দেশের দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারে গরিবের প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণ, সুস্থ ও মেধাবী জাতি গঠনে একমাত্র অবলম্বন ডিম। কারণ আমিষের অনন্য উপাদান গোশত ও মাছের দাম দীর্ঘদিন থেকেই সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে। দেশ বর্তমানে ডিম উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। কিন্তু তারপরও গত কয়েক মাস থেকে সে ডিমের দামও বেড়ে গেছে। অথচ ডিম আমদানি করতে হয় না। তারপরও দেশে ডিমের দাম বেশি হবে কেন? অনুসন্ধান করে দেখা যায় ডিম নিয়েই সিন্ডিকেট হয়েছে। তারাই দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। এক্ষেত্রে কিছু বহুজাতিক কোম্পানিও কাজ করছে। আবার ওই সিন্ডিকেটই চাচ্ছে দেশের পোল্ট্রি শিল্পকে বিপাকে ফেলতে ডিম আমদানিকে উৎসাহিত করতে। আর তাই সরকারের পাশাপাশি সকলের ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায় সিন্ডিকেট ভাঙার ইঙ্গিত দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। যদিও ইতোমধ্যে ডিম আমদানির বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেছেন, কোনো অবস্থাতেই দেশে ডিম আমদানি করা হবে না। বরং তিনি দেশবাসীকে একটু কষ্ট করার অনুরোধ জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, আমরা একটু কষ্ট করি তারপরও ডিম আমদানি করব না। একই সঙ্গে দাম চাহিদার ওপর নির্ভর করে। তবে একজন কৃষিবিদ হিসেবে বলতে পারি যাই দাম বৃদ্ধি পাক দুই-তিন মাস পর আমি লিখে দিতে পারি ডিম তারা বেচতেই পারবে না। কয়েকদিন আগেই ডিম বিক্রি করতে পারছিল না। গত তিন বছর ধরে এটা চলছে। পোল্ট্রি ফার্মের মালিকরা লস দিতে দিতে আর লস করতে রাজি না। এটা নিয়ে আমাদের কোনো সমস্যা নেই।
প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের দেয়া হিসাব অনুযায়ী ২০০৯ সালে বাংলাদেশে ডিমের উৎপাদন ছিল ৫৭৪ দশমিক ২৪ কোটি এবং ২০১৯-২০ সালে এ পরিমাণ দাঁড়ায় ১৭৩৬ কোটিতে। অর্থাৎ গত দশ বছরে বাংলাদেশে ডিমের উৎপাদন তিনগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। জনপ্রতি বছরে ১০৪টি ডিম হারে বর্তমানে জনপ্রতি প্রাপ্যতা ১০৪ দশমিক ২৩টি। বাংলাদেশ ডিম উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণ। পুষ্টিবিদরা জানান, ডিমে রয়েছে উচ্চমাত্রার প্রোটিন। পরিবারের প্রোটিনের চাহিদা পূরণে ডিমের বিকল্প নেই। প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় একটি ডিম রাখা উচিত।
অবশ্য সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে সরবরাহ কম, মুরগির খাবারের দামবৃদ্ধি, বৃষ্টি ও বাড়তি পরিবহন ভাড়ার অজুহাতে বেড়ে যাওয়া ডিমের দাম এখনো কমেনি। বাজারে প্রতি ডজন লাল ডিম বিক্রি হচ্ছে ১৫০ টাকায়।
সবচেয়ে বেশি চাহিদা থাকা লাল ডিম প্রতি হালি বিক্রি হচ্ছে ৫০ টাকায়। একইভাবে দেশি মুরগি ও হাঁসের ডিম বিক্রি হচ্ছে ২০০ টাকা ডজন। মহাখালী কাঁচাবাজারে সাপ্তাহিক বাজার করতে আসা বেসরকারি চাকরিজীবী ইকবাল সিকদার বলেন, বাজারে এমন কিছু নেই যার দাম বাড়তি যাচ্ছে না। দামের কারণে যারা মাছ, মাংস কিনে খেতে পারছেন না তারা অন্তত সবজি, ডিম, ডাল খেয়ে বেঁচে আছেন। সেই ডিমের দামও এখন বাড়তি। তিনি বলেন, বাজারে এক হালি ডিম কিনতে হচ্ছে ৫০ টাকায়। অর্থাৎ একটি ডিম ১২ টাকা ৫০ পয়সায় কিনতে হচ্ছে। দোকানদারদের জিজ্ঞেস করলে বলে, মালের দাম বাড়তি যাচ্ছে।
রাজধানীর মালিবাগ এলাকার ডিম বিক্রেতা জামাল বলেন, গত সপ্তাহে বৃষ্টির কারণে ডিমের সরবরাহ কম ছিল। তাই দাম বেড়েছে। মূলত মুরগির খাবারের দাম বেড়ে যাওয়ায় খামারিদের খরচ বেড়েছে। এছাড়া জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় পরিবহন খরচ আগের চেয়ে অনেক বেশি। তিনি বলেন, ডিমের দাম বাড়তি হওয়ার কারণে বর্তমানে আমাদের বিক্রি কমেছে। আগে যে এক ডজন ডিম কিনত, সে এখন ৬টি কেনে। এদিকে শুধু ডিমই নয়; গত কিছুদিন থেকে ৩০-৪০ টাকা বেড়ে বয়লার মুরগির কেজি বিক্রি হচ্ছে ১৮০ টাকায়। যদিও কয়েকদিন আগে ২০০ থেকে ২২০ টাকায় পৌঁছেছিল।
প্রায় প্রতিদিনই বেড়ে যাওয়া দাম নিয়ন্ত্রণে এবার ডিম আমদানির চিন্তা-ভাবনা করছে সরকার। এ সিদ্ধান্তকে ‘আত্মঘাতী’ বলছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, করোনার মহামারিতে গত দু’বছর বিপর্যস্ত ছিল এই খাতের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা। ওই সময়ে পোল্ট্রি পণ্যের দরপতন এবং উৎপাদিত পণ্য বাজারজাত করতে না পারায় ব্যাপক ক্ষতির মুখে সাধারণ খামারি থেকে শিল্প উদ্যোক্তারা। বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রি সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) এর তথ্য বলছে, করোনার সময়ে দেশের ৪০-৪৫ শতাংশ গোশতের উৎপাদন কমে গেছে। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের তথ্যমতে, দেশে নিবন্ধিত খামারির সংখ্যা ৯০ হাজার। তবে সারাদেশে এক লাখেরও বেশি হাঁস-মুরগির খামার রয়েছে। বিপিআইসিসি বলছে, লোকসানে ব্যবসা টানতে ব্যর্থ হয়ে ৪০ শতাংশেরও বেশি খামারি উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে। এখান থেকে উঠে আসতে বেগ পেতে হয়েছে। হাজার হাজার খামারি তাদের পুঁজি হারিয়ে পথে বসে গেছে। সরকারের কাছ থেকে কোনো ধরনের ‘প্রণোদনা’ সুবিধাও পায়নি খামারিরা। এখন যদি ডিম আমদানি করা হয় তাহলে খামারিরা আরো বিপাকে পড়বে।
সূত্রমতে, করোনা নিয়ন্ত্রণে আসায় বিপর্যয় অনেকটা কাটিয়ে উঠছিল খাতটি। কিন্তু হঠাৎ করে একটি অসাধু সিন্ডিকেট বিভিন্ন অযুহাত দেখিয়ে ডিম ও মুরগির দাম বাড়িয়ে এ খাতে অস্থিরতার সৃষ্টি করছে। ডিম উৎপাদনে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও সিন্ডিকেট এখন ডিম আমদানির পাঁয়তারা চালাচ্ছে। এক অর্থে তৈরি পোশাক খাতের পরই অত্যন্ত সম্ভাবনাময় এই খাতটিকে আবারো ধ্বংসের মুখে ফেলছে। অথচ এই শিল্পে প্রতিদিনই বাংলাদেশের অবস্থানের অগ্রগতি হচ্ছে। দেশের শিক্ষিত বেকার যুবকদের আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হয়েছে। দেশের অর্থনীতিতে ব্যাপক অবদান রাখছে শিল্পটি। আশির দশকে যেখানে পোল্ট্রি শিল্পে বিনিয়োগ ছিলো মাত্র ১৫শ’ কোটি টাকা, বর্তমানে সেখানে পোল্ট্রি শিল্পের বিনিয়োগ প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা। এবং এখানে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় ৬০ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। জিডিপি’তে পোল্ট্রি শিল্পের অবদান প্রায় ২ দশমিক ৪ শতাংশ। প্রায় দেড় কোটি মানুষ এই পোল্ট্রি শিল্পের ওপর নির্ভরশীল হয়ে জীবনযাপন করছে। যার ৪০ শতাংশ নারী। গার্মেন্টস শিল্পের পর পোল্ট্রি শিল্পই নারীদের বৃহৎ কর্মসংস্থান তৈরি করেছে।
তবে দেশে এভাবে হুট করে ডিমের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ার জন্য পোল্ট্রি খামারি, মধ্যস্বত্বভোগী ও ব্যবসায়ীদের দায়ী করেছেন ছোট ছোট খামারিরা। এই সিন্ডিকেটের কারণে কোনো কারণ ছাড়াই ডিমের বাজারে উত্তাপ বেড়েছে বলে মনে করছেন ক্রেতারা। এদিকে গত দুই মাস ধরে ডিমের দাম এক-তৃতীয়াংশ বেড়ে যাওয়ার পর তীব্র জন-অসন্তোষ ও অস্বস্তির সৃষ্টি হয়েছে। খামারিরা বলছেন, দীর্ঘদিন ধরে মুরগির বাচ্চার দাম না পাওয়ায় দেশে এখন মুরগি ও ডিমের উৎপাদন সঙ্কটে পড়েছে। মুরগি ‘কমেছে বলে’ এমনটি হয়েছে। পাশাপাশি জ্বালানির দাম বাড়ায় তিন দিন ট্রান্সপোর্ট বন্ধ ছিল যার প্রভাব পড়েছিল বাজারে। এছাড়া এই শিল্পের প্রায় ৭০ শতাংশই আমদানিনির্ভর। মুরগির খাদ্য, পরিবহন ব্যয় ও ডলারের দর বেড়ে যাওয়ায় সবমিলিয়ে মুরগি ও ডিমের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাংলাদেশ পোল্ট্রি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মো. সুমন হাওলাদার বলেন, ২০০৯ সালেও যেখানে দেশে ১ লাখ ৬০ হাজার পোল্ট্রি খামারি ছিলেন, এখন সেটি কমে ৬০ হাজারে দাঁড়িয়েছে। এই ৬০ হাজারের মধ্যে আবার ২০ হাজারের মতো ক্ষুদ্র খামারি ওই বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানের হাতে জিম্মি হয়ে গেছে। সুমন হাওলাদার বলেন, পোল্ট্রি খাতের এই সিন্ডিকেট ভাঙতে হলে, ক্ষুদ্র খামারিদের বাঁচাতে হলে এবং দেশের মানুষকে কম দামে পোল্ট্রি পণ্য খাওয়াতে হলে সরকারকে একটি পোল্ট্রি বোর্ড গঠন করতে হবে। এই বোর্ডই এক দিনের বাচ্চা, ডিম, ফিড, ব্রয়লার ও লেয়ার মুরগির দাম নির্ধারণ করে দেবে। তাহলে বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো সিন্ডিকেট করে বাড়তি মুনাফা লুফে নিতে পারবে না।
বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাষ্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি) সভাপতি মসিউর রহমান ইনকিলাবকে বলেন, সবকিছুর দাম বেড়েছে। পোল্ট্রি মুরগির খাদ্যসহ ৭০ শতাংশই আমদানিনির্ভর। গত কয়েক মাস ধরে আন্তর্জাতিক বাজারে মুরগির খাদ্য তৈরির সামগ্রী যেমনÑ ভুট্টা ও সয়ামিলের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে। ভুট্টার ৫০ শতাংশ আমদানি করতে হয়। গত বছর ভুট্টা ১৭ টাকা কেজিতে ক্রয় করা হয়েছে। এ বছর ৩৪/৩৫ টাকায় ক্রয় করতে হচ্ছে। সয়ামিল শতভাগ আমদানিনির্ভর। গত বছর সয়ামিল ৩৪/৩৫ টাকা ছিল। যা এখন ৬০/৬২ টাকায় ক্রয় করতে হচ্ছে।
একইসঙ্গে ডলারের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় আমদানি খরচ আরো বেড়ে গেছে। ডিম সারা দেশে উৎপাদন হয়। খামারিদের কাছ থেকে রাজধানীসহ সারাদেশে পাঠানো হয়। একইভাবে পোল্ট্রির খাদ্যও সারাদেশের খামারিদের কাছে পৌঁছাতে হয়। জ্বালানির দাম বাড়ায় ট্রান্সপোর্ট খরচও বেড়েছে। এসব কারণে মুরগির খাদ্য উৎপাদন ব্যয় বেড়ে গেছে।
পোল্ট্রির খাদ্যের দাম বৃদ্ধির পর লোকসান হওয়ার কারণে অনেক খামার বন্ধ হয়ে গেছে দাবি করে মশিউর রহমান বলেন, অনেক খামার বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে মুরগির বাচ্চা উৎপাদন করেও ন্যায্য মূল্যে বাচ্চা বিক্রি করতে না পেরে ব্যাপকভাবে লোকসান হয়েছে হ্যাচারির। যেমন একটা মুরগির বাচ্চা উৎপাদন খরচ পড়ে ৩০ টাকা। কিন্তু বিক্রি করতে না পেরে ৫/৬ টাকায় বিক্রি করতে হয়েছে। আবার অনেক সময় ফ্রিতেও দেয়া হয়েছে। দীর্ঘদিন এভাবে ক্ষতির মুখে পড়ে অনেক হ্যাচারি বন্ধ হয়ে গেছে। আর হ্যাচারি বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে মুরগির উৎপাদন কমে গেছে। যেমনÑ কয়েক মাস আগে যেখানে সপ্তাহে প্রায় ২ কোটি ১৭ লাখ বাচ্চার উৎপাদন ছিল, সেখানে বর্তমানে উৎপাদন নেমে এসেছে প্রায় ১ কোটি ৪০ লাখে।
বাজারের চাহিদার তুলনায় মুরগির বাচ্চা উৎপাদন কমে যাওয়ায় মুরগি ও ডিমের দাম বেড়ে গেছে বলে দাবি করেন তিনি। বিপিআইসিসি সভাপতি বলেন, কিছুদিন থেকে বেশিই বেড়েছে ডিমের দাম। বিশেষ করে গত ৭, ৮ ও ৯ আগস্ট জ্বালানির দাম বাড়ায় ট্রান্সপোর্ট বন্ধ ছিল। যার প্রভাব পড়েছিল বাজারে। এখন কিছুটা কমে এসছে দাম। তবে আবারও গত সপ্তাহে অধিক বৃষ্টিপাত হওয়ায় সরবরাহ সমস্যায় ডিমের দাম আবারও বেড়েছে। তবে খুব শিগগিরই বাজার স্বাভাবিক হয়ে আসবে বলে উল্লেখ করেন তিনি। আর ডিম উৎপাদনে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ আরো আগে থেকেই। তাই যদি ডিম আমদানি করা হয় তা হবে আত্মঘাতী।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন