ইনকিলাব ডেস্ক : আফগানিস্তান বিশে^র বৃহত্তম পপি উৎপাদনকারী দেশ। এই পপি উৎপাদনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্র গত ১৪ বছরে ৭শ’ কোটি ডলার ব্যয় করেছে। আরো হাজার হাজার কোটি ডলার ব্যয় করেছে দুর্নীতি হ্রাস ও একটি বিশ^াসযোগ্য পুলিশ বাহিনীর প্রশিক্ষণে। এ ছাড়া জেলা কেন্দ্রগুলোকে আফগান সরকারের নিয়ন্ত্রণ রাখতে ও ধীরে ধীরে আইনের শাসন প্রচলনে তাদের অগুণতি ডলার ব্যয় হয়েছে ও লড়াইয়ের প্রধান চাপ মোকাবেলায় হাজার হাজার প্রাণ গেছে। হেলমান্দ প্রদেশের যে সব স্থান শান্ত ও সরকারের দৃঢ় নিয়ন্ত্রণে রয়েছে তার মধ্যে একটি হল গরমশির।
গত পপি মৌসুমে সরকারী ভবনগুলো থেকে তাকালে ঘন ও উঁচু হয়ে ওঠা পপির খেত চোখে পড়ত। গরমশিরে পপি চাষ শুধু অনুমোদিতই নয়, তা স্থানীয় সরকারের অর্থের উৎসও বটে। তালিবানরা যেমন তাদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় পপি চাষিদের কাছ থেকে কর আদায় করে তেমনি আফগান কর্মকর্তারাও করে। পপি থেকে পাওয়া অর্থ গরমশির থেকে কাবুল পর্যন্ত সরকারী কর্মকর্তাদের মধ্যে ভাগাভাগি হয়। এর ফলে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ ঊর্ধ্বতনদের কাছ থেকে সমর্থন পায় এবং আফিম উৎপাদন চলে। সরকারী কর্মকর্তাদের মাদক ব্যবসায়ে লিপ্ত থাকার উদাহরণ হল গরমশির।
আফিমের দেশ আফগানিস্তানে গত বছরে বার বার যাওয়া এবং আফিম চাষী, স্থানীয় নেতা, আফগান ও পশ্চিমা কর্মকর্তাদের সাথে ব্যাপকভিত্তিক সাক্ষাতকারে এ বাস্তবতাই প্রকাশিত হয়েছে যে পাশ্চাত্য সমর্থিত সরকার যদি সফল হয়ও তারপরও সেখানে আফিম চাষ চলবে। আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে আফগান সরকারী কর্মকর্তারা আফিম ব্যবসা, রাজনীতির বাইরে তালিবানদের সাথে প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি এবং মাদক পাচার ও রাজস্ব নিয়ন্ত্রণের লড়াইয়ে সরাসরি জড়িয়ে পড়েছেন। স্থানীয় পর্যায়ে মাদক চোরাচালানি গ্যাংগুলোর মধ্যে প্রায়ই যে লড়াই হয় তা প্রচ- লড়াইয়ে পরিণত হতে পারে, এমনকি সরকারের সহায়তার জন্য যদি মার্কিনিদের ডেকে আনা হয়, তবুও।
আফগানিস্তানে আফিমের উপর ২৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে মাঠ পর্যায়ের কাজ করা এক গবেষক ডেভিড ম্যান্সফিল্ড জানান, সরকারের সহযোগিতার নানা পর্যায় রয়েছে। প্রথমে চাষীদের জায়গা দেয়, তারপর তাদের সাথে সহযোগিতা করে। শেষে করে শিকার অর্থাৎ সরকার গোটা ব্যবসাটাই দখল করে।
পপির বিপুল উৎপাদনের সাথে নতুন তালিবান বিদ্রোহের জোরালো সম্পর্ক রয়েছে। তাদের বুলেট, বোমা ও যানবাহন কেনার অর্থ আসে এ পপি বিক্রয় থেকে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিদ্রোহীরা আফিম ব্যবসায় আরো বেশি সময় দিচ্ছে। আফগানিস্তানের পশ্চিমা কর্মকর্তারা বলেন, যখন নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নতি ঘটে, আফিম ব্যবসা দমন করা তখন সহজ হয়।
নির্ভরযোগ্য অর্থনৈতিক সাফল্যের অনুপস্থিতিতে আফগান সরকার এখন আফিম ব্যবসায় প্রতিযোগিতা করার কারণে তা সীমান্তের বাইরেও ছড়িয়ে গেছে। এ অঞ্চলের সরকারগুলো ক্রমবর্ধমান আফিম প্রবাহের কারণে স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা সমস্যার সম্মুখীন। এ ব্যবসা আফগানিস্তানে অধিকতর প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করার কারণে বছরের পর বছর ধরে দুর্নীতি দমন উদ্যোগ ব্যাহত হচ্ছে। অন্যদিকে তা হচ্ছে আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতা, অপরাধ ও চক্রান্তের উৎস।
প্রেসিডেন্ট আশরাফ গণির প্রশাসন দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইকে একটি প্রধান অঙ্গীকার করেছে। তার সরকারের একজন মুখপাত্র সৈয়দ জাফর হাশেমিকে গরমশিরসহ বিভিন্নস্থানে আফিম চোরাচালানে সরকারী সম্পৃক্ততার ব্যাপারে জিজ্ঞেস করা হলে তিনি জোর দিয়ে বলেন, এ ধরনের আচরণের ক্ষেত্রে কোনো আপস নেই। তিনি বলেন, আফিম থেকে কর আদায়সহ অবৈধ কাজে সরকারী কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার খবর জানতে পারলে প্রেসিডেন্ট সিদ্ধান্তমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
কিন্তু গরমশির ও হেলমান্দের অন্যান্য স্থানে আফিম বলয়ে ব্যবসা জোরেশোরে এবং তালমিলিয়ে চলছে।
আফিম চাষ গ্রামের নেতাদের নেটওয়ার্ক নির্ভর । চাষীরা ক্ষেতে পানি সরবরাহের জন্য লোক রাখে যাদের বলা হয় মিরাব। তারা চাষযোগ্য জমি জরিপ করে এবং জেলা পর্যায় ও কাবুলের কর্মকর্তাদের পক্ষে টাকা সংগ্রহ করে।
কর্মকর্তারা বেসরকারীভাবে স্বীকার করেন যে জাতীয় সরকারের গভীরে তাদের যোগাযোগ বিস্তৃত। কিছু ক্ষেত্রে আঞ্চলিক সংযোগসহ সিনেট বা পার্লামেন্ট সদস্য পর্যন্ত টাকা প্রদান করা হয়। তারা বলেন, অন্যদের মধ্যে প্রাদেশিক ও জেলা প্রশাসনের তদারককারী সংস্থা ইন্ডিপেন্ডেন্ট ডাইরেক্টরেট অব লোকাল গভর্নেন্স-এর কর্মচারীদের অর্থ দেয়া হয়। মার্কিন সামরিক বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের মিত্রসহ আঞ্চলিক পুলিশ ও নিরাপত্তা কমান্ডারদের কোনো কোনো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিও আফিম ব্যবসার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত বলে চিহ্নিত হয়েছেন।
তবে আফিম ব্যবসার মূল অর্থ স্থানীয়, জেলা ও প্রাদেশিক পর্যায়েই থেকে যায়। স্থানীয় কর্মকর্তা ও চাষীদের মতে, গরমশিরের ক্ষেত্রে আফিম ব্যবসা বাবদ প্রাপ্ত অর্থের সিংহভাগ জেলা গভর্নর ও পুলিশ প্রধান পান। স্থানীয় পুলিশও এ অর্থের অংশ পায়।
আফিম চাষীরা বলেন, তারা প্রতি একর জমিতে আফিম চাষের জন্য ৪০ ডলার দেন। অর্থ আদায় প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত কর্মকর্তারা জানান, ২০১৫ সালে শুধু গরমশির জেলা থেকেই ৩০ লাখ ডলার দেয়া হয়েছে। গরমশির হচ্ছে পপি চাষের প্রাণকেন্দ্র হেলমান্দ প্রদেশের কয়েকটি জেলার একটি। ২০১০ সালে আফগানিস্তানে সর্বোচ্চ সংখ্যক সৈন্য এখানে মোতায়েন করা হয়েছিল। সরকার এখানকার আফিম চাষীদের সাথে সখ্যতা গড়ে তুলেছিল। এক ডজনেরও বেশি কৃষক ও কর্মকর্তার সাক্ষাতকার থেকে জানা যায়, গরমশিরের মত মারজা জেলাকেও একই ব্যবস্থার আওতায় আনা হয়। এতে স্থানীয়রা তাদের আফিম চাষের পরিমাণ অনুযায়ী গড়পড়তা পরিমাণ অর্থ দেয়। নাদ আলি জেলাতেও একই অবস্থা চালু ।
সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে তালিবান এ সব জেলার কোনো কোনোটির সন্নিকটবর্তী হলেও স্থানীয় আফিম উৎপাদকদের কাছে তা আলাদা কোনো গুরুত্ব বহন করে না। আমেরিকান সৈন্যরা আসার আগে তারা বিদ্রোহীদের টাকা দিত। আমেরিকানরা চলে যাওয়ার পর তারা সরকারী কর্মকর্তাদের টাকা দেয়। এখন তারা আবার সামঞ্জস্য বিধান করবে।
আফিম চাষ থেকে টাকার পরিমাণ বেড়েই চলেছে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, ইতিমধ্যেই হেলমান্দ প্রদেশে গত মওসুমে উপগ্রহ থেকে তোলা ছবিতে দেখা গেছে যে সামরিক ও পুলিশ ঘাঁটির দৃষ্টিসীমার মধ্যে খোলাখুলি ভাবে আফিম চাষ হচ্ছে।
হেলমান্দ প্রদেশের সাবেক দু’বার পুলিশ প্রধান হাকিম আনগার বলেন, গত কয়েক বছরে আমি দেখেছি কেন্দ্রীয় সরকার, স্থানীয় সরকার, বিদেশী সবাইকে পপি সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করতে দেখেছি। কার্যত তারা কিছুই করেনি, এবং পর্দার অন্তরালে সরকারী কর্মকর্তারা বড়লোক হয়েছে।
আফগানিস্তানে পপি উৎপাদন বন্ধে আন্তর্জাতিক উদ্যোগ ব্যর্থ হয়েছে। জাতিসংঘ ২০০২ সাল থেকে আফগানিস্তানে আফিম উৎপাদনে রেকর্ড রেখে আসছে। এতে দেখা যায় যে ন্যাটোর যুদ্ধ মিশনে শেষ বছর ২০১৪ সালে বেশি আফিম উৎপন্ন হয়।
২০১৫ সালে ছত্রাকের আক্রমণ ও গুবড়ে পোকা উৎপাতে পপি উৎপাদন কোনো কোনো স্থানে অর্ধেক হয়েছে। তবে এ কম উৎপাদন পরবর্তী বছরে তাদের আরো বেশি করে পপি চাষে উদ্বুদ্ধ করেছে।
সরকারের পপি করের প্রসঙ্গে মারজার কর্মকর্তারা বলেন, ছত্রাকের আক্রমণে উৎপাদন কমে যাওয়ায় আগের বছরের চেয়ে তারা অর্থের পরিমাণ অর্ধেকে নামিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। মাদকবিরোধী আইন কার্যকর করণে নিয়োজিত একজন কর্মকর্তা বলেন, আফিম ব্যবসার ক্ষেত্রে তারা জোর চেষ্টা করবে। কারণ, এখানে অনেক টাকা যা উপেক্ষা করা অসম্ভব। সূত্র : নিউইয়র্ক টাইমস। (অসমাপ্ত)
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন