সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীন রহ. আচক নারায়ণের রাজধানীতে সৈন্য সামন্ত নিয়ে পথিমধ্যে হবিগঞ্জের এর উচাইল নামক স্থানে রাত্রি যাপন করেন, রাত্রি যাপন শেষে সকালে স্থানিয় লোকজনের নিকট যাত্রা শুরুর আগে আচক নারায়ণের রাজধানির কথা লোকজনের কাছে জানতে চাইলে তারা রাস্তা দেখিয়ে দিয়ে বলে ইস তরফ মে যাও, সেই থেকে এই এলাকা তরফ নামে পরিচিত বলে জানা যায়। হবিগঞ্জের খোয়াই নদীর তীরে বিষগায়ে তরপ রাজ্যের রাজধানী ছিল। অবশ্য এর নাম বিষগাও ছিল না। সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীন রহ. এর সৈন্যগণ দ্বারা রাজধানীর পতন হওয়ার কিছু দিনের মধ্যেই ব্যাপক হাড়ে সৈন্যগণ পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছিল বিধায় স্থানটির নাম হয়ে যায় বিষগাও। ঢাকা সিলেট মহা সড়কের শায়েস্তাগঞ্জ বাস ষ্টেশান থেকে ১০ মিনিটেই সিএনজিতে বিষগায় যাওয়া যায়।
তরপের শাসনকর্তা ছিল আচক নারায়ণ। তিনি একজন মুসলীম বিদ্বেষী হিন্দু রাজা হিসেবেই পরিচিত।
গৌড় গেবিন্দের মতই সে নিজেকে মহা শক্তিধর পরাক্রমশালী মনে করত। তাকে পরাজিত করার শক্তি-সামর্থ নেই কোন রাজা বা কোন শক্তির এ কথা গর্ব করে সে বলে বেড়াত। সে রাজ্যময় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। রাজ্যের মুসলমান প্রজাদের কে নানা ভাবে অত্যাচার অবিচার করত এমনকি ধর্মকাজেও বাধা দিত নানা ভাবে। তার রাজ্যে নুরুদ্দীন নামে একজন ধর্মপ্রাণ মুসলমান তার ছেলের বিবাহ উপলক্ষে একটি গরু জবেহ করেছিল। গরু জবেহ এর অপরাধে পাপিষ্ট আচক নারায়ণ নুরুদ্দীন কে প্রাণ দন্ড দিয়েছিল।
সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীন রহ. যখন সৈন্য দল নিয়ে তরপ রাজ্যে প্রবেশ করেন তখন এ সংবাদ আচক নারায়নের নিকট পৌছে। ইতিমধ্যে আচক নারায়ন গৌড় গোবিন্দের পরাজয়ের সংবাদে বিচলিত হয়ে পড়েছিল। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তার অশিক্ষিত সৈন্যগন সুশিক্ষিত পাঠান সৈন্যগনের সাথে পেরে উঠবে না। এতে শুধু প্রাণই ক্ষয় হবে মাত্র। এমতাবস্তায় তিনি সন্ধি স্থাপনই কর্তব্য মনে করে তিনি সন্ধীর প্রস্তাব দিলেন, এতেও কোন সুফল হল না। কাজী নুরুদ্দীনের রক্তের বিনিময়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে হবে অথবা যুদ্ধ করতে হবে। এই প্রত্তোত্তর পেয়ে নিরাশচিত্তে রাজধানী পরিত্যাগ পূর্বক পরিবার বর্গসহ ত্রিপুরায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। ত্রিপুরার রাজা বিপন্ন আচক নারায়ণকে আশ্রয় প্রদান করলেও তার সৈন্যের সাথে পক্ষাবলম্বন পূর্বক যুদ্ধে লিপ্ত হলেন না। ইতিহাসে আছে যে, ত্রিপুরায় অবস্থান করা নিরাপদ হবে না ভেবে তিনি তথা হতে মথুরা তীর্থে গমন করেন। সে স্থানেই তার মৃত্যু হয়। তরপ রাজ্য মুসলমানদের আয়ত্বে আসে। সৈয়দ নাসির উদ্দীন রহ. তরপের রাজধানী বিষগাঁও থেকে লস্করপুরে স্থানান্তরিত করেন। লস্করপুরে ইসলামের বিজয় নিশান উড়িয়ে দিয়ে তড়প রাজ্যে ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠা করেন।
আধ্ম্যাতিক রাজধানী মোড়ারবন্ধ : সৈয়দ নাসির উদ্দীন রহ. তার মূলক তরপ রাজ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠার পর,তরপ রাজ্যের দায়িত্যভার তার সন্তানদের হাতে অর্পণ করে, একান্তভাবে আল্লাহর এবাদতে মশগুল হওয়ার লক্ষ্ েখরস্রোতা খোয়াই নদীর পারে মোড়ারবন্দ নামক স্থানে তিনি একান্ত নিরবে আল্লাহর সান্নিধ্য অর্জনের জন্য ধ্যানমগ্ন হয়ে নিরবে একা একা দিন গুজরান করতেন । এখনো ঐ এলাকা নিরব-নিথর,সাতশত বছর আগে ঐ এলাকা কেমন ছিল চিন্তাই করা যায় না। যানা যায় তিনদিন, সাতদিন, চল্লিশ দিন চিল্লায় তিনি ধ্যান মগ্ন থাকতেন,প্রয়োজনে (এসতেঞ্জার জন্য) বেড়িয়ে আসতেন।
এমনি ভাবে কিছুদিন পার হওয়ার পর তিনি অনুভব করলেন, হয়ত তিনি আর বেশি দিন বাঁচবেন না তাই তিনি তার সহযোদ্ধা হযরত শাহ জালাল রহ.এর নিকট হতে শেষ সাক্ষাত নেয়ার উদ্দেশ্যে সিলেট গমন করেন। সেখানে তারা দুজন পরস্পরের সাথে মতবিনিময়ে বহু দিনের স্মৃতি মন্থন করেন। সিপাহসালার সৈয়দ নাসিরুদ্দীন রহ. রাজদন্ড হাতে নিয়ে সিলেট বিজয়ের উদ্দেশ্যে এসেছিলেন,তথাপি চলনে-ফিরনে উনার কোনো আমিত্ব বোধ ছিলনা, নবী বংশের বিনয়ী স্বভাব ছিল তার স্বভাবজাত।শাহজালাল রহ.ছিলেন উনার বয়োজেষ্ঠ, তাই তিনি তাকে খুবই সমীহ করতেন। এছাড়া দিল্লী থেকে সিলেট, সিলেট থেকে তরফ এই সময়ের মাঝে সিপাহসালারের বুজুর্গী বা কারামত ছিল জীবন্ত।
হযরত শাহ জালাল রহ.এর সাথে শেষ সাক্ষাতে এসে তাকে অনুরোধ করে বললেন তার মৃত্যুর পর যেন তার লাশ আদিনা মসজিদে রাখা হয়। তদানুযায়ি সৈয়দ নাসির উদ্দীন রহ. এর মৃত্যুর পর তার অসিয়তানুযায়ী তাকে আদিনা মসজিদে রাখা হয় এবং দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়। এদিকে চৌকি দেখি নামক স্থানে সৈয়দ নাসির উদ্দীন রহ. কে কবরস্থ করার জন্য কবর খনন করা হয়। লাশ আনার জন্য যখন আদিনা মসজিদের দরজা খোলা হয় তখন সেখানে তার লাশ পাওয়া যায়নি। শেষ পর্যন্ত তার লাশ ধারনকারী চৌকিটি নিয়ে কবরে দিয়ে মাটি চাপা দেয়া হয়। সে থেকেই সে স্থানের নাম চৌকি দেখি।
অপর দিকে রাতের বেলায় শুন্য আকাশে উড়ে বা নদীপথে পানিতে ভেসে তার লাশ বর্তমান মুড়ারবন্দ মাজারের পাশে চলে আসে। এ ঘটনা যে ঘটবে তা তিনি পূর্বেই বলে যাওয়ায় মানুষের মনে কোন আতংক সৃষ্টি হয়নি। সকলে এসে জানাজার পর কবর দেয়ার জন্য প্রস্তুত এমন সময় মরহুমের একটা ওছিয়তের কথা অনেকেরই মনে পড়ে গেল, তিনি বলেছিলেন আমার মৃত্যুর পর যেন আমার লাশ পশ্চিম দিকে পা আর পূর্ব দিকে মাথা রেখে দেয়া হয়। যা শরিয়তের বিধানের খেলাফ। শেষ পর্যন্ত শরিয়তের বিধানানুযায়ী উত্তর দক্ষিণেই তাকে দাফন করা হয়। দাফনের পর সকল মুছুল্লিগণ মুনাজাত রত অবস্থায়ই বিকট এক শব্দে তার কবর ঘুরে গেল। আজও মোড়ারবন্দে সৈয়দ নাসির উদ্দীন রহ. এর ঐতিহাসিক মাজার পূর্ব পশ্চিমে লম্বালম্বী ভাবে অবস্থিত। মুরারবন্দে তার কবরের পশ্চিমে আর কোন কবর নেই। প্রতিদিন এই কবর জিয়ারতের জন্য অসংখ্য লোকের ভীড় জমে।
পৃথিবীতে আর এ ধরণের পূর্ব পশ্চিমের লম্বালম্বী কবর আর কোথাও আছে বলে আমাদের জানা নেই। সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীন রহ. যে কত বড় মাকামের আউলিয়া ছিলেন এ নজীর বিহীন সমাধীই তার সাক্ষ্য গ্রহণ করে। ওলীদের মাঝে বিভিন্ন কারামত ও অলৌকিকতা দেখা যায়। এ সমস্ত কারামতের কারণ একমাত্র আল্লাহ তা’আলাই ভাল জানেন। সিপাহসালার সৈয়দ নাসির উদ্দীন রহ. এর সিলেট বিজয়ের ইতিহাস এদেশে নবীবংশীয় মোজাহীদেনদের এক গৌরবোজ্জল অমর ইতিহাস। আজীবন তাদের কর্মধারা আবর্তীত হয়েছে বাতেলের বিরোদ্ধে আপোষহীন সংগ্রামের মধ্যে সমাজে ন্যায় ইনসাফ ও হক প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় নিয়ে। দীর্ঘ সাড়ে চারশত বৎসর পর্যন্ত তার আউলাদগন এদেশে সুনামের সাথে ইসলাম প্রচার ও প্রসারের সাথে সাথে রাজত্ব ও করেছেন সূচারু রূপে ইনসাফের সাথে।
তরফ হতে মাছিহাতা : সিপাহসালার সৈয়দ নাসিরুদ্দীন রহ. এর বংশধারায় বহু মশহুর জ্ঞানি-গুনি আলেম-উলামা,পীর-মাশায়েখ জন্ম গ্রহন করেন। তাদের মাঝে মালেকুল উলামা, কুতুবুল আউলিয়া সাইয়েদুল আউলিয়া ইত্যাদি লকব প্রাপ্তরাও ছিলেন। ধীরে ধীরে বাংলা ও আসামের বিভিন্ন স্থানে তারা ধর্মপ্রচারে ছড়িয়ে পরেন। এমনকি বাংলা ও আরাকান,মুর্শিদাবাদের দরবার ছাপিয়ে দিল্লীর রাজদরবারেও তাদের সুখ্যাতি ছিল। নিকট অতিতেও এমন এমন মহাপুরুষগণ ছিলেন তাদের বনের বাঘ-ভল্লুক পর্যন্ত ভয় করত। এমনি একজন ছিলেন দাউদনগর নিবাসি সৈয়দ আব্দুল করিম এর পুত্র সৈয়দ নুরুল ইসলাম। তিনি আজ থেকে প্রায় সাড়ে তিনশত বছর পুর্বে বর্তমান ব্রাহ্মণরিয়া জেলার মাছিহাতায় আগমন করেন। সৈয়দ নুরুল ইসলাম বন্দেগী রহ.মাছিতায় আগমনের পর দলে দলে লোকজন এসে তওবা করে নিজেদের সংশোধিত করতে লাগল, অন্যদিকে হিন্দুরা এসে মুসলমান হতে লাগল। লোকজন এসে গুনাহ থেকে মুক্তি এবং হিন্দুরা এসে লাভ করল আলোর দিশা। তাই গ্রামটির নাম হয়ে যায় মাছিহাতা। মাছি অর্থ গোনাহ আর হাত্তা অর্থ দুর হওয়া। এখানে এসে যারা তওবা করত তারা নিজেদের পূত পবিত্র মনে করত। তাই যায়গাটির নাম হয়ে যায় মাআছি-হাত্তা (গুনাহ দুরিভুত হওয়ার স্থান)। বর্তমানে মাছিহাতা।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন