ইউক্রেন যুদ্ধকে ঘিরে রাশিয়ার সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সামরিক দ্ব›দ্ব বিশ্বব্যবস্থাকে এক জটিল সমীকরণের দিকে ঠেলে দিয়েছে। একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলো, অন্যদিকে রাশিয়া-চীনসহ মধ্য এশিয়ার দেশগুলোর সাথে বাণিজ্য, জ্বালানি নিরাপত্তা, মূদ্রাব্যবস্থা ও জাতীয় নিরাপত্তার প্রশ্নে ছোটবড় দেশগুলো যার যার অবস্থান পরিষ্কার করতে বাধ্য হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার বড় অর্থনৈতিক শক্তি হিসেবে প্রতিবেশী ভারতের যুক্তরাষ্ট্রের সাথে কৌশলগত সম্পর্ক থাকা সত্তে¡ও একটি ভারসাম্যপূর্ণ সমঝোতামূলক অবস্থান ধরে রাখার চেষ্টা করছে। সম্প্রতি ইউক্রেনের খারকিভ এলাকায় রাশিয়ান বাহিনী বড় ধরণের প্রতিরোধের মুখে পিছু হটার পর ভারতকে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবের মত একটি মধ্যস্থতাকারির ভূমিকায় দেখা গেছে। যদিও রাশিয়া বা পশ্চিমাদের তরফ থেকে এ প্রস্তাবের কোনে গুরুত্ব পায়নি। তবে এই যুদ্ধে ইউক্রেনীয় বাহিনী মার্কিনী ও পশ্চিমাদের প্রক্সি হিসেবে পরিগণিত হওয়ায় যুদ্ধে ইউক্রেনীয়দের বড় প্রতিরোধ রাশিয়াকে আরো আক্রমণাত্মক ও বড় শক্তি প্রয়োগের দিকে ঠেলে দিতে পারে। ইতিমধ্যে সাংহাই কোঅপারেশন চুক্তির আওতায় রাশিয়া ও চীনের মধ্যে পুরনো ঐক্য নতুন কমিটমেন্টে উপনীত হতে দেখা যাচ্ছে। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, এই যুদ্ধে ইউক্রেনের বিজয়ী হওয়ার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। চীন-মার্কিন-রাশিয়ান ভূরাজনৈতিক-অর্থনৈতিক দ্ব›েদ্ব ভারত বড় কোনো ফ্যাক্টর হয়ে উঠতে পারছেনা। তাকে অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে একই সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রেখে চলতে হচ্ছে। বাংলাদেশের জন্যও অভিন্ন বাস্তবতা হলেও বাংলাদেশের বাণিজ্য, অর্থনীতি ও কূটনৈতিক স্বাধীনতা যেন দেশের সরকার ও জনগণের কাছ থেকে হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশে নিত্যপণ্যের মূল্য এবং সামাজিক বাস্তবতায় বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে ভারত নির্ভরতার কুফল একটি বড় ফ্যাক্টর হয়ে দেখা দিয়েছে। সেখানে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনার পাশাপাশি দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে পারস্পরিক বোঝাপড়া ও সম্মানজনক অবস্থান নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন, সেখানে ক্রমবর্ধমান ভারত নির্ভরতা আমাদেরকে বড় ধরণের সংকটের দিকে ঠেলে দিতে পারে। বৈশ্বিক-আঞ্চলিক বাস্তবতায় তেমন আলামত এখন আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। চীনের সাথে ভারতের বড় ধরণের ভূরাজনৈতিক স্বার্থদ্ব›দ্ব থাকলেও রোহিঙ্গার উপর মিয়ানমার বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘন, গণহত্যা এবং বাংলাদেশে রোহিঙ্গা রিজিউজি সংকট প্রশ্নে ভারতের ভূমিকা থেকে বোঝা যায়, বাংলাদেশের জন্য ভারত ন্যূনতম ঝুঁকি গ্রহণ করতেও প্রস্তুত নয়। রোহিঙ্গাদের মানবাধিকারের প্রশ্নে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক আদালতে পশ্চিমা দেশগুলো ইতিবাচক ভূমিকা রাখলেও চীনের পাশাপাশি ভারত এ ক্ষেত্রে রোহিঙ্গা জাতি ও বাংলাদেশের স্বার্থ বিরোধি ভূমিকা পালন করে চলেছে।
চলমান বিশ্বব্যবস্থায় বাংলাদেশের জন্য হয়তো আরো কিছুদিন ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান বজায় রাখার সুযোগ থাকলেও অতিমাত্রায় ভারত নির্ভরতা আমাদের জন্য বড় ধরনের সামাজিক-অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণ হয়ে দেখা দিতে পারে। আন্তর্জাতিক পানিসীমা, আন্তর্জাতিক নদীর পানিবন্টনের মত ইস্যুগুলোতে ভারতের সাথে দ্বিপাক্ষিক উপায়ে সমাধানের নীতি ইতিমধ্যেই অকার্যকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। বাংলাদেশের সাথে চুয়ান্নটি অভিন্ন নদীর পানি বন্টনের ইস্যু ভারত ৫০ বছর ধরে জিইয়ে রেখেছে। বাংলাদেশের সাথে চুক্তি বা সমঝোতা ছাড়াই গঙ্গার উপর বাঁধ নির্মাণ ও পানি প্রত্যাহার করে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান নদী পদ্মা ও এর শাখা নদীগুলোকে অস্তিত্বের সংকটে ঠেলে দিয়েছে ভারত। ফারাক্কা বাঁধ চালুর ২১ বছর পর গঙ্গার পানিচুক্তির নামে গ্যারান্টি ক্লজবিহীন একটি চুক্তি হলেও সে চুক্তি অনুসারে বাংলাদেশ কখনো পানি পায়নি। ভাটির দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বাংলাদেশকে বঞ্চিত রেখে দেশকে মরুময় করে তোলা, কৃষিব্যবস্থা, পরিবেশগত ও খাদ্য নিরাপত্তাকে হুমকির সম্মুখীন করাই যেন ভারতীয়দের অভিসন্ধী। শীত-বর্ষায় পানি প্রবাহে ব্যাপক তারতম্য খরা-বন্যাসহ নদী ও মানুষের জীবনযাত্রায় প্রত্যক্ষ প্রভাবের কারণে যেখানে বছরে একাধিকবার যৌথ নদী কমিশনের (জেআরসি) বৈঠক হওয়ার কথা, সেখানে ভারতের অনীহায় এক দশকের বেশি সময়ে জেআরসির একটি বৈঠকও অনুষ্ঠিত হয়নি। বছরের পর বছর ধরে বাংলাদেশ তিস্তার পানি বন্টন চুক্তির জন্য ভারতের কাছে ধর্ণা দিলেও নানা টালবাহানা ও আঞ্চলিক-প্রাদেশিক ওজর আপত্তি খাড়া করে তা অগ্রাহ্য করে চলেছে। প্রায় ১১ বছর পর ভারতের আগ্রহে অনুষ্ঠিত সাম্প্রতিক জেআরসি বৈঠকে গঙ্গার পানিচুক্তির সুষম বাস্তবায়ন বা তিস্তা প্রসঙ্গে কোনো আলোচনা না হলেও ভারতের চাপিয়ে দেয়া কুশিয়ারা নদী থেকে ১৫৩ কিউসেক পানি প্রত্যাহার প্রশ্নে বাংলাদেশকে একটি অযৌক্তিক সমঝোতা চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে বাধ্য করা হয়েছে। সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক ভার্চুয়াল সেমিনারে দেশের পানিবিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরে স্বাক্ষরিত ৭টি সমঝোতা স্মারকের মধ্যে কুশিয়ারা থেকে বাংলাদেশের পানি প্রত্যাহারে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের ঘটনাকে অনেক বড় বিভ্রান্তি বা ভুল সিদ্ধান্ত ও খারাপ দৃষ্টান্ত বলে আখ্যায়িত করেছেন বক্তারা। শুষ্ক মওসুমে সেচ সুবিধার জন্য কুশিয়ারা প্রবাহ থেকে সৃষ্ট রহিমপুর খালে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড ৬ কোটি টাকা ব্যয়ে একটি সেচপাম্প বসিয়েছিল। ২০১৬ সালে সেই পাম্প চালু করতে গেলে ভারতের বিএসএফ বাঁধা দেয়। সেই থেকে বন্ধ থাকা সেচপাম্পটি চালু করতে বাংলাদেশ কথিত কুশিয়ারার পানি প্রত্যাহার সম্পর্কিত সমঝোতা স্মারকে স্বাক্ষর করতে বাধ্য হয়েছে। আন্তর্জাতিক নদী আইনের কনভেনশন অনুসারে বাংলাদেশ ৫৪টি অভিন্ন নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা পাওয়ার হকদার। ভারত বহু দিন ধরেই একপাক্ষিকভাবে কুশিয়ারা থেকে পানি প্রত্যাহার করে আসছে। বাংলাদেশ সেখানে বাঁধা দেয়নি। বিশেষজ্ঞদের মতে ৫৪টি নদীর প্রবাহ ঠিক রাখতে চুক্তি হওয়া জরুরি হলেও এক কুশিয়ারার পানি প্রত্যাহারের সমঝোতা স্মারকে সই করে একটি খারাপ দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করল বাংলাদেশ।
ভারত সুপ্রতিবেশিসুলভ আচরণ করতে ব্যর্থ হওয়ার কারণে কোনো প্রতিবেশি দেশই ভারতের প্রতি আস্থা রাখতে পারছেনা। দু’বছর আগে চীনের সাথে সীমান্ত সংঘাতের সময় নেপাল-ভুটানের মত ক্ষুদ্র প্রতিবেশিরাও ভারতের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে দেখা গেছে। বিতর্কিত এলাকা কালাপানি, লিপুলেখ এলাকাকে ভারত নিজের মানচিত্রভুক্ত করে নতুন মানচিত্র প্রকাশের ৫ মাসের মাথায় ২০২০ সালের মে মাসে নেপাল কালাপানি ও লিপুলেখ এলাকাকে নিজের বলে দাবি করে তাদের নতুন রাজনৈতিক মানচিত্র প্রকাশ করে। চীনের সাথে বৈরিতা এবং নেপালের সাথে চীনের সীমান্ত থাকায় সম্ভবত নেপালের এই উদ্যোগের বিপরীতে ভারত কোনো শক্ত পদক্ষেপ নিতে পারেনি। বড় শক্তিগুলোর মধ্যকার স্বার্থদ্ব›েদ্ব ছোট দেশগুলোর অবস্থান এভাবেই শক্তির ভারসাম্য সৃষ্টি করে। যত কাছের প্রতিবেশি হোক না কেন, কোনো দেশের প্রতি একক নির্ভরশীলতা দেশের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। দক্ষিণ এশিয়ায় পারমানবিক শক্তিধর ভারতের পাশে চীন বা পাকিস্তানের বৈরী অবস্থান অন্য প্রতিবেশিদের জন্য অনেকটা নিরাপত্তামূলক ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান তৈরী করেছে। তবে সে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানকে কাজে লাগাতে দেশের সরকার এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো যথাযথ সময়োপযোগি ভূমিকা রাখতে না পারলে সুযোগ কোনো কাজে আসেনা। বাংলাদেশ কি এখন তেমন একটি পরিস্থিতির সম্মুখীন? এই প্রশ্ন এখন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। বৈশ্বিক ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শক্তি ও নীতিগত অবস্থানের একটি প্যারাডাইম শিফ্ট নিশ্চিত হওয়া সত্বেও বাংলাদেশ সরকারের ক্রমবর্ধমান ভারত নির্ভরতার নীতি দেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের বিস্মিত করছে। বাংলাদেশে যে পরিমান চাল এবং পেঁয়াজ উৎপাদিত হয় তা দেশের চাহিদার শতকরা ৯৫ ভাগের বেশি পূরণ হয়ে থাকে। ঘাটতি ৫ শতাংশের জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে আমদানি করা হলেও এর বেশিরভাগই আন্ত:সীমান্ত বাণিজ্যের মাধ্যমে ভারত থেকে আসে। এই স্বল্প ঘাটতি পুরণ করতে গিয়ে ভারতের যত্রতত্র শুল্ক আরোপ, নিষেধাজ্ঞার জেরে দেশে এক ধরণের মূল্য সন্ত্রাস চলতে দেখা যায়। জ্বালানি ও বিদ্যুতে ভারতের উপর নির্ভরশীলতা বাংলাদেশের উপর ভারতীয় নিয়ন্ত্রণ আরো জোরদার হবে এবং যে কোনো সময় বাংলাদেশ বড় ধরণের বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক: নদী, সীমান্ত ও বিদ্যুৎ’ শীর্ষক ভার্চুয়াল সেমিনারে বক্তারা ভারত থেকে বিদ্যুত আমদানি, ভারত থেকে পাইপলাইনে পেট্রোলিয়াম আমদানির মত সিদ্ধান্তের কঠোর সমালোচনা করেছেন। ভারত নিজেই মধ্যপ্রাচ্য ও রাশিয়া থেকে জ্বালানি আমদানি করে থাকে। বাংলাদেশও মধ্যপ্রাচ্য সরাসরি ক্রুডঅয়েল আমদানি করছে। রাশিয়াও কমদামে বাংলাদেশকে তেল কেনার প্রস্তাব দিয়েছে। মধ্যপ্রাচ্য ও রাশিয়ার মত বন্ধুপ্রতিম দেশগুলো থেকে জ্বালানি আমদানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে বেশি সুবিধা পেতে পারে। দেশে রিফাইনারি তৈরীর দেশি-বিদেশি প্রস্তাবও ঝুলে আছে। সেসব বিনিয়োগ প্রস্তাব অগ্রাহ্য করে ভারত থেকে বেশি দামে রিফাইন্ড পেট্রোলিয়াম আমদানি কার স্বার্থে? ক্রুড অয়েল আমদানি করে দেশে রিফাইন করলে প্রতি ব্যারেলে কমপক্ষে ১১ ডলার সাশ্রয় হবে বলে বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন। দেশে শিল্পায়ন ও নগরায়ণের প্রেক্ষাপটে বিদ্যুত ও জ্বালানির চাহিদা বহুগুণ বৃদ্ধি পেলেও পাকিস্তান আমলে প্রতিষ্ঠিত দেশের একমাত্র জ্বালানি তেল শোধনাগারটির সক্ষমতা বৃদ্ধি বা নতুন রিফাইনারি প্রতিষ্ঠার কোনো উদ্যোগ না নেয়ার নেপথ্য কারণ হতে পারে জ্বালানি খাতে দেশকে ভারতের উপর নির্ভরশীল রাখা।
বাংলাদেশ ভারত বা মিয়ানমারের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চায়। কিন্তু বন্ধুত্ব কখনো একপাক্ষিক বিষয় নয়। বাংলাদেশ যখন ভারতের প্রত্যাশামত সব দাবি পুরণ করেছে, ভারতের সাথে বাণিজ্য বৈষম বেড়ে চলেছে, লাখ লাখ ভারতীয় নাগরিক বৈধ-অবৈধভাবে বাংলাদেশের বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করে বছরে শত শত কোটি ডলার দেশে পাঠাচ্ছে, ভারত তখন অনৈতিকভাবে বাংলাদেশি পাটের উপর অ্যান্টিডাম্পিং ব্যারিয়ার চাপিয়েছে। বাংলাদেশের আভ্যন্তরীন নদী ফেনী নদী থেকে ভারত পানি প্রত্যাহার করলেও অভিন্ন তিস্তা নদীর উজানে বাঁধ দিয়ে পানিচুক্তির দাবি অগ্রাহ্য করছে। মিয়ানমারের জান্তা সরকারের গণহত্যা থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া দশ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে নিজদেশে ফেরত পাঠাতে গত ৫ বছরেও বাংলাদেশ কার্যত কিছুই করতে পারেনি। জাতিসংঘের তরফ থেকে রোহিঙ্গা গণহত্যাকে টেক্সটবুক এগজাম্পল বলা হয়েছে। পশ্চিমা আফ্রিকার ক্ষুদ্র দেশ গাম্বিয়া রোহিঙ্গা গণহত্যাকে চ্যালেঞ্জ করে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে মামলা করলেও বাংলাদেশ যেন সেখানেও নীরব দর্শকের ভূমিকাই পালন করে চলেছে। জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো রোহিঙ্গাদের অধিকারের প্রশ্নে সোচ্চার থাকলেও বাংলাদেশ সরকারের এহেন নিরবতা ও নতজানু নীতির কারণে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন কোনো গতি পাচ্ছেনা। উপরন্তু, নতুন করে রাখাইন থেকে অবশিষ্ট রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঠেলে দিতে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বাংলাদেশ সীমান্তে উস্কানিমূলক তৎপরতা চালাচ্ছে মিয়ানমার বাহিনী। এমনিতে মিয়ানমার আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আনুকুল্য থেকে বিচ্ছিন্ন হলেও বাংলাদেশের উপর আগ্রাসী হয়ে ওঠার নেপথ্যে আঞ্চলিক শক্তির কুশীলবদের নেপথ্য ভূমিকা থাকতে পারে বলে বলে নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা মনে করছেন। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষি বাহিনী বাংলাদেশ সীমান্তে স্থল ও আকাশসীমা লঙ্ঘণ, গোলাগুলি করে মানুষ হত্যা, মর্টারসেল নিক্ষেপ, স্থলমাইন স্থাপনসহ সব রকমের উস্কানিমূলক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ মিয়ানমারের উস্কানির সমুচিত জবাব দিচ্ছে না। তারা নাকি ফাঁদে পা দিতে চায়না। আড়াইহাজার বছর আগে চীনা সমরবিদ সান জুর যুদ্ধনীতি এখনো বিশ্বের সামরিক নীতিনির্ধারকরা মেনে চলেন। তিনি শান্তির সময়ে প্রয়োজনে যুদ্ধের প্রস্তুতি এবং যুদ্ধের সময় শান্তির সুযোগ কাজে লাগাতে প্রস্তুত থাকার কথা বলেছিলেন। আন্ত:রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে যুদ্ধ কিংবা শান্তি কখনো একপাক্ষিক হতে পারেনা। বাংলাদেশ মিয়ানমারের উস্কানির ফাঁদে পা না দেয়া মানে কি এই নয় যে, মিয়ানমারের পশে বাংলাদেশ নিজের সামরিক সামর্থ্যকে দুর্বল মনে করছে? রাখাইনের রোহিঙ্গা মুসলমানদের নাগরিকত্বহীন করে বাংলাদেশে ঠেলে দিতে বার্মার সামরিক সরকারের পরিকল্পনা বহু পুরনো। অং সান সুচির কাছে বিশ্বসম্প্রদায়ের প্রত্যাশা ছিল তার নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত গণতান্ত্রিক সরকার মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের নাগরিক অধিকার ফিরিয়ে দিয়ে সেখানে শান্তি প্রতিষ্ঠা করবে। তিনি কথা রাখেননি। সেখানে আবারো সামরিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ওরা দেশের অভ্যন্তরে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সামলাতে না পেরে বাংলাদেশ সীমান্তে আবারো রোহিঙ্গাদের ঠেলে দেয়ার চক্রান্ত করছে। মিয়ানমারের সাথে চীন, ভারত, থাইল্যান্ড, লাওস ও বাংলাদেশের সীমান্ত রয়েছে। এদের মধ্যে লাওস ছাড়া বাকি দেশগুলোর সাথে হাজার হাজার কিলোমিটার সীমান্ত থাকলেও চীন, থাইল্যান্ড বা ভারত সীমান্তে মিয়ানমার বাহিনীর হেলিকপ্টার বা যুদ্ধবিমানের আকাশসীমা লঙ্ঘন বা সেখান থেকে ছোড়া গোলাগুলিতে অন্যদেশের মানুষ হতাহতের ঘটনার কোনো সংবাদ প্রকাশিত হয়নি।
ভারত সীমান্তে বিএসএফ’র গুলিতে বাংলাদেশিদের হত্যার ঘটনা, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা সংকট বা সেখানকার নিরাপত্তা বাহিনীর সীমালঙ্ঘনের ঘটনাগুলো নিছক দুর্ঘটনা নয়। এসব রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত ভূরাজনৈতিক কৌশলের অংশ। শতকরা ৯৯ ভাগ বাংলাভাষি, শতকরা ৯০ ভাগ মুসলমান ও অভিন্ন ভাষা-সংস্কৃতির অগ্রসরমান অর্থনৈতিক শক্তি বাংলাদেশকে দাবিয়ে রাখার জন্য এখানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে নস্যাৎ করে আভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ও অর্থনৈতিক লুণ্ঠন-অর্থপাচারের বল্গাহীন তৎপরতাকে ইন্ধন দেয়ার নেপথ্যে আধিপত্যবাদী শক্তির গোপণ দূরভিসন্ধি থাকা স্বাভাবিক। মিয়ানমারে চীনের বিশাল বিনিয়োগ ও ভূরাজনৈতিক স্বার্থ রয়েছে। কিন্তু পশ্চিমা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত মিয়ানমারের সাথে ভারতের গোপণ সমঝোতার বিষয়টিও এখন অনেকটা স্পষ্ট। বাংলাদেশ কারো সাথে যুদ্ধ চায় না। পূর্ব দিকে বিশ্বের সাথে কানেক্টিভিটির নতুন সরণী গড়ে তুলতে মিয়ানমারের সাথে সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী। রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধানের মধ্য দিয়েই সে লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব। নানা ভাবভঙ্গিমায় বোঝা যাচ্ছে, ভারত তা চাইছে না। ভারত বাংলাদেশকে তার বাণিজ্য ও রেমিটেন্সের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার মনে করে। ভারতের এসব স্বার্থ টিকিয়ে রাখতে বাংলাদেশকে কিছুই দিতে হয়না। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও জনগণের শাসন প্রতিষ্ঠিত হলে এ অবস্থার পরিবর্তন অবশ্যম্ভাবি। ভারত বা মিয়ানমারের মত দেশের সাথে ভারসাম্যপূর্ণ বন্ধুত্ব ও মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানসহ শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও উন্নয়ন অংশীদারিত্ব নিশ্চিত করতে হলে প্রথমে বাংলাদেশকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তন করতে হবে। ঐক্যবদ্ধ, স্থিতিশীল ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশকে ঠেকিয়ে রাখার সাধ্য এসব প্রতিবেশিদের নেই।
bari_zamal@yahoo.com
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন