দীর্ঘ ১০ বছরের বেশি সময় কোনো প্রকার কমিটি ছাড়াই চলার পর অবশেষে ৪১ সদস্যবিশিষ্ট কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটি গত শনিবার ঘোষণা করেছে কেন্দ্রীয় যুবলীগ। কমিটিতে একজনকে আহ্বায়ক, দুজনকে যুগ্ম আহ্বায়ক ও ৩৮ জনকে সদস্য করা হয়েছে। এক দশক পর কমিটি কমিটি ঘোষণা হওয়ায় পদপ্রাপ্ত নেতারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অভিনন্দনে ভাসছেন। তবে বঞ্চিতদের সমর্থকরা জানাচ্ছেন তীব্র ক্ষোভের প্রতিক্রিয়া।
সংগঠনের নেতাকর্মীদের অভিযোগ- ঘোষিত কমিটিতে কুমিল্লার আলোচিত এক ছাত্রলীগ নেতা হত্যা মামলার এজাহারভুক্ত আসামিকে অন্যতম শীর্ষ পদ দিয়ে যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয়েছে। এ ছাড়া যারা মাঠের রাজনীতিতে সক্রিয় নন, এমন ব্যক্তিদেরও পদ দেওয়া হলেও বঞ্চিত করা হয়েছে মাঠের পরিশ্রমী নেতাদের।দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কুমিল্লায় রাজনৈতিক বিরোধে গত দেড় দশকে যে কয়টি খুনের ঘটনা ঘটেছে; তার মধ্যে আলোচিত একটি হলো ছাত্রলীগ নেতা এম সাইফুল ইসলাম প্রধান হত্যাকাণ্ড। তৃণমূল থেকে উঠে আসা সাইফুল কুমিল্লা শহর ছাত্রলীগের সভাপতির পদে থাকা অবস্থায় ২০১৫ সালে তাকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। দেশব্যাপী আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় হওয়া মামলার ৯ নম্বর এজাহারভুক্ত আসামি হলেন সদ্য ঘোষিত কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা যুবলীগের যুগ্ম আহ্বায়ক আবদুস ছোবহান খন্দকার সেলিম।
এ ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে ওই ছাত্রলীগের নেতার পরিবারের সদস্যরা বলেছেন, ‘খুনের পুরস্কার’ দেওয়া হয়েছে ওই নেতাকে। আবদুস ছোবহান খন্দকার সেলিম কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
শনিবার রাত ১১টার দিকে যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির উপ-দপ্তর সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন শাহজাদা স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে কমিটির তথ্য জানানো হয়। কমিটির অনুমোদন দেন যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি শেখ ফজলে শামস পরশ ও সাধারণ সম্পাদক মো. মাইনুল হোসেন খান নিখিল। এই কমিটিতে আহ্বায়ক করা হয়েছে কুমিল্লা সরকারি কলেজ ছাত্রসংসদের সাবেক সহসভাপতি (ভিপি) মো. কামরুল হাসান শাহীনকে। শাহীন সরকারের অর্থমন্ত্রী ও কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আ হ ম মুস্তফা কামালের বড় ভাইয়ের ছেলে। কমিটির সিনিয়ার যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয়েছে লাকসাম পৌরসভার মেয়র অধ্যাপক মো. আবুল খায়েরকে। তার পরেই আবদুস ছোবহান খন্দকার সেলিমের নাম। তিনি সাবেক রেলমন্ত্রী ও কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সংসদ সদস্য মো. মুজিবুল হকের অনুসারী হিসেবে পরিচিত।
দলের নেতাকর্মীরা জানায়, ১৯৯৭ সালে ৬৭ সদস্যবিশিষ্ট ৩ বছর মেয়াদী কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা যুবলীগের কমিটি ঘোষণা করা হয়। ওই কমিটিতে শাহীনুল ইসলামকে সভাপতি ও মঞ্জুর মোর্শেদকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়। তিন বছর মেয়াদের সেই কমিটি নেতৃত্ব দিয়েছে দেড় দশকের বেশি সময়। ২০১২ সালের ১৭ জুন ওই কমিটি ভেঙে দেয় কেন্দ্রীয় যুবলীগ। এরপর থেকে কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা যুবলীগের কোনো কমিটি ছিলো না।
জেলার ১৭টি উপজেলার মধ্যে কুমিল্লা সদর উপজেলাসহ দক্ষিণের ১০টি উপজেলা নিয়ে গঠিত কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা যুবলীগের সাংগঠনিক জেলা। এমন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে দীর্ঘ এক দশকের বেশি সময় ধরে কোন প্রকার অভিভাবক ছাড়াই চলতে থাকা সাংগঠনটির সার্বিক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে জেলা যুবলীগের কয়েকজন নেতার নেতৃত্বে। তাঁদেরই একজন হলেন কুমিল্লা সরকারি কলেজ ছাত্রসংসদের সাবেক জিএস আতিকুর রহমান খান পিন্টু।
ঘোষিত কমিটি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে আতিকুর রহমান খান পিন্টু বলেন, এই কমিটিতে মাঠের পরিশ্রমী নেতাদের মূল্যায়ন করা হয়নি। গত এক দশকের বেশি সময় ধরে আমি কেন্দ্রীয় সভাপতি-সাধারণ সম্পাদের নির্দেশে আন্দোলন-সংগ্রামসহ সকল কর্মসূচি পালন করেছি। আমি নিজে আহ্বায়ক বা সভাপতি পদপ্রত্যাশী ছিলাম। কিন্তু সাইফুল হত্যা মামলার এজাহারে আমার নাম দশ নম্বরে থাকায় আমাকে পদে রাখা হয়নি। আমি দলের সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। কিন্তু যেই অভিযোগে আমি বাদ পড়েছি, সেই মামলার ৯ নম্বর আসামি কীভাবে শীর্ষ পদ পেয়েছে- এটা কুমিল্লার তৃণমূল যুবলীগ কর্মীরা জানতে চায়।
আতিকুর রহমান খান পিন্টু ভাষ্য, কুমিল্লা সদরসহ এই কমিটির অবস্থান। কিন্তু যাদের পদে রাখা হয়েছে, তারা বেশিরভাগই সদরের বাইরে। তাদের দিয়ে সামনের দিনে প্রতিপক্ষের আন্দোলন কতটুকু মোকাবেলা করা যাবে তা এখন দেখার বিষয়। এ কমিটি নিয়ে যুবলীগের ত্যাগী ও তৃণমূল কর্মীদের হৃদযে রক্তক্ষরণ চলছে।
শীর্ষপদ প্রত্যাশী আরেক নেতা কুমিল্লা কোতয়ালি থানা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক গাজী রিয়াজ মাহমুদ বলেন, গ্রুপিংয়ের রাজনীতির কারণে আমাদের বঞ্চিত করা হয়েছে। কোনো পেশাকে ছোট করছি না। এরপরও বলতে হচ্ছে কমিটিতে মাঠের কর্মী খুব বেশি নেই। অথচ সেন্টারিং মিস্ত্রি, তরকারি বিক্রেতা ও রাজমিস্ত্রিদের স্থান দেওয়া হয়েছে। যাদের ১০ জন কর্মীও নেই।
মামলার প্রসঙ্গে যুগ্ম আহ্বায়কের পদ পাওয়া আবদুস ছোবহান খন্দকার সেলিম বলেন, ওই মামলাটি একটি পলিটিক্যাল (রাজনৈতিক) মামলা। সেটাকে নিয়ে এখন আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছ। এনিয়ে ষড়যন্ত্র করে তারা কিছু করতে পারবে না।
হত্যাকাণ্ডের শিকার ছাত্রলীগ নেতা সাইফুলের ছোট ভাই কুমিল্লা মহানগর যুবলীগ নেতা এম কামরুল হাসান নান্নু বলেন, ২০১৫ সালের ১১ এপ্রিল আমার ভাইকে কুপিয়ে ও গুলি করে গুরুতর আহত করা হয়। পরদিন ১২ এপ্রিল সকালে তিনি মারা যান। ভাবতে অবাক লাগে আমার ভাইয়ের খুনিরা আজ বড় বড় পদ পেয়ে পুরষ্কৃত হয়। এর চেয়ে বেদনার কী হতে পারে?
সোমবার বিকেলে এ বিষয়ে জানতে যুবলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক মো. মাইনুল হোসেন খান নিখিলের মোবাইলে একাধিকার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি। পরে সাংগঠনিক সম্পাদক মশিউর রহমান চপলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি খাবার খাচ্ছি, একটু পরে কথা বলবো।’ পরবর্তীতে বেশ কয়েকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
সোমবার সন্ধ্যায় বিষয়টি নিয়ে জানতে চাইলে কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা যুবলীগের সদ্য ঘোষিত কমিটির আহ্বায়ক কামরুল হাসান শাহীন বলেন, ওই মামলাটি ছিলো রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক। সেখানে আবদুস ছোবহান খন্দকার সেলিমের মতো অনেক নেতাকর্মীকে উদ্দেশ্যমূলকভাবে আসামি করা হয়েছে। সেলিম ওই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ছিলো না। তার বিরুদ্ধে এখন মিথ্যা মামলার বিষয় নিয়ে ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন