প্রশংসনীয় স্বভাব-প্রকৃতি, সুমন্দর আচার-আচরণ ও মহত্তম চরিত্রের ষোলোকলা পূর্ণ করার জন্য এই পৃথিবীতে আগমন করেছিলেন বিশ্বনবি হজরত মুহাম্মদ (সা.)। চরিত্রের ষোলোকলা পূর্ণ করার জন্য এই ধরাপৃষ্ঠে যার আগমন তার চরিত্র সবচেয়ে সুমন্দর, প্রশংসনীয় ও অতুলনীয় হওয়া স্বাভাবিক। এ জন্যই স্বয়ং বিশ্ব-প্রতিপালক আল্লাহ নবি করিম (সা.) সমুন্নত চরিত্রের অধিকারী হবার অকুণ্ঠ সাক্ষ্য প্রদান করে মহাগ্রন্থ আল কুরআনে বলেছেন : আপনি অবশ্যই মহান চরিত্রের অধিকারী। (সুমরা কলম : ০৪) আল্লাহ তাআলার সঙ্গে সঙ্গে মহানবি (সা.)-এর বহু সহচরও তার শ্রেষ্ঠতম চরিত্রের অধিকারী হবার সার্টিফিকেট প্রদান করেছেন। সাহাবিগণ প্রদত্ত নবিজির অসংখ্য চারিত্রিক সনদের মধ্য হতে একটি সনদ এখানে উল্লেখ করছি : হজরত বারা রা. বলেন, আল্লাহর রাসুমল (সা.)-এর চেহারা ছিল মানুষের মধ্যে সর্বাপেক্ষা সুমন্দর এবং তিনি ছিলেন সর্বোত্তম চরিত্রের অধিকারী। (সহিহ বুখারি : ৩৫৪৯)
মহানবি (সা.)-এর বয়স যখন মাত্র একুশ বছর এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে নবুয়ত প্রাপ্ত হন নি তখনও তিনি অনন্য চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। এর প্রমাণ পাওয়া যায় নবিজির চাচা আবু তালিবের বক্তব্য দ্বারা। হজরত খাদিজা রা. এর সঙ্গে যখন বিশ্বনবি (সা.) বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হচ্ছিলেন তখন চাচা আবু তালিব তার শ্রেষ্ঠতম চরিত্রের স্বীকারোক্তি দিয়ে বিবাহের খুতবায় বলেছিলেন, ইনি হলেন আব্দুল্লাহর পুত্র মুহাম্মাদ। সহায়-সম্বলের দিক দিয়ে তিনি দরিদ্র হলেও ভদ্রোচিত চরিত্র ও অনুপম গুণাবলির দিক দিয়ে যাকেই তার সম্মুখে দাঁড় করানো হবে তিনি তার চেয়ে উত্তম, শ্রেষ্ঠ ও চরিত্রবান বলে বিবেচিত হবেন। কেননা ধন সম্পদ বিলীয়মান ছায়া সদৃশ ক্ষণস্থায়ী বস্তু বিশেষ। (সিরাতে খাতিমুল আম্বিয়া)
মহানবি (সা.)-এর উপর সর্বপ্রথম যেদিন ওহি অবতীর্ণ হয় সেদিন তিনি হজরত জিবরাঈল আলাইহিস সালামকে দেখতে পান। তার উপর ইত:পূর্বে ওহি অবুীর্ণ না হওয়া ও জিবরাঈল আলাইহিস সালামকে না দেখার কারণে সেদিন তিনি কিছুটা ভীত-সন্ত্রস্ত হন। তাই ওহি প্রাপ্ত হওয়ার পর বাড়িতে এসে আম্মাজান হজরত খাদিজা রা.-কে বলতে থাকেন, আমাকে কম্বলাবৃত করো। আমাকে কম্বলাবৃত করো। আমি প্রাণ নিয়ে আশঙ্কাবোধ করছি। তখন হজরত খাদিজা রা. মহানবি (সা.)-এর চরিত্রের বেশ কয়েকটি দিক তুলে ধরেছিলেন! এ ব্যাপারে আম্মাজান হজরত আয়েশা রা. বলেন, হজরত খাদিজা রা. সেদিন বলেছিলেন, আল্লাহর কসম! মহান আল্লাহ আপনাকে কখনো লাঞ্ছিত করবেন না। আপনি তো আত্মীয়–স্বজনের সঙ্গে সদাচরণ করেন, অসহায় দুস্থদের দায়িত্ব বহন করেন, নিঃস্বকে সহযোগিণএা করেন, মেহমানের আপ্যায়ন করেন এবং হক পথের দুর্দশাগ্রস্থকে সাহায্য করেন। (সহিহ বুখারি : ০৩)।
মহানবি (সা.) ছিলেন উত্তম চরিত্রের মূর্ত প্রতীক। সদাহাস্যোজ্জ্বল, বিনয়ী, নিরহংকার, অকৃপণ, কোমল হৃদয়ের অধিকারী, ঝগড়া-বিবাদ পরিহারকারী, সদালাপী ও সুম্যবাদী। অপবাদ দেওয়া, নিন্দা করা ও কারো পেছনে পড়ার অভ্যাস তার মধ্যে বিন্দুমাত্র ছিল না। তার মহৎ চরিত্রের বেশ কিছু দিক এই হাদিসে উঠে এসেছে : হাসান ইবনে আলি রা. বলেন, হুসাইন ইবনে আলি রা. বলেছেন, আমি আমার পিুাকে রাসুমলুল্লাহ (সা.)-এর সাথীদের সঙ্গে তাঁর আচরণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করি। উত্তরে তিনি বলেন, রাসুমলুল্লাহ (সা.) ছিলেন সদা হাস্যোজ্জ্বল ও বিনম্র স্বভাবের অধিকারী। তিনি রূঢ়ভাষী বা কঠিন হৃদয়ের অধিকারী ছিলেন না। তিনি উচ্চৈঃস্বরে কথা বলতেন না। অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করতেন না। অপরের দোষ খুঁজে বেড়াতেন না এবং কৃপণ ছিলেন না। তিনি অপছন্দনীয় কথা হতে বিরত থাকতেন। কাউকে নিরাশ করতেন না, আবার মিথ্যা প্রতিশ্রæতিও দিতেন না। তিনটি বিষয় থেকে দূরে থাকতেন : ঝগড়া-বিবাদ, অহংকার করা ও অযথা কথার্বুা বলা। তিনটি কাজ হতে লোকদেরকে বিরত রাখতেন। কারো নিন্দা করতেন না। কাউকে অপবাদ দিতেন না ও কারো দোষ-ত্রæটি অনুসন্ধান করতেন না। যে কথায় সওয়াব হয়, শুধু তাই বলতেন। তিনি যখন কথা বলতেন উপস্থিত শ্রোতাদের মনোযোগ এমনভাবে আকর্ষণ করতেন, যেন তাদের মাথার উপর পাখি বসে আছে। তিনি কথা বলা শেষ করলে অন্যরা তাকে প্রয়োজনীয় কথাবার্তা জিজ্ঞেস করতে পারত। তাঁর কথায় কেউ বাদানুবাদ করতেন না। কেউ কোন কথা বলা শুরু করলে তাঁর কথা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি চুপ থাকতেন। কেউ কোন কথায় হাসলে বা বিস্ময় প্রকাশ করলে তিনিও হাসতেন কিংবা বিস্ময় প্রকাশ করতেন। অপরিচিত ব্যক্তির দৃঢ় আচরণ কিংবা কঠোর উক্তি ধৈর্য্যরে সঙ্গে সহ্য করতেন। কখনো কখনো সাহাবিগণ অপরিচিত লোক নিয়ে আসতেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলতেন, কারো কোন প্রয়োজন দেখলে তা সামাধা করতে তোমরা সাহায্য করবে। কেউ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলে তিনি চুপ থাকতেন। কেউ কথা বলতে থাকলে তাকে থামিয়ে দিয়ে নিজে কথা আরম্ভ করতেন না। অবশ্য কেউ অযথা কথা বলতে থাকলে তাকে নিষেধ করতেন অথবা মজলিস হতে উঠে যেতেন; যাতে বক্তার কথা বন্ধ হয়ে যায়। (শামায়েলে তিরমিজি : ২৬৯)।
বিশ্ব স্রষ্টা পরাক্রমশালী আল্লাহ মহাগ্রন্থ আল-কুরআন নাজিল করেছেন মানব জাতিকে পথ প্রদর্শন করার জন্য। তাদেরকে ভালো পথে চলার দিকনির্দেশনা প্রদান করার জন্য এবং মন্দ পথ হতে বিরত থাকার আদেশ দেওয়ার জন্য। মানুষকে সুম্যপথের দাওয়াত প্রদান করার জন্য এবং অসৎ পথ হতে নিবৃত্ত থাকার আহŸান জানানোর জন্য। পবিত্র কুরআন শরিফে সকল ভালো কাজের আদেশ প্রদান করা হয়েছে এবং মন্দ সব কাজ হতে নিষেধ করা হয়েছে। আর আল্লাহর রাসুমল (সা.) ছিলেন এই কুরআন শরিফের জীবন্ত নমুনা। এর সরল সমীকরণ এই দাঁড়ায় যে, নবি করিম (সা.) সকল ভালো গুণে গুণান্বিত ও অলংকৃত ছিলেন এবং সকল মন্দ কাজ হতে বিরত ছিলেন। মহাগ্রন্থ আল কুরআনে যেসব কাজ করার আদেশ করা হয়েছে সেসব কাজ করতেন। পক্ষান্তরে যেসব কাজ করতে নিষেধ করা হয়েছে সেগুলো পরিহার করে চলতেন। এ কারণেই কুরআন শরিফকে মহানবি (সা.)-এর চরিত্র বলে অভিহিত করা হয়েছে। হজরত ইয়াজিদ ইবনে ইয়াবানুস রহ. বলেন, আমরা হজরত আয়েশা রা.-এর নিকট উপস্থিত হয়ে বললাম, হে মুমিন জননী! রাসুমলুল্লাহ (সা.)-এর চরিত্র-বৈশিষ্ট্য কী ছিল? তিনি বলেন, কুরআনই ছিল তার চরিত্র। (আদাবুল মুফরাদ : ৩০৮)।
অশ্লীল কথাবার্তা, জঘন্য গালিগালাজ, অশালীন ব্যবহার ও কটুভাষা কখনো সুমন্দর চরিত্রের পরিচায়ক হতে পারে না। বাজারে গিয়ে হট্টগোল করা, কারণে অকারণে অধীনস্থদের ধমকানো ও রাগ ঝাড়া মন্দ চরিত্রের পরিচায়ক। এসব মন্দ অভ্যাস মহানবী (সা.) এর মধ্যে ছিল না। তিনি সামর্থ্য থাকা সত্তে¡ও প্রতিশোধ গ্রহণ করতেন না। তার সঙ্গে যারা অসদাচরণ করত মহানুভবুার পরিচয় দিয়ে তিনি তাদেরকে ক্ষমা করে দিতেন। হজরত আবু আব্দুল্লাহ জাদালি রহ. বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর চরিত্র-মাধুর্য সম্বন্ধে হজরত আয়েশা রা.-কে প্রশ্ন করলাম। তিনি বললেন, রাসুমলুল্লাহ (সা.) কখনো অশ্লীল ও কটুভাষী ছিলেন না, অশ্লীল ব্যবহারও করেননি। তিনি কখনো বাজারে গিয়ে হট্টগোল করতেন না এবং অন্যায়ের দ্বারা অন্যায়ের প্রতিশোধ নিতেন না। বরং তিনি উদার মন নিয়ে ক্ষমা করে দিতেন। (সুনানে তিরমিজি : ২০১৬)।
ভালো মানুষ চেনা যায় ছোট মানুষের সঙ্গে, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে ও অধীনস্থদের সঙ্গে তার ব্যবহার দ্বারা। উপরস্থ কর্মকর্তা যদি তার নি¤œস্থ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে সদয় ব্যবহার করেন, অনুগ্রহপূর্ণ আচরণ করেন, তাহলে এই লোকটাকে চরিত্রবান ও ভালো লোক বলা যায়। বিশেষভাবে চাকর-চাকরানী ও সেবক-সেবিকাদের সঙ্গে যারা ভালো ব্যবহার করে তারা সত্যিই চরিত্রবান মানুষ। আপন সেবকের সঙ্গে মহানবি (সা.)-এর আচরণ ছিল অবিস্মরণীয়, অতুলনীয় ও বিস্ময়কর। হজরত আনাস রা. দীর্ঘ দশ বছর পর্যন্ত মহানবি (সা.)-এর সেবা করেছেন। কিন্তু বিশ্বনবি (সা.) কোনদিন বিরক্ত হয়ে তাকে এ কথাটুকু পর্যন্ত বলেন নি, তুমি এই কাজ কেন করলে এবং এটা কেন করলে না? সেবকের আচরণে সহনশীলতার এমন নজির পৃথিবীতে দ্বিতীয়টি পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। হজরত আনাস রা. বলেন, মদিনায় আমি দশ বছর যাবৎ মহানবি সাল্লাল্লাহি আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর খেদমু করেছি। তখন আমি বালক ছিলাম। সব কাজ আমার মালিক যেভাবে চেয়েছেন সেভাবে করতে পারি নি। সেজন্য তিনি আমার প্রতি কখনো মনক্ষুণœতা প্রকাশ করেননি এবং কখনো আমাকে বলেন নি, তুমি এটা কেন করলে অথবা এটা কেন করলে না? (সুমনানে আবু দাউদ : ৪৭৭৪)।
বিশ্বনবি (সা.) আমাদের নবি। আমরা তার উম্মত। আল্লাহ তাআলা হজরত মুহাম্মদ (সা.) কে আমাদের ত্রাণকর্তা ও পথপ্রদর্শক হিসেবে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। তাই তার প্রতিটি কর্ম, উক্তি, আচার-আচরণ ও অভ্যাস আমাদের জন্য অনুকরণীয় আদর্শ। আল্লাহ তাআলা বলেছেন নিশ্চয়ই তোমাদের জন্যে আল্লাহর রাসুমলের মধ্যে উত্তম আদর্শ রয়েছে। তাই আসুমন! আমরা মহানবি (সা.)-এর গুণে গুণান্বিত হই ও তার পদাঙ্ক অনুসরণ করার প্রয়াস চালাই। মহান আল্লাহ সকলকে তৌফিক দান করুন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন