বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

পুঁজিবাজারের বিকাশে ব্যাংকে সুশাসন জরুরি

গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা

অর্থনৈতিক রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ১৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

নিয়ন্ত্রকসংস্থাগুলোর মধ্যে আরও সমন্বয় জরুরি
এক বছরের মধ্যে ভালো কিছু কোম্পানি আসবে
বহুজাতিক কোম্পানিকে তালিকাভুক্তিতে বাধ্য করতে হবে
বইয়ের লেখা দিয়ে শেয়ারবাজার চলে না

অর্থনীতির তুলনায় পিছিয়ে রয়েছে দেশের পুঁিজবাজার। এখাতের নাম শুনলেই মানুষ ভয় পায়। আর সম্ভাবনাময় এ খাতটির বিকাশে প্রধান বাধাঁ মুদ্রাবাজারে (ব্যাংক) সুশাসনের অভাব। ব্যাংক থেকে টাকা নিলে ফেরত না দিয়ে পার পাওয়া যায়। ফলে উদ্যোক্তারা পুঁিজর জন্য এখানে আসতে চায় না। গতকাল শনিবার রাজধানীর হোটেল ওয়েস্টিনে পুঁজিবাজার বিষয়ক এক গোলটেবিল বৈঠকে বক্তারা এসব কথা বলেন। ক্যাপিটাল মার্কেট জার্নালিস্টস ফোরাম (সিএমজেএফ) ও বাংলাদেশ মার্চেন্ট ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিএমবিএ) যৌথভাবে এ বৈঠকের আয়োজন করে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম। তিনি বলেন, অনেক কিছু বইয়ে লেখা আছে, কিন্তু বাস্তবায়ন কঠিন। এ সময়ে তিনি জানান, আগামী এক বছরের মধ্যে বাজারে কিছু ভালো কোম্পানি আসবে। এছাড়াও পরিচালনায় গতি আনতে সরকারি কোম্পানির পর্ষদ ভেঙ্গে দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
অনুষ্ঠানে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন পুঁজিবাজার স্থিতিশীল তহবিলের চেয়ারম্যান ও সাবেক মূখ্য সচিব নজিবুর রহমান, বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী, ড. এম খায়রুল হোসেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সদস্য মো. জাহিদ হাসান, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ড. মো. এজাজুল ইসলাম, অর্থনীতিবিদ প্রফেসর আবু আহমেদ, ড. হেলাল উদ্দিন, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) ইউনূসুর রহমান, চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান আসিফ ইব্রাহিম, আইসিএবি কাউন্সিল সদস্য গোপাল চন্দ্র ঘোষ, এসেট ম্যানেজমেন্ট কোম্পানিজ এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান ড. হাসান ইমাম এবং ডিএসই ব্রোকারেজ এসোসিয়েশনের সভাপতি রিচার্ড ডি রোজারিও। সিএমজেএফের সভাপতি জিয়াউর রহমানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে উদ্ধোধনী বক্তব্য রাখেন বিএমবিএ’র সভাপতি ছায়েদুর রহমান।
বক্তাদের মতে, নিয়ন্ত্রকসংস্থাগুলোর মধ্যে আরও সমন্বয় জরুরি। শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলাম বলেন, বাংলাদেশের পুঁিজবাজার নিয়ে বিশ্লেষকরা উন্নত দেশের সঙ্গে তুলনা করেন। কিন্তু ওই দেশে ঋণ ও সঞ্চয়ের সুদ হার ১ থেকে ৪ শতাংশের মধ্যে। জাপানে কেউ ব্যাংকে টাকা রাখলে, তার অর্থ কেটে রাখা হয়। ঋণ নিলে সুদ দশমিক ৫ থেকে ১ শতাংশ। সেখানে মানুষ ভালো লভ্যাংশ পাওয়ার আসায় শেয়ারবাজারে যায়। কিন্তু আমাদের দেশে অবস্থা উল্টো। এখানে আমানতের সুদ ৭ শতাংশের কাছে। ঋণের সুদ ৯ শতাংশ। মূল্যস্ফীতিও ৬ শতাংশের কাছে। ফলে মানুষ শেয়ারবাজারে যেতে চায় না।
তিনি বলেন, ভারতে ৪০ কোম্পানির শেয়ারের দাম ফেসভ্যালুর নিচে। কিন্তু আপনারা বাংলাদেশের সঙ্গে তুলনা করে দেখেন, কয়টা কোম্পানি বন্ধ হচ্ছে, কয়টা কোম্পানি মার্কেট থেকে বিদায় নিয়েছে। তিনি বলেন, সমালোচনা করতে হবে ভালোর জন্য। কিন্তু তার আগে বাস্তবতা বুঝতে হবে। বিএসইসির চেয়ারম্যান বলেন, যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলাম, তখন একভাবে চিন্তা করতাম। আর যখন মাঠে এসেছি, দেখছি, বইয়ে লেখা নিয়মকানুন সব জায়গায় পালন করা যায় না। বাস্তবতার নিরিখে অনেক সিদ্ধান্ত নিতে হয়। আমি অনেক কিছুই চাই করতে। কিন্তু সম্ভব নয়। কারণ অনেক কিছুই প্রস্তুত না।
প্রফেসর শিবলী রুবাইয়াত বলেন, সরকারি কোম্পানি তার্লিকাভুক্তি নিয়ে কথা আসছে। অর্থমন্ত্রী চাচ্ছেন, কোম্পানি বাজারে আনতে। কিন্তু কোম্পানিগুলোর বোর্ড চায় না। তারমতে, পরিচালনায় গতিশীলতা আনতে এসব কোম্পানির বোর্ড ভেঙ্গে দেওয়া উচিত। তিনি বলেন, আমরা নতুন পণ্য চালু করতে চাই। কিন্তু দক্ষ লোকের খুবই অভাব। তবে তিনি বলেন, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ প্রস্তুত থাকলে এই মাসেই সরকারি সিকিউরিটিজ চালু হবে। এরফলে বাজারমূলধন জিডিপির ২৫ শতাংশে চলে যাবে। বিএসইসির চেয়ারম্যান বলেন, বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর যেভাবে সহযোগিতা করছে, তাতে কিছু দিনের মধ্যেই আমরা বন্ড মার্কেট শক্তিশালী দেখবো।
বিএসইসির চেয়ারম্যান আরও বলেন, একজন জুয়াড়ি ধরতে ছয় মাস থেকে এক বছর সময় লাগে। স্টক এক্সচেঞ্জ তদন্ত রিপোর্ট দ্রুত দিলে আমরা তাদেরকে ধরতে পারি। তারপর নিয়ম অনুসারে তথ্য প্রমাণ যাচাই-বাছাই করে শাস্তি দিতে ৬ মাস থেকে ১ বছর সময় লেগে যায়। ততক্ষণে বিনিয়োগকারী ও বাজারের যা ক্ষতি করার তা করে ফেলে। তিনি বলেন, পুঁজিবাজারের যে কোনো বিষয়ে অর্থমন্ত্রণালয়, মন্ত্রী এমনকি প্রধানমন্ত্রী সব সময় সচেতন। বিএসইসির চেয়ারম্যান বলেন, নতুন করে কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে আমরা গত ২ বছর ৩৬টি কোম্পানির আইপিও দিয়েছি। এই সময়ে ৩ হাজার ২৪০জন মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।
ফারুক আহমেদ সিদ্দিকী বলেন, বাংলাদেশের শেয়ারবাজার ভালোভাবে কাজ করছে না। কারণ শিল্পায়নে ৯০ শতাংশ পুঁিজ ব্যাংক থেকে আসে। ব্যাংকগুলো দীর্ঘমেয়াদী অর্থায়ন করছে। এরপর ঋণ খেলাপি বাড়ছে। সেই ঋণ আবার অবলোপন হচ্ছে। কোম্পানি ভালো ঋণ দেওয়ার জন্য ব্যাংক বাসায় চলে যায়। ফলে শেয়ারবাজারের বিকাশে ব্যাংকে সুশাসন জরুরি। তিনি বলেন, আরেকটি সমস্যা হলো এখানে ভালো কোম্পানি কম। এই কোম্পানি বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে অনেকে প্রণোদনা বাড়ানোর কথা বলছেন। এরমধ্যে তালিকাভুক্ত ও বর্হিভুত কোম্পানির করের পার্থক্য বাড়ানো অন্যতম। কিন্তু পার্থক্য বাড়ালেও কোম্পানি আসবে না। মূল কথা বাংলাদেশে নিয়ন্ত্রকসংস্থাগুলোর মধ্যে আইন বাস্তবায়নের সক্ষমতা কম। এই সক্ষমতা বাড়াতে হবে।
ড. এম খায়ররুল হোসেন বলেন, বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মতো আচরণ করে। এখানে যাতে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে তাদেরকে আরও সুবিধা দেওয়া যেতে পারে। কিন্তু লাভ হলেই একসঙ্গে সব বিক্রি করে দেওয়া ঠিক নয়। তিনি বলেন, শেয়ারবাজারে অনেকগুলো দূর্বলতা আছে। আমাদের জিডিপির তুলনায় বাজার মূলধন অনেক কম। শিল্পায়নে ব্যাংকের তুলনায় শেয়ারবাজার থেকে কম অর্থায়ন হয়। কাঙ্খিত বিদেশি বিনিয়োগ নেই। এগুলো নিয়ে কাজ করার সুযোগ আছে। তারমতে, একটি দেশের শেয়ারবাজারের উন্নয়নে ১০-১২টি বিষয়ের দরকার আছে। এরমধ্যে আইন কানুন অন্যতম। আর আইন কানুন আমাদের আছে। এছাড়া সরকার সহযোগিতা করছে।
তিনি বলেন, ভালো কোম্পানি বাজারে আসছে না। এজন্য অনেকগুলো কারণ আছে। উদ্যোক্তাদের মধ্যে শেয়ারবাজার নিয়ে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। কারণ তাদের ধারণা এই বাজারে গেলে অনেক সমস্যার সম্মুখীন হতে হবে। দ্বিতীয়ত ব্যাংক থেকে সহজেই দীর্ঘমেয়াদি ঋণ পাওয়া যায়। কোনো কোনো এক্ষেত্রে এগুলো পরিশোধ করতে হয় না। এছাড়া তালিকাভুক্ত ও অতালিকাভুক্ত কোম্পানির মধ্যে কর হার ব্যবধান কম। তিনি আরও বলেন, নিজের পুঁিজর সুরক্ষা বিনিয়োগকারীকেই দিতে হবে। তিনি আরও বলেন, পৃথিবীর কোথাও নিয়ন্ত্রকসংস্থা আইপিওর দর নির্ধারণ করে না। কোম্পানি, মার্চেন্ট ব্যাংক ও প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীরা দাম নির্ধারণ করে।
বিএসইসির এই সাবেক চেয়ারম্যান বলেন, শেয়ারবাজারের উন্নয়নে নিয়ন্ত্রকসংস্থার মধ্যে সমন্বয় দরকার। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক, এনবিআর, আইডিআরএ, বিটিআরসি, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনসহ যে সমস্ত প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণাধীন কোম্পানি তালিকাভুক্ত হয়, সে সব নিয়ন্ত্রকসংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করতে হবে। দেশে প্রথমবার ২০২০ সালে ফ্লোর প্রাইস (দাম কমার নিন্মসীমা) হয়েছে। কারণ ওই বছরের শুরুতে করোনা পরিস্থিতির কারণে বাজারে অনাকাঙ্খিত অবস্থার সৃষ্টি হয়। এরপর বিনিয়োগকারীদের সুরক্ষায় ফ্লোর প্রাইস দেওয়া হয়। খায়রুল হোসেন কোম্পানির শেয়ারের দর নিয়ে অনেকে প্রশ্ন তোলেন। কিন্তু বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, এমনকি ভারতেও ৪০ শতাংশ শেয়ারের দাপম অভিহিত মূল্যের নিচে। আর বাংলাদেশে এই মুহুর্তে ১০ শতাংশের বেশি শেয়ার অভিহিত মূল্যের নিচে পাবেন না। বর্তমানে যে সব কোম্পানির শেয়ারের দাম ইস্যু মূল্যের নিচে আছে, সেগেুলো নিরীক্ষক সার্টিফাইড করে দিয়েছে। তারপরেও অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে নন-কমপ¬ায়েন্স কোম্পানির সংখ্যা কম।
অনুষ্ঠানে পুঁজিবাজার বিশে¬ষক প্রফেসর আবু আহমেদ বলেন, বহুজাতিক কোম্পানি বাজারে আসতে বাধ্য করতে হবে। কারণ ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো কত টাকা ট্যাক্স দেয় এটা সবাই জানে। কারণ তারা পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত। তাদের আর্থিক প্রতিবেদন প্রকাশ করতে হয়। কিন্তু ইউনিলিভার ও নেসলে বাংলাদেশে দাপটের সঙ্গে ব্যবসা করে যাচ্ছে। তারা কত টাকা ট্যাক্স দেয় তা কেউ জানে না। কারণ তারা তালিকাভুক্ত নয়। তিনি ইউনিলিভারের সাবান লাক্স, নেসলের নুডলুস কিনছি, তারা ব্যবসা করে নিয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আমাদের মালিকানা দিচ্ছে না। তারা কেন তালিকাভুক্ত হচ্ছে না।
তিনি বলেন, ‘আমরা যখন বোম্বে স্টক এক্সচেঞ্জের দিকে দেখি তখন টপ টেনে (শীর্ষ ১০) ইউনিলিভার ও নেসলে থাকে। তাহলে আমাদের এখানে নেই কেন? ১৭ কোটি মানুষকে কি তারা মূর্খ মনে করে? এই প্রশ্নের জবাব জানতে হবে। অনুষ্ঠানে মূলপ্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিএমবিএ’র নেতা মনিরুজ্জামান। আরও উপস্থিত ছিলেন সিএমজেএফের সাধারণ সম্পাদক আবু আলী ও বিএমবিএ’র সাধারণ সম্পাদক রিয়াদ মতিন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন