২০০৭ সালে তত্ত¡াবধায়ক সরকারের সময় কম দামে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রির জন্য রাজধানীর উত্তরা ৬ নং সেক্টরে রাজউকের প্লটে বাজার বসায় তৎকালীন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিডিআর (বর্তমানে বিজিবি)। বিডিআরদের বাজার শেষ হলেও প্রায় ১৫ বছর ধরে চলছে এ কাচা বাজারটি। অল্প কয়েকটি দোকান থেকে এখন বাজারে মোট ৪৬০টি দোকান রয়েছে। স্ট্যাম্পে দলিল করে প্রতিটি দোকান ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকায় হচ্ছে কেনা বেচাঁ। এ হিসেবে প্রায় অর্ধশত কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে রাজউকের প্লট অবৈধ বাজারকে কেন্দ্র করে। এছাড়া প্রতি মাসে লাখ লাখ টাকার চাঁদাবাজি চলছে বাজারটিতে।
উত্তরা আজমপুরে রাজউক স্কুল এন্ড কলেজের সামনে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক লাগোয়া কাঁচাবাজারের প্লটগুলোর মালিক রাজউক। কিন্তু এসব বিষয়ে রাজউক কর্তৃপক্ষ নির্বিকার। এই কাঁচাবাজারের কারণে রাজউকের ৬ নং সেক্টরে উত্তরা আঞ্চলিক অফিসের নিচে নির্ধারিত কাঁচাবাজারও অচল হয়ে গেছে অনেক আগে। দুই তলা বাজারের নিচ তলায় মাছের আড়ত আর দুই তলায় কম্পিউটার কম্পোজের দোকান। নেই কোন কাঁচা বাজার।
বিডিআর মার্কেটে উত্তরা সেক্টর ৬ কাঁচা বাজার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমিতির নামে পুরো মার্কেটে অবৈধভাবে দোকান বিক্রি এবং চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ করছেন সমিতির সভাপতি আলী রাজ। আলী রাজ ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ছিলেন এবং ঢাকা-১৮ আসনের মরহুম এমপি সাহারা খাতুনের ছত্রছায়ায় মার্কেট দখলে নেন। মার্কেটের সভাপতি হয়েই একজনের দোকান দখল করেন।
সম্প্রতি আলী রাজ একটি দোকানের পজিশন বিক্রি করেছেন ১২ লাখ টাকায়। যার চুক্তিপত্র এসেছে ইনকিলাবের হাতে। এছাড়া আলী রাজের কথা না শুনলে দোকানে তালা মেরে চাঁদা আদায় করা হয়। কেউ দোকান মেরামত করতে চাইলেও দিতে হয় চাঁদা। টার্গেট করে কিছু ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চাঁদা নেন প্রতি মাসে। এছাড়া মার্কেটে সার্ভিস চার্জ, পানির বিল, ময়লার বিল, বিদ্যুতের বিলের নামে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা হয়।
প্রতি মাসে ৪৬০টি দোকান থেকে সার্ভিস চার্জ হিসেবে দৈনিক ৫০ টাকা করে মাসে সাত লাখ টাকা তোলা হয় সমিতির নামে। এ হিসেবে বছরে প্রায় এক কোটি টাকা চাঁদা তোলা হয়। এছাড়া পানির বিল ও বিদ্যুতের ইউনিট প্রতি অতিরিক্ত অর্থ আদায় করা হয়। মার্কেটের এই টাকা থেকে পুলিশ এবং রাজউকের কিছু কর্মকর্তারাও ভাগ পান।
আক্তার, জজ মিয়া, নুরনবী, বারেক, দুলাল, সাইফুল, কবিরসহ অসংখ্য মানুষের নিকট থেকে বিভিন্নভাবে লাখ লাখ টাকা চাঁদা আদায় করেছে আলী রাজ। এছাড়া দোকান তালা মেরে টাকা নেয়া হয়েছে অনেক ব্যবসায়ীর কাছ থেকে। অভিযোগ রয়েছে, মাংস ব্যবসায়ী জর্জ আমিনুলের কাছ থেকে দোকান মেরামতের জন্য ২ লাখ টাকা নিয়েছে, ডিমের দোকানদার শরীফের নিকট থেকে ৫০ হাজার টাকা চাঁদা আদায়, ছাগলের দোকানদার দুলাল ও শাহ আলমের কাছ থেকে প্রতি মাসে মোট ২০ হাজার টাকা নেয়া, মার্কেটের টয়লেট থেকে প্রতি মাসে ৩০ হাজার টাকা, জেনারেটর থেকে ৩০ হাজার টাকা আদায় করেন আলী রাজ। পানির বিল বাবদ মার্কেট থেকে তোলা হয় এক লাখ ৭০ হাজার টাকা।
এ নিয়ে উত্তরার ডিসি ও র্যাব বরাবর অভিযোগও দিয়েছে উপরোক্ত ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা। ছোট্ট টেইলারের মালিক রাজিয়া সুলতানাকে শ্লীলতাহানি ও মারধরের অভিযোগে থানায় আলী রাজের বিরুদ্ধে জিডি করা হলেও কোন প্রতিকার পাননি রাজিয়া।
এ বিষয়ে মাংস ব্যবসায়ী খোকন মিয়া পুলিশের উত্তরা ডিসি বরাবর অভিযোগ দিয়েছেন আলী রাজের বিরুদ্ধে। এতে আলী রাজের চাঁদাবাজি ও নির্যাতনের বিষয় উল্লেখ করেছেন। খোকন মিয়া ইনকিলাবকে বলেন, আলী রাজ একেক জনের দোকান তালা মেরে চাঁদা চায়। মার্কেটে ব্যবসা করতে দেয় না। বিএনপি-জামায়াত বলে পুলিশের ভয় দেখিয়ে চাঁদা নেয়। অন্যের দোকান দখল করে ভাড়া দেয়। আমার কাছ থেকে চাঁদা নিয়েছে।
ব্যবসায়ী রাজন মিয়া ইনকিলাবকে বলেন, নিজের দোকান মেরামত করতে হলেও আলী রাজকে চাঁদা দিতে হয়। আলী রাহের ইচ্ছামত দোকান ছোট বড় করে বিক্রি করে, ভাড়া দেয়। কেউ কিছু বললে মারধর করে, মার্কেট থেকে বের করে দেয়।
টেইলারের মালিক রাজিয়া সুলতানা বলেন, তাকে শ্লীলতাহানি ও মারধর করা হয়েছে। আলী রাজের বিরুদ্ধে থানায় জিডি করলেও কোন প্রতিকার তিনি পাননি। ব্যবসায়ীরা জানান, আলী রাজ রাজনীতি করেন, তার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলে মার্কেটে ব্যবসা করতে পারেন না। কিশোর গাংয়ের মাধ্যমে অনেকে ব্যবসায়ীকে মারধর করিয়েছেন আলী রাজ।
অভিযোগের বিষয়ে উত্তরা সেক্টর ৬ কাঁচা বাজার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আলী রাজ ইনকিলাবকে বলেন, আমি মার্কেটের সভাপতি ৩ বছর। সমিতি আমার নামে দোকান বরাদ্দ দিয়েছে। আমি সেই দোকান বিক্রি করেছি। অবৈধ মার্কেটে দলিল করে দোকান বিক্রি বৈধ কীনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, দোকান বিক্রি নয়, পজিশন হস্তান্তর করেছি।
সার্ভিস চার্জের বিষয়ে আলী রাজ বলেন, আপনি যত টাকার কথা বলেছেন তত টাকা উঠে না। তিনি খরচের হিসেবে দিয়ে বলেন, সিকিউরিটি ও ক্লিনিং বাবদ এক লাখ ৩৫ হাজার টাকা খরচ হয়। তিনি সভাপতি হিসেবে ২৫ হাজার, সাধারণ সম্পাদক ২৫ হাজার এবং কোষাধ্যক্ষ ২০ হাজার টাকা বেতন নেন সমিতি থেকে।
চাঁদাবাজির বিষয়ে তিনি বলেন, এসব মিথ্যা কথা। যারা অভিযোগ করেছে তারা কেউ প্রমাণ দিতে পারবে না। তিনি আরো বলেন, আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে। মার্কেটে মাদক সেবন হয়। এর বিরোধীতা করার কারণে আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হচ্ছে।
মাদক সেবনের বিরোধীতা করলে অবৈধ দোকান বিক্রি এবং চাঁদাবাজি বৈধ হয়ে যায় কিনা এমন প্রশ্ন করলে কোন উত্তর দেন নি আলী রাজ।
এ বিষয়ে রাজউকের উপ-পরিচালক (স্টেট ও ভূমি-২) আমিনুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, বিডিআর মার্কেটের প্লটগুলো বাণিজ্যিক প্লট। আমরা ইতোমধ্যে প্লটগুলো নিলামে তুলেছি। নিলাম হয়ে গেলে মার্কেট উচ্ছেদ করে প্লট মালিকদের বুঝিয়ে দেয়া হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন