ছিলেন ফুটপাতের হকার। সেখান থেকে নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বনে যান ‘হকার নেতা’। গুলিস্তান-ফুলবাড়িয়া এলাকায় গড়ে তোলেন বিশাল ক্যাডার বাহিনী। ওয়ার্ড কমিশনার শাহাবুদ্দিন হত্যা মামলার আসামি তিনি। হকার নেতা থেকে সন্ত্রাসী দেলু রাতারাতি হয়ে যান একাধিক দোকানের মালিক। পরে রীতিমতো ঢাকা দক্ষিণ সিটি করর্পোরেশনের মালিকানাধীন ফুলবাড়িয়ার ৩টি হকার্স মার্কেটের অলিখিত নিয়ন্তা। পরে অবশ্য তার কুখ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে ‘অনলাইন ক্যাসিনো দেলু’ হিসেবে। শত শত কোটি টাকার মালিক গুলিস্তান ফুলবাড়িয়া জাকের প্লাজা, সিটি প্লাজা ও নগরপ্লাজা দোকান মালিক সমিতির সভাপতি দেলোয়ার হোসেন দেলুর বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
গত রোববার সংস্থার সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ জাফর সাদেক শিবলী বাদী হয়ে এ মামলা করেন। এজাহারে তার বিরুদ্ধে ১১ কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ আনা হয়েছে। দাখিলকৃত সম্পদ বিবরণী যাচাই শেষে এ সম্পদের বৈধ কোনো উৎস খুঁজে পাওয়া যায়নি।
এজাহারের তথ্য মতে, ঢাকার গুলিস্তানের ফুলবাড়িয়ার জাকের প্লাজা, সিটি প্লাজা ও নগর প্লাজার তিন মার্কেটে ১৬টি অবৈধ দোকান, পাচার করা অর্থে মালয়েশিয়ায় বাড়ি, পল্টন খালপাড়ে প্রীতম-জামান টাওয়ারে ১৫ তলায় মেয়ের নামে সাড়ে ৮ হাজার ৪৪০ বর্গফুটের বাণিজ্যিক স্পেস রয়েছে।
এজাহারে উল্লেখ করা হয়, আসামি দেলোয়ার হোসেন গত ২৭ অক্টোবরে দাখিল করা সম্পদ বিবরণীতে তার নিজ নামে ৬ কোটি ৭ লাখ ৬৮ হাজার ৭৭০ টাকার স্থাবর সম্পদের হিসাব বিবরণী দাখিল করেন। কিন্তু সম্পদ যাচাইয়ে তার নিজ নামে ও বেনামে ৯ কোটি ৬৫ লাখ ১ হাজার ২২৫ টাকার স্থাবর সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। যাচাইকালে বেরিয়ে আসে তার ৩ কোটি ৪ লাখ ৭১ হাজার ৩৬৪ টাকার স্থাবর সম্পদের তথ্য। এজাহারে ১১ কোটি টাকার সম্পদের তথ্য উল্লেখ করা হলেও তার বিপুল পরিমাণ অবৈধ সম্পদ রয়েছে।
ঢাকার বাইরে নারায়ণগঞ্জে রয়েছে ৫টি বহুতল ভবন। সেগুনবাগিচায় রযেছে ১৫টি ফ্ল্যাট। পল্টনের আজাদ প্রোডাক্টস বিল্ডিংয়ে নিজস্ব বাণিজ্যিক অফিস। মুগদা থানার পাশে ‘অমিত ডিজাইন এন্ড আর্কিটেক্ট’ লিমিটেড নামের এক বিলাস বহুল ভবনে রয়েছে তার নিজস্ব ২৮ টি ফ্ল্যাট। সেসব সম্পদের তথ্য মামলার তদন্ত পর্যায়ে উঠে আসবে বলে জানা গেছে। দুদকের মামলায় দুর্নীতি দমন কমিশন আইন ২০০৪ এর ২৭(১) ও ২৬(২) ধারাসহ মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন-২০১২ এর ৪(২) ধারা প্রয়োগ করা হয়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ২০১৭ সালে দেলোয়ার হোসেন দেলুর হাত ধরে দেশে অনলাইন ক্যাসিনোর যাত্রা শুরু। বিদেশ থেকে অনলাইন ক্যাসিনোর সরঞ্জাম এনে তিনি রাজধানীর পল্টন এলাকার প্রীতম-জামান টাওয়ারের ১৩ ও ১৪ তলায় ব্যবসা শুরু করেন। অনলাইন ক্যাসিনোকে জনপ্রিয় করতে নানা উদ্যোগ নেন দেলু। খাদ্য ও পানীয় ফ্রি সরবরাহ করতেন। এছাড়া ছিল সুন্দরী নারীসহ নানা লোভনীয় অফার। এভাবে কেবল অনলাইন ক্যাসিনোর মাধ্যমেই দেলু আয় করেন কয়েক শ’ কোটি।এ টাকায় তিনি মালয়েশিয়া গড়ে তুলেছেন ‘সেকেন্ড হোম’। সেখানকার কেপাং সিটিতে রয়েছে তার নিজস্ব অফিস ও ব্যবসা।
সিঙ্গাপুর ও মালয়শিয়ায় হুন্ডির মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা পাচার করেন। দেলু সেখানে নিজেকে ঠিকাদার ও ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দেন। মূলত, ফুটপাতের হকার থেকে তিনি দোকান মালিক, দোকান মালিক থেকে ফুলবাড়িয়া এলাকার ৩টি মার্কেটের সভাপতি হন। সভাপতি হিসেবে সিটি করর্পোরেশনের অননুমোদিত, মার্কেটের নকশাবহির্ভুত দোকান তৈরি করেন। মার্কেটের টয়লেট, করিডোর, সামনের খোলা জায়গা, লিফটের জায়গা, ফ্লোর স্পেস, বারান্দা, বেজমেন্ট, ক্রেতাদের হাঁটাচলার জন্য রাখা খোলা জায়গা দখল করে নকশা বহির্ভুত অতিরিক্ত ১২শ’ কোনা তৈরি করেন। পরে একেকটি দোকান ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকা ‘সেলামি’ নিয়ে বিক্রি করেন।
তিনটি মার্কেট থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েও বিগত সিটি করর্পোরেশন নির্বাচনের পর তিনি ভোল পাল্টে ফেলেন। দোকানদারদের কাছ থেকে নেয়া টাকা আত্মসাৎ করার কৌশল হিসেবে সাবেক মেয়র সাঈদ খোকনসহ ৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেন দেলোয়ার হোসেন দেলু। ২০২০ সালের ২৯ ডিসেম্বর দায়ের করা এ মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে তিনি ৩৪ কোটি ৮৯ লাখ টাকা আত্মসাতের মামলা করেন। নির্বাচিত মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের আস্থা অর্জনের লক্ষ্যেই তিনি পূর্বের মেয়রের সঙ্গে কৃত্রিম বৈরিতার আমেজ সৃষ্টি করেন।
দেলোয়ার হোসেন দেলুর বিরুদ্ধে মামলা হলেও তার অবৈধ সম্পদ অর্জনের প্রধান সহযোগী ফিরোজ আহমেদ রয়ে গেছেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। ফিরোজ ছিলেন সদরঘাট-গুলিস্তানের ক্ষুদ্র গেঞ্জি ব্যবসায়ী। এক সময়কার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ফিরোজও দেলুর সংস্পর্শে থেকে মালিক হন শত শত কোটি টাকার। ঢাকার অভিজাত এলাকায় রয়েছে ফিরোজের ফ্ল্যাট, প্লট, মার্কেট, দোকান। রয়েছে দামি গাড়ি। পোষেন সশস্ত্র ক্যাডার ও অপেশাদার গণমাধ্যম কর্মী।পুলিশ প্রশাসনের সঙ্গেও রয়েছে দারুণ সখ্যতা।তবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করর্পোরেশনে (ডিএসসিসি) দুর্নীতিবিরোধী অভিযান এবং দেলুর বিরুদ্ধে মামলার জের ধরে বেরিয়ে এসেছে মার্কেটের আরেক স্বঘোষিত নেতা ফিরোজ আহমেদের আঙ্গুল ফুলে ‘বটগাছ’ হওয়ার কাহিনী।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের দুর্নীতিবাজ ১৫ কর্মকর্তা-কর্মচারি অনুসন্ধান নথি (স্মারক নং-০০.০১.০০০০.৫০১.০১.০৩১.২০/২১) থেকে জানা যায়, ফিরোজ আহমেদের বাড়ি কুমিল্লার মনোহরগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ বাতাবাড়িয়া গ্রামে। পিতা-মো. আবুল হোসেন। দারিদ্রের টানাপড়েন খুব অল্প বয়সে ফিরোজকে ঢাকায় আসতে বাধ্য করে। নব্বইয়ের দশকে ঢাকায় কপর্দক শূন্য অবস্থায় এলেও তিনি অত্যন্ত চতুর।গুলিস্তানে গেঞ্জি বিক্রি করতেন। এক সময় ছোট একটি দোকানোর মালিকও হন।এই সুবাধে পরিচয় হয় আরেক মার্কেট মাফিয়া দেলোয়ার হোসেন দিলুর সঙ্গে। তার বিশ্বস্ততা অর্জন করেন দ্রুত। সেখান থেকে বনে যান হকার নেতা।
যখন যে সরকার আসে সেই দলীয় লোকদের সঙ্গেই গড়ে তোলেন সখ্যতা। এ প্রক্রিয়ায় এখন তিনি সরকারদলীয় একটি সংগঠনের পদ-পদবি ধারণ করছেন। পরিচয় দিচ্ছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রীর ‘কাছের লোক’ হিসেবে। নিতান্তই একজন হকার ফিরোজ আহমেদ, তার ভাই এবং নিকটাত্মীয়দের নামে ইসলামপুর পাইকারি মার্কেটে রয়েছে ৭টি দোকান। নরসিংদীতে রয়েছে একটি হোসিয়ারি। গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার মনোহরগহেজ রয়েছে নামে বেনামে বিপুল সম্পত্তি।
রাজধানীর কাকরাইলে রাজমনি সিনেমা হলের উল্টোদিকে চালু করেছেন আবাসিক ‘হোটেল মেরিনা ইন্টারন্যাশনাল’। ভবন ভাড়া নিয়ে হোটেল ব্যবসা চালু করলেও এর পেছনে তার বিনিয়োগ ৫ কোটি টাকার বেশি। স্থানীয় সরকার মন্ত্রীকে দিয়ে এটির উদ্বোধন করান। রাজধানীর ৩৭/২, পুরানাপল্টন, বক্সকালভার্ট রোড, জামান টাওয়ায়ের চতুর্থ তলায় রয়েছে সাড়ে ৮হাজার বর্গফুটের একটি বাণিজ্যিক ফ্লোর। এটির বাজার মূল্য অন্তত ১২ কোটি টাকা। রাজধানীর ১১, সেগুন বাগিচায় রয়েছে নিজস্ব ফ্ল্যাট। এটির আনুমানিক মূল্য সাড়ে ৩ কোটি টাকা।
ফুলবাড়িয়ায় অবস্থিত ঢাকা দক্ষিণ সিটি করর্পোরেশনের মালিকানাধীন ‘নগর প্লাজা’ ‘জাকের প্লাজা’ এবং ‘সিটি প্লাজা’য় রয়েছে ৫০টির মতো দোকান। জাকের প্লাজা দোকান মালিক সমিতির এক সময় ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হলেও এখন আর সেই কমিটি নেই। তবে দেলুর অনুপস্থিতিতে ফিরোজ একাই জবর-দখল করে আছেন সমিতির কার্যালয়।
ফুলবাড়িয়ার তিনটি মার্কেটে নামে -বেনামে ফিরোজ আহমেদ একাই হাতিয়ে নিয়েছেন ৫০টির মতো দোকান। নকশা অনুযায়ী মার্কেটগুলোতে ৫ হাজার দোকান থাকার কথা। কিন্তু বাস্তবে দোকান করা হয় ৮ হাজার। দিলু-ফিরোজ সিন্ডিকেট নকশাবহির্ভুত৩ হাজার দোকান (এক্সট্রা দোকান) বরাদ্দ দিয়ে দোকান প্রতি হাতিয়ে নেন ৩০/৩৫ লাখ টাকা।
নকশা বহির্ভুত এসব দোকান ‘বরাদ্দ’ দিয়ে নেয়া হয় অন্তত, ৩শ’ কোটি টাকা। এর মধ্যে অন্তত, দেড় শ’ কোটি পকেটস্থ করেন ফিরোজ একাই। এ ছাড়া তিনি দিলুর বাইরে এককভাবেও বরাদ্দ দেন আরও অর্থশত দোকান। এসব দোকানের কোনো হোল্ডিং নম্বর নেই। বিনা দলিলে কখনো বা সাদা কাগজে টাকার অঙ্ক উল্লেখ করে ‘বিক্রি’র লেনদেন হয়। লেনদেনের পর ক্রেতাদের দেয়া হয় ‘অস্থায়ী বরাদ্দ’। নানা অজুহাতে এ বরাদ্দ বাতিলও করা হয়। না হয় নানা ছুতোয় বিক্রির পরও আদায় করা হয় মোটা অংকের অর্থ।
সাধারণ ব্যবসায়ীদের ওপর নানা অজুহাতে আদায় করেন অর্থ। ফিরোজ সিন্ডিকেটের কাছে ব্যবসায়ীরা জিম্মি। তবে বিপুল অর্থ উত্তোলন করা হলেও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করর্পোরেশনের রাজস্ব বিভাগ এ অর্থের কোনো হিসেবও পায় না। বর্তমান মেয়র দায়িত্ব নেয়ার পর ইউসুফ আলী সরদার-দিলু-ফিরোজ সিন্ডিকেটের বরাদ্দ দেয়া কিছু দোকান ভেঙ্গে ফেলেন। এ সময় ফিরোজ ‘বিপ্লবী’ সেজে ইউটার্ন নেন। নতুন মেয়রের সঙ্গে সখ্যতা সৃষ্টির লক্ষ্যে দেলুর সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক প্রচার করেন।
ফিরোজ আহমেদই দুদককে দিয়ে দেলুর বিরুদ্ধে মামলা করিয়েছেন -মর্মেও প্রচার করছেন তিনি। নব্বইয়ের দশকের সদরঘাট-গুলিস্তানের গেঞ্জি ব্যবসায়ী ফিরোজ আহমেদ গড়ে তোলা সম্পদ সাম্রাজ্যে এখন পর্যন্ত কোনো স্পর্শ না লাগায় ভুক্তভোগী দোকান মালিকদের প্রশ্ন-দেলুর অপকর্মের বিশ্বস্ত সিপাহ সালার ফিরোজ কি তাহলে ধরা-ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাবেন?
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন