস্থার সাথে সমন্বয়ের অভাব, ডিজিটাল বিড়ম্বনাসহ নানা কারণে শুল্কায়নপ্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হচ্ছে। চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বেড়েছে, কিন্তু তার সাথে তাল মিলিয়ে কাস্টম হাউসের প্রয়োজনীয় সুযোগ-সুবিধা বাড়েনি। এই কারণে বন্দরের সক্ষমতার সুফলও মিলছে না।
চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ জট নেই, বহির্নোঙরে অপেক্ষা ছাড়াই পণ্যবাহী জাহাজ সরাসরি জেটিতে ভিড়ছে। কিন্তু শুল্কায়নপ্রক্রিয়ায় দেরি হওয়ায় পণ্য ডেলিভারিতে সময়ক্ষেপণ হচ্ছে। আবার চট্টগ্রামমুখি সড়কসহ দেশের সড়ক-মহাসড়কে জটের কারণে আমদানি পণ্য গন্তব্যে এবং শিল্পের কাঁচামাল কারখানায় পৌঁছাতে বিলম্ব হচ্ছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। আমদানি-রফতানির প্রায় পুরোটাই সম্পন্ন হয় চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। বন্দরভিত্তিক রাজস্ব আদায়কারী প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের মাধ্যমে আমদানি পণ্যের শুল্কায়নপ্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়। এখাতে গত অর্থবছরে কাস্টম হাউস রের্কড ৬৫ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আহরণ করেছে। দেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির সাথে পাল্লা দিয়ে আমদানি-রফতানি বাড়লেও কাস্টম হাউসের সক্ষমতা তেমন বাড়েনি। গত সোমবার রাজধানী ঢাকায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআর একটি গবেষণা প্রতিবেদন তথা টাইম রিলিজ স্টাডি-২০২২ প্রকাশ করে। তাতে বলা হয়েছে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে আমদানি পণ্যের চালান খালাসে শুল্কায়নপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে গড়ে ১১ দিন ৬ ঘণ্টা ২৩ মিনিট সময় লাগে। আর বেনাপোলে ১০ দিন ৮ ঘণ্টা ১১ মিনিট এবং ঢাকায় ৭ দিন ১১ ঘণ্টা ১৯ মিনিট সময় লাগে। বন্দরে পণ্য আসার পর বিল অব এন্ট্রি জমা থেকে শুরু করে কাগজপত্র দাখিল, পণ্যের চালান পরীক্ষা-নিরীক্ষা, মূল্যায়ন, শুল্ক-কর পরিশোধ এবং পণ্য খালাস করে নেওয়া-এই ছয়টি ধাপ সম্পন্ন করা হয়। এতে বলা হয়, আমদানিকারকের কাগজপত্র সংগ্রহ ও জমা অর্থাৎ শুল্কায়নপ্রক্রিয়া শুরুর আগেই ৭২ থেকে ৭৮ শতাংশ সময় চলে যায়।
কাস্টম হাউসের শুল্কায়নপ্রক্রিয়ায় এমন চিত্রে হতাশ বন্দর ব্যবহারকারীরা। এজন্য তারা কাস্টম হাউসের দক্ষ লোকবল ও অবকাঠামো সঙ্কট, আমলাতান্ত্রিক জটিলতাকে প্রধান সমস্যা হিসাবে দেখছেন। কাস্টম হাউসে প্রতিদিন গড়ে ছয় থেকে সাত হাজার বিল অব এন্ট্রি জমা পড়ছে। সে তুলনায় নেই লোকবল। কাস্টম হাউসে কর্মপরিবেশেরও অভাব রয়েছে। অফিস সঙ্কটের কারণে একই কক্ষে এমনকি অডিটোরিয়ামেও গাদাগাদি করে বসে কাজ করছেন কর্মকর্তারা।
বন্দর ও কাস্টম হাউস রাত-দিন ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকলেও আমদানি-রফতানি প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্ট অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোতে সপ্তাহে দুইদিন সরকারি ছুটি। এতে স্বাভাবিক শুল্কায়নপ্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। কোন আমদানিকারক বিই দাখিলের পর সংশ্লিষ্ট গ্রুপে গিয়ে আমদানি পণ্যের শুল্কায়ন অ্যাসেসমেন্ট করেন। সে প্রক্রিয়া শেষে তিনি ব্যাংকের মাধ্যমে কর-শুল্ক পরিশোধ করেন। এরপর কাস্টম হাউস থেকে দেয়া ডেলিভারি অর্ডার নিয়ে সংশ্লিষ্ট শিপিং এজেন্টের কাছে জমা দিচ্ছেন। ওই ডিও পাওয়ার পরই বন্দর থেকে পণ্য ছাড় করানো হয়। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় কোথাও কোন সমস্যা হলে পণ্য ছাড় করতে বেশি সময় লাগে। কিছু কিছু পণ্যের আমদানির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের ছাড়পত্র লাগে। ওইসব প্রতিষ্ঠানেও আছে আমলাতান্ত্রিক জটিলতা আর লোকবল সঙ্কট। আবার কিছু পণ্যের মান যাচাইয়ে নমুনা পরীক্ষার প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু কাস্টম হাউসের পরীক্ষাগারে নেই পর্যাপ্ত লোকবল।
আমদানি-রফতানি বাণিজ্যকে গতিশীল করতে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের শুল্কায়নপ্রক্রিয়া ডিজিটাল পদ্ধতি অ্যাসাইকুডা ওয়ার্ল্ড চালু হয়। এই প্রক্রিয়ায় পণ্য আমদানির পর তার শুল্কায়ন থেকে শুরু করে সবকিছুই অনলাইনে সম্পন্ন হয়। কিন্তু প্রায়ই এর সার্ভারে সমস্যা দেখা দেয়। তাতে শুল্কায়নপ্রক্রিয়া ব্যাহত হয়। কোন আমদানি চালানে মিথ্যা ঘোষণার আলামত বা তথ্য পাওয়ার পর ওই পণ্যের শতভাগ কায়িক পরীক্ষা হয়। এ কারণেও অনেক পণ্য ছাড় করতে সময় লাগে। আবার আমদানিকারকের অবহেলা তথা যথাসময়ে বিল অব এন্ট্রি দাখিল না করায় অনেক পণ্য খালাসে বিলম্ব হয়।
আমদানি পণ্য খালাসে ধীরগতি নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে উৎপাদন বিনিয়োগসহ দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে। বিজিএমইএর প্রথম সহ-সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, তৈরি পোশাক শিল্পে বিদেশি ক্রেতার অর্ডার পাওয়ার পর উৎপাদনের সময় পাওয়া যায় এক মাস। তার মধ্যে কাস্টমসে কাঁচামাল খালাসেই লেগে যায় ১২দিন। এতে হুমকির মুখে পড়েছে তৈরি পোশাকসহ শিল্পখাত। তিনি এ ধরনের প্রতিবেদন প্রকাশের জন্য এনবিআরকে সাধুবাদ জানিয়ে যেকোন মূল্যে শুল্কায়নপ্রক্রিয়া দুই থেকে তিনদিনের মধ্যে কমিয়ে আনার ব্যবস্থা নেয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়নে সরকার শত শত কোটি টাকা ব্যয় করছে। তাহলে এ উন্নয়নের সুফল কোথায়।
চট্টগ্রাম চেম্বারের পরিচালক ও বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক অঞ্জন শেখর দাশ বলেন, ওষুধ, ফল, তৈরি পোশাক শিল্পের কাঁচামাল ও মেশিনারিজ আমদানির ক্ষেত্রে গবেষণা করে ওই প্রতিবেদন দিয়েছে এনবিআর। তাতে দেখা যাচ্ছে এ চারটি পণ্য খালাসের ক্ষেত্রে গড়ে প্রায় ১২ দিন সময় লাগছে। এমন দীর্ঘসূত্রতা অব্যাহত থাকলে উন্নয়ন-বিনিয়োগ বিঘ্নিত হবে জানিয়ে তিনি বলেন, দেশে ১০০টি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল হচ্ছে। কিন্তু আমদানি-রফতানি কার্যক্রম সহজতর না হলে সেখানে বিদেশি বিনিয়োগ আসবেনা। তাতে কর্মসংস্থানও ব্যাহত হবে।
সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট এসোসিয়েশনের নেতা কাজী মাহমুদ ইমাম বিলু বলেন, বেশিরভাগ পণ্য যথাসময়ে ছাড় করা হচ্ছে। তবে কিছু কিছু পণ্যের ক্ষেত্রে জটিলতার কারণে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হচ্ছে। দিনে ছয় থেকে ৭০০০ বিই জমা পড়ছে। সে তুলনায় লোকবল নেই। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে দক্ষ লোকবল, কর্মপরিবেশের যেমন অভাব রয়েছে তেমনি সার্ভার জটিলতার কারণেও শুল্কায়ন বিঘ্নিত হচ্ছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সচিব মো. ওমর ফারুক বলেন, বন্দরের সক্ষমতা বাড়ায় এখন জাহাজ জট নেই। জাহাজ এসেই জেটিতে ভিড়ছে। কিন্তু শুল্কায়নপ্রক্রিয়ায় দেরি এবং সড়কে যানজটসহ বেশকিছু সমস্যার কারণে পণ্য খালাসে সময় লাগছে। তিনি বলেন, আমরা চাই দ্রুত সময়ে পণ্য খালাস হয়ে যাক। জাহাজ থেকে সরাসরি পণ্য খালাস করে নিতে পারলে আরও ভালো। আমদানি-রফতানি সচল রাখতে কাস্টমসের সাথে সমন্বয় করেই বন্দর কাজ করছে বলে জানান তিনি।
চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের অতিরিক্ত কমিশনার ডা. আবু নূর রাশেদ আহমেদ বলেন, এনবিআরের যে টাইম রিলিজ স্টাডি প্রকাশ করা হয়েছে তাতে শুধুমাত্র শুল্কায়নপ্রক্রিয়ার বিষয়টি নয় এর সাথে সংশ্লিষ্ট আরও কিছু প্রক্রিয়ার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। সব মিলিয়ে পণ্য ছাড়ে কিছুটা সময় বেশি লাগছে। তবে আগের তুলনায় এ সময় অনেক কমেছে। অর্ধেক জনবল দিয়ে চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসের কার্যক্রম চলছে। অবকাঠামোগতও কিছু সমস্যা রয়েছে। মাঝেমধ্যে সার্ভারের বিগড়ে যাওয়ার কারণেও কিছুটা সমস্যা হচ্ছে। তবে এরপরও কাস্টম হাউসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা আন্তরিকতার সাথে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন