দেশে বছরের মোট চাহিদার বিপরীতে ৩০ থেকে ৩৫ লাখ মেট্রিক টন আলু উৎপাদন হচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রা আসার একেবারে সহজ রাস্তা হচ্ছে বাড়তি আলু রফতানি। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে সংশ্লিষ্ট আমলা চক্রের রহস্যজনক আচরণে আলু রফতানির মাধ্যমে শক্তিশালী কৃষি অর্থনীতি গঠন ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংগ্রহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড ও মধ্যপ্রাচ্যের পর সম্প্রতি রাশিয়ায় আলু রফতানির দরজা উন্মুক্ত হয়েছে। রাশিয়া হচ্ছে বাংলাদেশের আলু রফতানির বড় বাজার। এর বাইরে উত্তরপূর্ব ভারতের সেভেন সিস্টারসহ সিকিম, ভুটান এবং নেপালেও আলু রফতানির উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে।
বিশ^ খাদ্য সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী বিশে^ আলু উৎপাদনের দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান বর্তমানে সপ্তম স্থানে রয়েছে। সেই তুলনায় রফতানির পরিমাণ একেবারেই হতাশাজনক বলে দেখা যাচ্ছে। কৃষি তথ্য সার্ভিস ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য বলছে, দেশে বর্তমানে গোল আলুর বার্ষিক চাহিদা ৬৫ লাখ মেট্রিন টন। ২০১৮ থেকে গত বছর পর্যন্ত টানা চার বছরে দেশে গড়ে ১ কোটি টনেরও বেশি আলু উৎপাদন হয়েছে। অর্থাৎ চাহিদার তুলনায় প্রতি বছর ৩০ থেকে ৩৫ লাখ মেট্রিক টন বেশি আলু উৎপাদন হচ্ছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, আলু রফতানিকারক সংস্থার বিভিন্ন প্রতিবেদনে পাওয়া তথ্যে জানা যায়, গত বছরই সর্বোচ্চ ৫২ হাজার মেট্রিক টন আলু রফতানি হয়েছে বিভিন্ন দেশে। চলতি বছরের জুন পর্যন্ত রফতানি হয়েছে ৩০ হাজার মেট্রিক টন। বছরের শেষ নাগাদ হয়তো এই পরিমাণ ৫৫ থেকে ৬০ হাজার মেট্রিক টন হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আলু রফতানির রেকর্ড অনুযায়ি এগ্রোবেইজড টেকনোলজি ডেভেলপমেন্ট প্রজেক্ট (এটিডিপি) ১৯৯৮ সাল থেকেই সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, শ্রীলঙ্কায় সীমিত পরিমাণে আলু রফতানি শুরু হয়। পরে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশেও আলু রফতানি করা শুরু হয়। ১৯৯৯ সালে আলু রফতানির পরিমাণ ছিল মাত্র ১২৬ মেট্রিক টন। পরবর্তীতে ২০০৫ থেকে ২০০৭ পর্যন্ত ক্রমাগতভাবে রফতানির পরিমাণ বেড়ে ৮ হাজার মেট্রিক টন হয়। ২০১১ সালে ৭টি দেশিয় কোম্পানি ২০ হাজার মেট্রিক টন আলু রফতানি করে।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্যে বলা হয়েছে, টাকার অংকে ২০১৪-১৫ অর্থ বছরে ১৭২ কোটি টাকার আলু রফতানি হয়েছে। এরমধ্যে শুধুমাত্র রাশিয়ায় ৭২ কোটি টাকার আলু রফতানি হয়। এদিকে আলু রফতানির সাথে সংশ্লিষ্ট দেশিয় কয়েকটি কোম্পানির কর্মকর্তাদের তথ্য মতে, রাশিয়ার মতো উন্নত দেশে তথা ইউরোপের বাজারে বাংলাদেশের আলু রফতানির খবরে চমকে ওঠে ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়।
এরপরই ভাইরাস পাওয়ার অজুহাতে রাশিয়ায় বন্ধ হয়ে যায় আরু রফতানি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রাশিয়ায় রফতানি উপযোগি আলু রিপ্যাকিং করার সময় রাজধানীর কারওয়ান বাজারে আলুতে ভাইরাস সংক্রমিত হয়। এটা সম্ভবত পরিকল্পিত স্যাবোটেজ বলে রফতানিতে জড়িতদের অনেকেরই ধারণা। বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, পরবর্তীতে রাশিয়ায় আলু রফতানির ব্যাপারে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আর কোন উদ্যোগ ছিল না। আলু রফতানির সাথে সংশ্লিষ্টদের এমন নিষ্ক্রিয়তা রহস্যজনক বলে সংশ্লিষ্টদের ধারণা।
আলু রফতানির সাথে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রের মতে, ভারত ও পািকস্তান এখন আলু রফতানিতে বাংলাদেশকে সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতে শুরু করেছে। বিশেষ করে ভারত আলু রফতানিকারক ও আলুচাষিদের জন্য প্রতি বছর নতুন নতুন প্যাকেজ সুবিধা বাড়িয়েই চলেছে। অন্যদিকে বাংলাদেশে আলু রফতানি খাতের বিষয়টি সরকারি পর্যায়ে যথেষ্ঠ অবহেলা করা হচ্ছে।
এদিকে বাংলাদেশের আলু আমদানির ওপর রাশিয়া ২০১৫ সালে তাদের দেওয়া নিষেধাজ্ঞা ৭ বছর পর তুলে নিয়েছে। ফলে এখন থেকে রাশিয়া এবং ইউরোপের বিভিন্ন দেশগুলোতে লাখ লাখ টন আলু রফতানির সম্ভাবনার দুয়ার খুলে গেছে। রফতানি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কৃষি বিভাগের তত্ত্বাবধানে রফতানি উপযোগি আলুবীজ সংগ্রহ, আমদানি, উৎপাদন বৃদ্ধি করে চাষিদের মধ্যে কম অথবা বিনামূল্যে সরবরাহ করলে রফতানিযোগ্য উন্নত প্রযুক্তির আলু উৎপাদনে উৎসাহী হবেন চাষিরা।
এছাড়াও উন্নত প্রযুক্তির হিমাগার নির্মাণ, হিমাগারে সোলার প্যানেল ব্যবহার করা হলে সেটা সাশ্রয়ী মূল্যে সরবরাহের ব্যবস্থা রাখতে হবে। কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের হিসাবে বর্তমানে দেশে হিমাগারের সংখ্যা ৩২৫টি। এতে সংরক্ষণ ক্ষমতা মাত্র ২০ থেকে ২২ লাখ মেট্রিক টন। এর বাইরে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ আলু নষ্ট হচ্ছে। এই মুহুর্তে অন্তত বিশেষায়িত ক্যাটাগরীর আরও ২০০ হিমাগার প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
কৃষি বিষয় গবেষক লেখক বিএডিসি কর্মকর্তা ড. মো. শাহাদাত হোসেন ইনকিলাবকে বলেন, আলু রফতানি বাড়াতে চাইলে কাঁচা আলু রফতানিকারকদের শতকরা ৩০ শতাংশ হারে ইনসেনটিভ বোনাস দিতে হবে। বাংলাদেশের কৃষি গবেষণা ইনিস্টিটিউটের সিনিয়র কীটতত্ববিদ জুলফিকার হায়দারের মতে, আলু উৎপাদনের কেন্দ্রীয় জেলাগুলোতে কৃষি কর্মকর্তাদের তত্ত্বাবদানে চুক্তি ভিত্তিক আলু চাষিদের দিয়ে উন্নত প্রযুক্তির আলু উৎপাদন করলে ভালো ফল পাওয়া যাবে।
অপরদিকে রংপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের জেলা কার্যালয়ের সহকারি কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ আকমল হোসেন বলেন, এবার রংপুর জেলায় রেকর্ড পরিমাণ ৫২ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে আলু চাষ করা হয়েছে। যা দেশের মোট চাহিদার ২৫ ভাগেরও বেশি পূরণ করা সম্ভব। অতীতে রংপুরে যে আলু চাষ উৎপাদন হয়েছে তার চাহিদা বিদেশে তেমন একটা ছিল না। সে কারণে এবার উন্নত জাতের বীজ এবং কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কারণে রফতানিযোগ্য আলু উৎপাদন সম্ভব হয়েছে। ইতোমধ্যে রফতানির সাথে জড়িতদের অনেকেই বলেছেন, রাশিয়া আলু নিতে আগ্রহের কথা জানিয়েছে। আর রংপুরে এবারের উৎপাদিত আলু রফতানির মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা আয় করা সম্ভব হবে।
রফতানিযোগ্য আলু উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত বগুড়া, জয়পুরহাট ও ঠাকুরগাঁ জেলার বেশ কয়েকজন আলু চাষি জানান, রাশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্য ছাড়াও ভারতের সেভেন সিস্টার, নেপাল, ভুটান ও সিকিমে কোল্ড ষ্টোরেজে রাখা আলুর চাহিদা রয়েছে। তবে উদ্যোগের অভাবে সেখানে আলু পাঠানো যায় না। ট্রানজিট জটিলতার কারনে নেপাল ও ভুটানে আলু পাঠানোর বিশেষ জটিলতা থাকলেও সম্প্রতি প্রধাণমন্ত্রীর ভারক সফরের সময় সেটা দূর হয়েছে। তাই নেপালে আলুসহ সবজি রফতানির নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
উল্লেখ্য দেশে আলু চাষ ব্যবস্থাপনায় প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটলে বর্তমানে যে পরিমাণ জমিতে আলু উৎপাদন হয় তা দ্বিগুণ হওয়ার সম্ভাবনা অতি উজ্জ্বল বলে কৃষি গবেষকদের ধারণা। এছাড়া মালয়েশিয়ার চাহিদা ১০ লাখ টন, থাইল্যান্ডে ৩ লাখ টন এবং রাশিয়া ও এর ইউরোপিয়ান মিত্র মধ্যপ্রাচ্য, ইন্দোনেশিয়া, শ্রীলঙ্কাসহ অন্যান্য দেশগুলোতে আলু রফতানি পুরোদমে চালু হলে দেশে রিজার্ভ সঙ্কট দূর হবে। শক্তিশালী হবে কৃষি অর্থনীতি। বদলে যাবে আলুচাষিদের ভাগ্য।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন