অন্য আয়াতে বলা হয়েছে, যারা তাদের পালনকর্তাকে ভয় করতো তাদেরকে দলে দলে জান্নাতের দিকে নিয়ে যাওয়া হবে। যখন তারা উন্মুক্ত দরজা দিয়ে জান্নাতে পৌঁছতে তাদেরকে বলবে, তোমাদের প্রতি সালাম, তোমরা সুখে থাকো। অতঃপর সর্বদা বসবাসের জন্য তোমরা জান্নাতে প্রবেশ করো। (সূরা যুমার : আয়াত ৭৩)।
তাকওয়া মাগফেরাতের মাধ্যম : পবিত্র কুরআনে কারীমে আল্লাহ তাআলা তাকওয়া অর্জনকারী মুত্তাকীদের জন্য মাগফেরাত ও ক্ষমার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। যেমন আল্লাহ বলেন, হে মুমিনগণ! তোমরা যদি আল্লাহকে ভয় করতে থাকো, তবে তিনি তোমাদের মধ্যে ফয়সালা করে দেবেন, তোমাদের পাপমোচন করবেন এবং তোমাদের ক্ষমা করবেন। বস্তুত আল্লাহ বড়ই অনুগ্রহশীল। (সূরা আনফাল : আয়াত ২৯)। অন্য আয়াতে বলেছেন, যে আল্লাহকে ভয় করে আল্লাহ তার পাপসমূহ মোচন করেন এবং তার পুরস্কার বাড়িয়ে দেন। (সূরা তালাক : আয়াত ৫)। উপরোক্ত আয়াত সমূহ দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, তাকওয়ার মধ্যে নিম্নোক্ত কল্যাণসমূহ বিদ্যমান। যেমন : ১. ইহকাল ও পরকালের বিপদ থেকে মুক্তিলাভ। ২. কল্পনাতীত রিজিক প্রাপ্ত হওয়া। ৩. সব কাজ সহজ হওয়া। ৪. ক্ষমা ও পাপ মোচন। ৫. বাড়তি পুরস্কার লাভ। ৬. সত্য-মিথ্যা পার্থক্য করার যোগ্যতা। ৭. আল্লাহ সাথে থাকা। ৮. আল্লাহর বন্ধু হওয়া। ৯. আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করা। ১০. স্রষ্টা ও সৃষ্টির নিকট মর্যাদাবান হওয়া। ১১. সর্বোপরি আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন করা।
তাকওয়া অর্জনের উপায় : পবিত্র কোরআনে যেসব জায়গায় তাকওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, তা শুধু মু’মিনদেরকেই উদ্দেশ্য করে বলা হয়েছে। কেননা, তাকওয়ার জন্য ঈমান পূর্বশর্ত। ঈমানবিহীন তাকওয়া বস্তুত তাকওয়াই নয় বরং ভণ্ডামী। ঈমানের সাথে সগীরা ও কবীরাসহ যাবতীয় গুনাহ থেকে অন্তরকে পবিত্র রাখার মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন সম্ভব। কারণ অন্তরের গুনাহই সমস্ত গুনাহের মূল। যেমন, রিয়া, নিফাক, অহংকার, লোভ, অন্যের উপর নিজের শ্রেষ্ঠত্ব প্রকাশ, ক্রোধ ইত্যাদি। নফসের চাহিদার বিরুদ্ধে নিজেকে সম্পূর্ণভাবে আল্লাহর উপর সোপর্দ করার মাধ্যমে তাকওয়া অর্জন করে এসব গুনাহ থেকে বিরত থাকার শক্তি অর্জিত হয়।
তাকওয়া ও মুত্তাকীদের চেনার আলামত : তাকওয়ার সবচেয়ে বড় আলামত হলো গুনাহের উপর কায়েম না থাকা। যারা মুক্তাকী তাদের থেকে ভুলক্রমে কোনো গুনাহ সংঘটিত হলে তাওবা না করা পর্যন্ত তাদের অন্তরে শান্তি হয় না। যেমন সাহাবায়ে কেরাম কোনো গুনাহ করলে সাথে সাথে রাসূল (সা.) এর দরবারে গিয়ে অকপটে অপরাধ স্বীকার করে তাওবা করে নিষ্পাপ হয়ে যেতেন। মদিনার জনৈক ফকীহ হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রা.) এর নিকট লিখেছেন যে, তাকওয়ার কতিপয় আলামত হচ্ছে, যা দ্বারা তাদেরকে চেনা যায়। যেমন-মুসিবতে ধৈর্য ধারণ করা, আল্লাহ হুকুমে সন্তুষ্ট থাকা, নেয়ামত প্রাপ্ত হয়ে শোকর করা, আল্লাহর আহকাম যথাযথ পালন করা এবং তার অনুগত হওয়া। (গুনিয়াতুত তালেবীন, পৃষ্ঠা-২৫৪)। কেউ কেউ বলেন, মানুষের তাকওয়া তিনটি বস্তু দ্বারা চেনা যায়। ১. যে বস্তু সে পাবে না এবং ঐ বস্তু পর্যন্ত পৌঁছতেও পারবে না এর উপর তাওয়াক্কুল করা। ২. যে বস্তু পেয়ে গেছে তার ওপর সন্তুষ্ট থাকা। ৩. যে বস্তু চলে গিয়েছে বা হাতছাড়া হয়ে গিয়েছে তার উপর সবর করা।
তাকওয়ার উপমা : হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মুবারক সম্পর্কে বর্ণিত আছে যে, তিনি সিরিয়ায় হাদিস লিখতে গিয়ে তার কলম ভেঙে গিয়েছিল। তিনি কোনো এক ব্যক্তি থেকে একটি কলম ধার নিলেন। কিন্তু কাজ সমাপ্ত হওয়ার পর কলম ফেরত দিতে ভুলে যান এবং সিরিয়া থেকে মরু পৌঁছে দেখেন কলম তার কাছে রয়ে গেছে। তিনি শুধু একটি কলম ফেরত দেওয়ার জন্য পুনরায় থেকে মরু থেকে সিরিয়া গিয়ে তা ফেরত দেন। (গুনিয়াতুত তালেবীন, পৃষ্ঠা-২৭১)। এভাবে ইমাম আবু হানিফা (রহ.) তার শরিকদারের নিকট ব্যবসার কাপড় প্রেরণ করেন যাতে একটি কাপড় ত্রুটিযুক্ত ছিল। তিনি শরিকদেরকে বলেছিলেন এই কাপড় বিক্রি করলে ত্রুটি উল্লেখ করবে। কিন্তু শরিকদার ত্রুটি উল্লেখ করতে ভুলে যান এবং ওই কাপড় বিক্রি করে দেন। আর কার কাছে বিক্রি করেছেন অর্থাৎ ক্রেতা কে তাও মনে ছিল না। ইমাম সাহেব যখন এ ব্যাপারে অবহিত হলেন, তখন ঔ দিনে বিক্রিত যাবতীয় মূল্য তিনি সদকা করে দিলেন যার তৎকালীন মূল্য ছিল ত্রিশ হাজার দিরহাম। (আল খায়রাতুল হিসান, পৃষ্ঠা-৯৮)।
পরিসমাপ্তি : তাকওয়া মানব জীবনের অমূল্য সম্পদ। তাকওয়া মানুষের আখলাককে সংশোধন করে। মু’মিনের ঈমানকে মজবুত করে। কিন্তু অতীব দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বর্তমানে মুসলমানদের মধ্যে সর্বোচ্চ তাকওয়া তো দূরের কথা সর্বনিম্ন তাকওয়াও পরিলক্ষিত হচ্ছে না বিধায় মুসলমানদের আজকের এ করুণ অবস্থা। তাই, আসুন আমরা ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে এককথায় জীবনের সর্বক্ষেত্রে তাকওয়া ভিত্তিক জীবন পরিচালিত করে মুসলমানদের হারিয়ে যাওয়া অতীত ফিরে এনে বর্তমান পৃথিবীকে স্বর্গরাজ্যে পরিণত করি। আল্লাহ তাআলা সহায় হোন এবং আমাদের তৌফীক দান করুন, আমিন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন