প্রারম্ভিক আলোচনা : আমাদের দেশ কৃষিপ্রধান দেশ। এ দেশের অর্থনীতিতে কৃষিকাজ ও কৃষকের ভূমিকা ও গুরুত্ব অপরিসীম। কৃষিকাজ করতে ইসলাম উৎসাহ প্রদান করে। অনাবাদী জমিকে আবাদ করে তা মানবজীবনে কাজে লাগানোর জন্য ইসলাম গুরুত্বারোপ করেছে। খাদ্য মানুষের অতি গুরুত্বপূর্ণ ও বেঁচে থাকার অন্যতম চাহিদা ও মাধ্যম। কোনো মানুষ না খেয়ে বেঁচে থাকতে পারে না। তাই একটি দেশের কৃষি উৎপাদন যেমন- খাদ্য, শস্য, ফলমূল উৎপাদন প্রক্রিয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আজকের প্রবন্ধে ইসলামের দৃষ্টিতে কৃষি কাজের গুরুত্ব বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
কৃষিকাজ করার জন্য নবীজির নির্দেশ : রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কৃষিকাজ করার জন্য আমাদের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন । তিনি নিজেও কৃষিকাজ করেছেন। আল্লামা সারাখসি (রহ.) বলেছেন, মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জারাফ নামক স্থানে চাষাবাদ করেছেন। তাহলে বুঝা যায় যে, কৃষি কাজ করা নবীজির সুন্নাতও বটে। শুধু তাই নয় রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীদেরও কৃষি কাজে উৎসাহ দিতেন। তিনি বলেছেন, ‘তোমরা জমিনের প্রচ্ছন্ন ভাণ্ডারে খাদ্য অম্বেষণ করো।
ইসলামে কৃষকের মর্যাদা : ইসলামে কৃষককে মর্যাদার চোখে দেখা হয়েছে। পৃথিবীর প্রথম মানব হজরত আদম আলাইহিস সালামও কৃষিকাজ করতেন। পরবর্তীতে আরো অনেক নবী-রাসূলগণ কৃষি কাজে সম্পৃক্ত ছিলেন। হজরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালামের ব্যাপারে বলতে গিয়ে মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘আমি তোমাদের ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম সম্পর্কে বলবো। আর তিনি চাষবাস করতেন।’ এ পেশাটি আল্লাহর নবীদের অধিকাংশই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন। তাই, ইসলামে এর মর্যাদা ও গুরুত্ব অপরিসীম।
জমি পরিত্যক্ত রাখতে নিষেধাজ্ঞা জারি : ইসলামে জমি পরিত্যক্ত রাখতে নিষেধ করা হয়েছে। ইসলামে পরিত্যক্ত জমি নিজে চাষ করতে না পারলে সে জমি অন্যকে দিয়ে আবাদ করতে বলা আছে। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমরা জমি আবাদ করো আর যে ব্যক্তি নিজে আবাদ করতে না পারে, সে যেন জমিটিকে অন্য ভাইকে দিয়ে দেয়, যাতে সে আবাদ করে ভোগ করতে পারে।’ এক্ষেত্রে, আবাদের জন্য জমি দেয়া হলেও জমির মালিক যে সে-ই থাকবে, কাজেই এভাবে জমি আবাদযোগ্য করার ক্ষেত্রে কোনো অসুবিধা নেই। এতে করে খাদ্য স্বয়ং সম্পূর্ণতা আসে।
আল্লাহ তাআলা চাষাবাদ করার জন্য জমি দিয়েছেন : মহান আল্লাহ তাআলা জমি দিয়েছেন চাষ করে খাদ্য উৎপাদন করার জন্যে। পবিত্র কোরআনে এসেছে, ‘তিনি পৃথিবীকে স্থাপন করেছেন সৃষ্ট জীবের জন্য। এতে আছে ফলমূল আর রসযুক্ত খেজুর বৃক্ষ এবং খোসাবিশিষ্ট দানা ও সুগন্ধি গুল্ম।’ ( সূরা : আর-রহমান, আয়াত : ১১-১২)। তবে কারো জমি অন্যায়ভাবে দখল করে ও উত্তরাধিকারকে অংশ না দিয়ে চাষ করলে গুরুতর অপরাধ হিসেবে গন্য হবে।
জমি আবাদের মূল ভিত্তি বীজ : মহান রাব্বুল আলামিন আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘তোমরা যে বীজ বপন করো, তা সম্পর্কে কি ভেবে দেখছো, তোমরা সেটা উৎপন্ন করো, না আমি উৎপন্নকারী? আমি ইচ্ছে করলে সেটা খড়কুটোয় পরিণত করে দিতে পারি। তখন তোমরা অবাকও হয়ে যাবে।’ (সূরা : ওয়াকিয়া, আয়াত : ৬৩-৬৫)। বীজ হতে শস্য, উদ্ভিদের সৃষ্টি। বীজ অতি যত্নের সঙ্গে রক্ষণাবেক্ষণ, পরিচর্যা করা জরুরী। বীজ সংরক্ষণের পদ্ধতি সম্পর্কে কৃষকের জ্ঞান থাকা জরুরী। ইসলামী দৃষ্টিতে চাষীর এ জ্ঞান অর্জন করা ফরজ এবং সাওয়াবের কাজও বটে।
ইসলামের দৃষ্টিতে হালাল উপার্জন কৃষিকাজ : একজন মুসলমান কখনো হারাম উপায়ে জীবিকা নির্বাহের পথ বেঁছে নিতে পারে না। ইসলামে যে সকল বৈধ উপার্জন মাধ্যম আছে তার মধ্যে কৃষিকাজ অন্যতম এবং অতি প্রাচীন একটি পেশা। ইসলাম এ পেশাকে মহৎ পেশা হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। পবিত্র কোরআন ও হাদিসে কৃষিকাজ, খাদ্যশস্য উৎপাদনের গুরুত্বের কথা বহুবার এসেছে।
হজরত আদম আলাইহিস সালাম এর পেশা ছিল কৃষিকাজ : হজরত আদম আলাইহিস সালাম পৃথিবীতে এসে প্রথম কৃষিকাজকে বেছে নিয়েছেন। সে সময় জীবিকা নির্বাহের প্রধান মাধ্যম ছিল কৃষিকাজ। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও নিজ হাতে খেজুর গাছ রোপণ করেছেন। হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা জমিনের প্রচ্ছন্ন ভাণ্ডারে খাদ্য অম্বেষণ করো।’
নবী-রাসূলগণও কৃষিকাজে সম্পৃক্ত ছিলেন : হজরত আদম আলাইহিস সালামকে আল্লাহ তাআলা কৃষি কাজসহ অনেক বিষয়ে জ্ঞান দান করেছেন। তাঁর উপর নাজিলকৃত ওহীর মধ্যে কৃষি বিষয়ক অনেক জ্ঞান এবং নির্দেশনা ছিলো। হজরত নুহ আলাইহিস সালামের জাহাজ মহাপ্লাবনে জুদী পাহাড়ে গিয়ে ভিড়লে সেখানে জয়তুন নামে বৃক্ষের ফলন ঘটান। হজরত ইদ্রিস আলাইহিস সালাম মানুষকে কৃষিকাজের পদ্ধতি শিক্ষা দিতেন। হজরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালামও তাঁর দুই পুত্র আল্লাহর নবী হজরত ইসহাক আলাইহিস সালাম ও হজরত ইসমাইল আলাইহিস সালাম দু’জনকে নিয়ে কৃষিকাজ করতেন। এভাবে হজরত সোলায়মান আলাইহিস সালাম, হজরত শুয়াইব আলাইহিস সালামসহ অনেক নবী কৃষিকাজে যুক্ত ছিলেন। মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহে ওয়া সাল্লাম বলেন, ‘তোমরা জমির লুক্কায়িত ভান্ডারে খাদ্যের অনুসন্ধান করো।’ (তাবারানী)
হজরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম এর কৃষিকাজ : পবিত্র কোরআনে এসেছে হজরত ইব্রাহিম আলাইহিস সালাম তাঁর প্রিয় পরিবারকে ছেঁড়ে যাওয়ার সময় মহান আল্লাহর কাছে আরজি করেন, ‘হে আমাদের পালনকর্তা! আমি আমার পরিবারের কিছু সদস্যকে তোমার মর্যাদাময় গৃহের সন্নিকটে চাষাবাদহীন উপত্যকায় বসবাসের জন্য রেখে যাচ্ছি। হে প্রভু! যাতে তারা সালাত কায়েম করে। কিছু লোকের অন্তরকে তুমি এদের প্রতি আকৃষ্ট করে দাও এবং তাদেরকে ফল-ফলাদি দ্বারা রুজী দান করো। আশা করি তারা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করবে।’ (সূরা : ইবরাহীম, আয়াত : ৩৭)।
হজরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম এর কৃষিবিষয়ক জ্ঞান : হজরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম কৃষি বিষয়ক স্বপ্নের ব্যাখা দিয়েছিলেন। দুর্ভিক্ষ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য কৃষি বিষয়ক বিভিন্ন পরামর্শ দিয়েছিলেন। এই ঘটনাটি পবিত্র কোরআন শরীফে বর্ণিত আছে, তোমরা সাত বছর উত্তমরূপে চাষাবাদ করবে। অতপর যখন ফসল কাটবে, তখন খোরাকি বাদে বাকী ফসল শীষ সমেত রেখে দিবে। এরপর আসবে দুর্ভিক্ষের সাত বছর। তখন তোমরা খাবে ইতোপূর্বে যা রেখে দিয়েছিলে, তবে কিছু পরিমাণ ব্যতীত যা তোমরা বীজ বা সঞ্চয় হিসেবে তুলে রাখবে। এরপরে আসবে এক বছর, যাতে লোকদের উপরে বৃষ্টি বর্ষিত হবে এবং তখন তারা আঙ্গুরের রস নিংড়াবে অর্থাৎ উদ্বৃত্ত ফসল হবে।’ (সূরা : ইউসুফ, আয়াত : ৪৭-৪৯)। হজরত ইউসুফ আলাইহিস সালাম নিজে মিশরের অধিকর্তা হয়ে এই দুর্ভিক্ষ থেকে পরিত্রাণের পদ্ধতি পালন করেন।
হজরত মুসা আলাইহিস সালাম এর পশু পালন : হজরত মুসা আলাইহিস সালাম নিজেও কৃষি কাজ এবং পশু পালন করতেন। মাদায়েনে থাকাবস্থায় তিনি কৃষি কাজ এবং পশু-পালন করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তিনি অধিকাংশ সময় বিভিন্ন স্থানে সফর করতেন এবং যেখানে যেতেন সেখানকার মানুষদেরকে কৃষি কাজ করতে উৎসাহিত করতেন। এবং এ বিষয়ে তাদেরকে ভালো করে বুঝিয়ে দিতেন যেন তারা কৃষি কাজ করতে পারেন।
সমাপনী : পরিশেষে বলতে চাই, একজন মুসলমান সে হালাল উপায়ে জীবিকা নির্বাহ করবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘অত:পর যখন নামাজ শেষ হয়ে যায় তখন তোমরা জীবিকা অন্বেষণে কাজ-কর্মের জন্য পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ো।’ (সূরা : জুমআ, আয়াত : ১০) এখানে কৃষিকাজকে বুঝানো হয়েছে আর এটা হালাল উপায়ে জীবিকা নির্বাহের মাধ্যম। এ পেশাকে অনেকেই ছোট করে দেখেন। খবরদার! এ পেশা অধিকাংশ নবীদের পেশা তাই এ পেশাকে ছোট করে দেখার কোন সুযোগ নাই। তাই আসুন, মানুষের জীবনের প্রয়োজনীয় খাদ্য, শস্য, শাক-সবজি যোগানদানে কৃষিকাজের প্রতি গুরুত্বারোপ করে প্রয়োজনীয় কৃষি কাজ করার চেষ্টা করি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন