প্রতি মুহূর্তে আমরা উন্নত দেশ, উন্নত জাতি হওয়ার স্বপ্ন দেখি। উন্নত দেশগুলোকে অনুকরণ করি। তাদের পোশাক-পরিচ্ছদ, খাদ্যাভ্যাস, চাল-চলন, আচার-আচরণ, কৃষ্টি-কালচার ইত্যাদি অনুকরণ করে আমরা আমাদের উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে ত্বরান্বিত করতে চাই। এক্ষেত্রে আমরা শুধুমাত্র আমাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, অবকাঠামোগত অগ্রগতি, প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও জীবনযাত্রার পরিবর্তনÑ এগুলোকেই সূচক হিসেবে মনে করি বা প্রাধান্য দেই। উন্নত জাতি হতে হলে কি শুধু অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, অবকাঠামোগত অগ্রগতি বা বস্তুগত উন্নতিই যথেষ্ট? নাকি সর্বাগ্রে প্রয়োজন উন্নত মানুষ?
জাতি বলতে আমরা কী বুঝি বা জাতি কী নিয়ে গঠিত? যেমন বাঙালি জাতি বলতে আমরা কি বাংলার রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট, দালান-কোঠা, মিল-কারখানা ইত্যাদি বুঝি, নাকি বাংলার মানুষকে বুঝি? অবকাঠামোগত উন্নয়ন অবশ্যই প্রয়োজন এবং অপরিহার্য। কিন্তু তারও আগে প্রয়োজন মানুষের উন্নয়ন। মানুষের উন্নয়ন মানেÑ মানবিক উন্নয়ন, মনুষ্যত্বের উন্নয়ন, মানবসত্তার উন্নয়ন। মানুষ বলতে শুধু সুন্দর ও সুঠাম দেহ বিশিষ্ট দুপেয়ে প্রাণীকেই বুঝায় না। মানুষ বলতে বুঝায় স্রষ্টার এমন এক সৃষ্টিকে, যার মধ্যে মনুষ্যত্ববোধ রয়েছে। যেই গুণগুলি (দয়া-মায়া, প্রেম-ভালোবাসা, মহানুভবতা, উদারতা, জ্ঞান, বুদ্ধি-বিবেক, চিন্তাশীলতা, সভ্যতা, সৌন্দর্য্যবোধ, শৃঙ্খলা, নিয়মানুবর্ততা, পরিচ্ছন্নতা, সহিষ্ণুতা, লজ্জাশীলতা ইত্যাদি) মানুষকে অন্যান্য সকল প্রাণী বা সৃষ্টি থেকে আলাদা করেছে সেইসকল গুণাবলীর একটি সামষ্টিক রূপকেই মানুষ বলা যায়। আসলে মানুষ হতে হলে একই সাথে শারীরিক, মানসিক ও আত্মিকভাবে পরিপূর্ণ এক সত্তায় পরিণত হতে হয়। এই তিনটির সামষ্টিক বিকাশ ব্যতিরেকে সত্যিকার অর্থে মানুষ হওয়া যায় না। তাই বলা যায়, মানুষ হিসেবে যে যত বেশি যথার্থতা অর্জন করতে পেরেছে সেই তত উন্নত মানুষ। আর এরকম উন্নত মানুষ নিয়েই গড়ে ওঠে একটি উন্নত জাতি। তাই মানব সম্পদ উন্নয়নের মাধ্যমে উন্নত মানুষ তৈরিতে পরিবার, সমাজ, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান, রাষ্ট্র তথা সবাইকে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করতে হবে। আর এই উন্নয়ন আজ শুধু ব্যক্তির জ্ঞান ও দক্ষতা উন্নয়নের মাঝেই সীমাবদ্ধ রাখা যথেষ্ট নয়। সাথে সাথে তার মানবিক ও নৈতিক উন্নয়নের দিকেও মনোযোগ দিতে হবে। তা না হলে পরিণতি যে কী ভয়াবহ হতে পারে তা পত্র-পত্রিকার পাতা খুললেই অনুমান করা যায়। আমাদের মনে রাখতে হবে, নৈতিক দিক দিয়ে অধঃপতিত মানুষ দিয়ে উন্নত জাতি তৈরি করা যাবে না, হোক সে জাতি বৈষয়িক বিভিন্ন সূচকে যতই অগ্রসরমান। যুগে যুগে ইতিহাসের পাতায় এই কথার সত্যতাই পরিলক্ষিত হয়েছে। মানুষকে যে কারণে মানুষ বলা হয়, সেই কারণগুলো পরিচর্যার মাধ্যমে উৎকর্ষ সাধন করা এবং মানুষের ভেতরের পশুত্বের বিনাশ ও মনুষ্যত্বের বিকাশের মাধ্যমে উন্নত মানুষে পরিণত হতে পারলে তবেই উন্নত জাতি হওয়ার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেবে। অন্যথায় ১ বাদ দিয়ে শুধু ০ দিয়ে যত বড় সংখ্যাই (০০০০০০০০০০০) গঠন করি না কেন তার যেমন মূল্য নেই, ঠিক তেমনি উন্নত জীবনবোধ ও নৈতিকতা সমৃদ্ধ এবং মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন আদর্শ মানুষ তৈরি না করে শুধু অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, বস্তুগত উৎকর্ষ সাধন বা প্রযুক্তিগত অগ্রগতির মাধ্যমে উন্নত জাতি বা দেশ বিনির্মাণের স্বপ্ন দেখা আকাশ কুসুম কল্পনা ছাড়া আর কিছু নয়।
জীবনের সকল ক্ষেত্রে ভালোর প্রতি তীব্র আকাক্সক্ষা আমাদের মজ্জাগত। আমরা সর্বদা ভালোটিই চাই। আমার শরীর ভালো হোক, স্বাস্থ্য ভালো থাকুক, আমি যেন দেখতে ভালো হই, আমার খাবার ভালো হোক, পোশাক-পরিচ্ছদ ভালো হোক, বাসস্থানটি ভালো হোক, একটি ভালো ক্যারিয়ার আমার হোক, আমার একজন ভালো জীবনসঙ্গী হোক, সন্তানরা ভালো হোক, পরিবার ভালো থাকুক ইত্যাদির প্রত্যাশা সহজাত। এসব চাওয়া অমূলক বা অযৌক্তিকও নয় এবং এই প্রত্যাশাগুলো করাই উচিত। কিন্তু আমাদের ব্যক্তিসত্তাটি ভালো হোক বা ব্যক্তি হিসেবে আমি ভালো হই সেটি আমরা কয়জন চাই? আমি ভালো মানুষ হই এরকম স্বপ্ন আমরা কি দেখি? অথচ এই স্বপ্নটিই সর্বাগ্রে দেখা উচিত।
আমাদের মধ্যে এমন কেউ কি আছে যে চায়, তার সন্তানটি খারাপ হোক, দুষ্ট হোক, প্রতারক হোক, সন্ত্রাসী হোক, অত্যাচারী হোক, দুর্নীতি পরায়ণ হোক, অমানুষ হোক? না, আমার কেউই এমনটি চাই না। এমনকি সমাজের সবচেয়ে খারাপ মানুষটিও চায় না যে, তার সন্তান খারাপ হোক। কিন্তু কেন যেন নিজের ব্যাপারে বা নিজের ব্যক্তিসত্তায় ভালোর এই প্রত্যাশাটি আমরা করতে চাই না। কেন যেন আমরা ভালো মানুষটি হতে চাই না। ধরা যাক, আম গাছের একটি চারা লাগানো হলো। চারাটি লাগানোর পরে আমরা কী প্রত্যাশা করি? আমরা প্রত্যাশা করি, চারাটি ধীরে ধীরে বড় হবে, সুবিস্তৃত হবে, পত্র-পল্লবে সুশোভিত হবে, সুবিশাল বৃক্ষে পরিণত হবে, সুমিষ্ট আম দেবে- এরকমই তো? স্বভাবত আমরা এমনটিই চাইবো। এখন প্রশ্ন হলো, সুমিষ্ট আম পেতে আমরা সর্বপ্রথম কোন কাজটি করি? আমরা কিন্তু সবার আগে একটি ভালো, পোকামুক্ত, নীরোগ, সুস্থ বীজ বাছাই করি। অসুস্থ বা পোকাযুক্ত, দুর্বল বীজ থেকে কি ভালো চারা বা ভালো ফল আশা করা যায়? অথচ, আমরা নিজেরা ভালো না হয়েও আমাদের সন্তানদের থেকে ভালোর সর্বোচ্চ প্রত্যাশাটুকু করি। যে প্রত্যাশাটি আমরা আমাদের সন্তানদের ক্ষেত্রে করি বা যে স্বপ্নটি আমরা আমাদের সন্তানদের নিয়ে দেখি, সেই একই প্রত্যাশা আমরা আমাদের নিজেদের বেলায় করি না।
আবার আমরা মনে করি, আমাদের ছেলে-মেয়েদের পেছনে কাড়ি কাড়ি টাকা খরচ করে শুধু নামিদামি স্কুলে পাঠালেই তারা মানুষ হয়ে যাবে। অথচ, তাদের সত্যিকারের মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে মাতা-পিতা বা পরিবারেরও যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে তা অনুধাবন করি না। ফলস্বরূপ সন্তানদের বাবা-মার সান্নিধ্য বা তাদের পর্যাপ্ত সময় না দিয়ে শুধু অর্থ ব্যয় করাকেই যথেষ্ট মনে করি। সন্তান ভালো বা মন্দ হওয়ার পেছনে মাতা-পিতার দায় রয়েছে বলে আমাদের জানিয়েছেন বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এবং এ ব্যাপারে আমাদের সতর্ক হতে বলেছেন তিনি। তাই সন্তানদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার পাশাপাশি তারা যেন আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠে সেদিকেও আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে। আর এজন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন নিজেদেরকে উন্নত বা ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা। কেননা, আমরা জানি, শিশুরা অনুকরণ প্রিয় অর্থাৎ বড়দের দেখেই তারা শিখে থাকে। নামিদামি স্কুল হয়তো তাদের অর্থকরী মানুষ (অর্থাৎ যার অর্থোপার্জন ক্ষমতা বেশি) বানাবে কিন্তু নৈতিক মূল্যবোধসম্পন্ন উন্নত মানুষ কি বানাতে পারছে? যদিও পরিবারের পরই এ ব্যাপারে তার দায়িত্ব অপরিসীম। তাছাড়া সমাজ, রাষ্ট্র ও সরকারও এই দায় এড়াতে পারে না। তাই জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে যেভাবে আমরা ভালোর প্রত্যাশা করি, একইভাবে আমাদের নিজেদের ব্যক্তিসত্তার উন্নয়নেও যত্নবান হই এবং উন্নত জাতি গঠনে আত্মনিয়োগ করি।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও জেলা লাইব্রেরিয়ান, শেরপুর।
sazzad.karim70@gmail.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন