জামালপুরের অজপাড়ার দরিদ্র কিশোরী আমেনা বেগম (১৪)। ঢাকার একটি বাসায় কাজ করে গৃহকর্মীর। গ্রাম থেকে ফোন করেছেন তার ‘মেম্বার কাকা’। শিগগির বাড়ি যেতে বললেন। উপজেলা কেন্দ্রে গিয়ে ছবি তুলতে হবে। দিতে হবে চোখের মনির ছবি ও ১০ আঙুলের ছাপ। আকস্মিক ছুটি নিয়ে বাড়ি যায় আমেনা। ফিরে আসে এক সপ্তাহ পর। জানালো, আগামী নির্বাচনে সে ভোট দেবে। ভোটার তালিকায় নাম ওঠাতেই জরুরি ভিত্তিতে তাকে যেতে হয় বাড়ি।
একজন কিশোরী আমেনা বেগমই শুধু নয়। হাজার হাজার অপ্রাপ্তবয়স্ক কিশোর-কিশোরীর ভোটার তালিকায় নাম উঠেছে এবার। যদিও নির্বাচন কমিশন থেকে দাবি করা হচ্ছে, ১৮ বছরের কম হলে কাউকে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে না। ভোটার তালিকা হালনাগাদকরণের বিজ্ঞপ্তি ও প্রচার-প্রচারণায় জানানো হচ্ছে, যাদের জন্ম ২০০৫ সালের ১ জানুয়ারি কিংবা তারও আগে, তাদের অন্তর্ভুক্ত করে ২০২৩ সালের ২ মার্চ ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হবে। অর্থাৎ আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা হচ্ছে। এ কারণে এবারের হালনাগাদকরণের বিষয়টি বিশেষ তাৎপর্যবহ। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, ভোটার তালিকা গ্রহণযোগ্য না হলে সব ঠিকঠাক থাকলেও শুধু এ প্রশ্নে আটকে যেতে পারে নির্বাচন।
নির্বাচন কমিশন (ইসি) সূত্র জানায়, ২০০৭-২০০৮ সালে প্রথম ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা প্রণয়ন করা হয়। এ তালিকায় হাজারও ত্রুটি-বিচ্যুতি ধরা পড়লে পরবর্তীতে ভোট প্রদানকালে ভোটার আইডি কার্ড কোনো কাজে আসেনি। পরে এটিতে এনআইডি বা জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) হিসেবে ব্যবহারের সিদ্ধান্ত হয়। এনআইডি কার্ড ইস্যু কিংবা সংশোধন নির্বাচন কমিশনের চলমান প্রক্রিয়া হলেও ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা হয় কয়েক বছর পরপর। ভোটার তালিকা প্রণয়নের পর এ যাবত ৫ বার তালিকা হালনাগাদ করা হয়েছে। ২০০৯-২০১০ সাল, ২০১২-২০১৩ সাল, ২০১৫-২০১৬ সাল, ২০১৭-২০১৮ সাল ও ২০১৯-২০২০ সালে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করে নির্বাচন কমিশন। এ প্রক্রিয়ায় এবার ধাপভিত্তিক ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা হচ্ছে ডিজিটাল পদ্ধতিতে। এর পেছনে ব্যয় হচ্ছে ১০৬ কোটি ৬৪ লাখ টাকারও বেশি। ইভিএম পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণে ডিজিটাল ভোটার তালিকা ‘অধিক ফলদায়ক’ বলে প্রচার করা হচ্ছে নির্বাচন কমিশন থেকে।
হালনাগাদ কর্মসূচির আওতায় প্রথম ধাপে ১৪টি উপজেলার তালিকা হালনাগাদ করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সব উপজেলায় বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজ চলছে। ভোটারদের তথ্য সংগ্রহ এবং নিবন্ধন কার্যক্রম চলবে আগামী ২০ নভেম্বর পর্যন্ত। ইসির তথ্য মতে, এখন ১১ কোটি ৩২ লাখ ৮৭ হাজার ১০ জন ভোটারের তথ্য রয়েছে। এখন ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজ চলছে। এর মধ্য দিয়ে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হবেন নতুন ভোটার। তবে এবার নতুন ভোটার অন্তর্ভুক্তি নিয়ে লক্ষ্যনীয় হয়ে উঠেছে বিশেষ তৎপরতা।
কর্মসূচির আওতায় নতুন ভোটারদের অন্তর্ভুক্তির আনুষ্ঠানিকতা ‘সহজ’ করার লক্ষ্যে নিযুক্ত রয়েছেন কিছু স্বেচ্ছাসেবী। তারা অনলাইনে ফরম পূরণ করে দিচ্ছেন। এসব ‘স্বেচ্ছাসেবী’রা মূলত দলীয় মদদপুষ্ট এবং স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি ও রাজনীতিকদের ‘কর্মী’ হিসেবে চিহ্নিত। ইসি নিয়ন্ত্রিত সফটঅয়্যারে ২ নম্বর ভোটার নিবন্ধন ফরমের পেছনের পাতায় ৩৪ নম্বর ক্রমিকে ‘সনাক্তকারীর এনআইডি ও ৩৫ নম্বর ক্রমিকে ‘স্বাক্ষর’র কথা উল্লেখ রয়েছে। এ দু’টি স্থানে আবেদনকারীর কোনো প্রতিবেশী বা ‘অন্য একজন পরিচিত ব্যক্তি’র এনআইডি নম্বর তার স্বাক্ষর থাকতে হয়। এ ক্ষেত্রে নতুন অন্তর্ভুক্ত ভোটার তার বাবা-মা কিংবা পরিবারের অন্য সদস্যের এনআইডি নম্বর ব্যবহার করতে পারবেন না। ফরমের এই জায়গা পূরণে সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসছেন রাজনৈতিক পরিচয়বাহী এই স্বেচ্ছাসেবীরা। তারা দলীয় আনুকূল্যের ভিত্তিতে অল্পবয়সী নিকটাত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীকে ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করাচ্ছেন।
ইসির সূত্রটি জানায়, ভোটার হওয়ার যোগ্য ব্যক্তির বয়স সনাক্তকরণে কয়েকটি জিনিসকে ভিত্তি ধরা হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে নাগরিকের জাতীয় পরিচয়পত্র বা এনআইডি, পাসপোর্ট এবং নাগরিকের শিক্ষা সনদ। এর কোনোটিই নেই-এমন নাগরিকের বয়স নির্ধারণে ইউনিয়ন পরিষদ বা পৌরসভার ইস্যুকৃত জন্ম নিবন্ধন সনদকে ভিত্তি ধরা হচ্ছে। আর এক্ষেত্রেই ঘটছে নয়-ছয়। দলীয় প্রতীক ও মনোনয়নে নির্বাচিত স্থানীয় পরিষদ জন্মসনদ ইস্যু করছে দলীয় স্বার্থ নিশ্চিত করতে। ১৮ বছর পূরণ হয়নি-এমন শিশু-কিশোরকে ভোটার তালিকায় ওঠানোর লক্ষ্যে জন্মতারিখ উল্লেখ করছেন। এমনভাবেই জন্মতারিখ উল্লেখ করছেন যাতে আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে ভোটার হতে পারেন। জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ নিয়ন্ত্রিত সফটঅয়্যারের মাধ্যমে নিবন্ধন ফরম পূরণ করতে হয়। অনলাইন ফরম পূরণ করে দিচ্ছে দলীয় মদদপুষ্ট স্বেচ্ছাসেবীরা। বয়স কম হলেও আবেদনকারীর বয়স হিসেব কষে ‘১৮ বছর’ বানিয়ে দিচ্ছেন তারা। অনলাইন হলেও থেকে যাচ্ছে শুভংকরের ফাঁকি। এছাড়া এমন একটি প্রতিষ্ঠান এই পরিচালনা করছে যেটির গ্রহণযোগ্যতা নিয়েও রয়েছে ব্যাপক বিতর্ক। সর্বশেষ ডিজিটাল জনশুমারি অনুযায়ী দেশের মোট জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬ জন । অথচ জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ নিবন্ধিত নাগরিক সংখ্যা দেখাচ্ছে ১৯ কোটিরও বেশি। ২ কোটিরও বেশি জনসংখ্যার তারতম্য দেখানোয় বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এবং জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ দুটি প্রতিষ্ঠানের গ্রহণযোগ্যতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। এ বাস্তবতায় জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ নিয়ন্ত্রিত অনলাইন, সফটঅয়্যার তথা ডিজিটাল নিবন্ধন সনদ কতটা বিশ্বাসযোগ্যতা পাবেÑ সেই প্রশ্ন করছেন বিশ্লেষকরা।
অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র জেলা জজ মো. মঈদুল ইসলাম বলেন, বয়স কমিয়ে জন্ম নিবন্ধন করা, সেটির ভিত্তিতে ভোটার তালিকায় নাম ওঠানোর অভিযোগ গুরুতর। এই মুহূর্তে এটি নিরসন করা দরকার। কারণ, যখন ভোট হবে হালনাগাদ তালিকার ভিত্তিতেই হবে। ভোটার তালিকা ঠিক না বেঠিক এ সমস্যার কারণেই কিন্তু ওয়ান-ইলেভেন হয়েছিলো। ২০০৬ সালে নির্বাচন না হওয়ার বড় কারণ ছিলো ভোটার তালিকা বিতর্ক। এ কারণেই অভিযোগের বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখা উচিত নয়। তার মতে, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলেন, নির্বাচন কমিশন বলেন, স্থানীয় সরকার পরিষদ-যারা জন্ম নিবন্ধনটি করছেন, তাদের উচিত সফটঅয়্যারের পেছনে একজন মানুষ রাখা। এই মানুষগুলো নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকবে। মানুষগুলো যারা নিয়ন্ত্রণ করার দায়িত্বে আছেন, তদারকির দায়িত্বে আছেন তারা এগুলো দেখভাল করবেন, যাতে এটি না ঘটে। নির্বাচন কমিশনেরও উচিত সরাসরি তদারকিতে সজাগ দৃষ্টি রাখা। না হলে তাদেরও গ্রহণযোগ্যতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে যাবে। সমস্ত খাটুনির পরও শুধু ভোটার তালিকার ক্রেডিবিটির প্রশ্নে আটকে যাবে। এটি এখনো নিরসন করার সুযোগ রয়েছে।
‘হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পীস ফর বাংলাদেশ’র সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বলেন, নাগরিকের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে তথ্য ভাণ্ডার থাকাটা অত্যন্ত জরুরি। জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন সংক্রান্ত তথ্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মীদের আরো সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। নাগরিকেরও উচিত তার নাম-ঠিকানা-পরিচয়, জন্মতারিখ-যথাযথভাবে লিপিবদ্ধ হলো কি না নিশ্চিত হওয়া। নিবন্ধিত জনগোষ্ঠির সংখ্যা সর্বশেষ জনশুমারি থেকে বেশি হওয়া সম্পর্কে বলেন, জনশুমারির ফলাফল প্রশ্নবিদ্ধ। যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণ না করে নামকাওয়াস্তে এই শুমারি করা হয়েছে বলে নাগরিকের প্রকৃত তথ্য উঠে আসেনি। জন্ম নিবন্ধন কর্তৃপক্ষও যদি অপ্রাপ্ত বয়স্কদের বয়স বাড়িয়ে নিবন্ধন দেয় এবং সেটির ভিত্তিতে ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয় তাহলে হালনাগাদ ভোটার তালিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠতে বাধ্য।
‘জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন রেজিস্ট্রার জেনারেল মো. রাশেদুল হাসান বলেন, জন্ম নিবন্ধন ১৯ কোটি আছে আবার ৫ কোটিও আছে। আমাদের কাছে ২২ কোটিরও বেশি নিবন্ধনের তথ্য রয়েছে। সংখ্যাটি অবশ্য এভাবে নির্ধারণ করা যথার্থ হবে না। কারণ, এক সময় জন্ম সনদের ম্যানুয়েলি ডাটা এন্ট্রি হয়েছে। জাল-জালিয়াতি প্রতিরোধে পরবর্তীতে ডিজিটাল করা হয়। কিছু ম্যানুয়াল নিবন্ধনের ডাটাবেজ হয়েছে। পর্যায়ক্রমে আরো ডাটাবেজ করা হচ্ছে। এখানে কিছু রিপিটেশন রয়েছে। নিবন্ধিত অনেকের মৃত্যু হলেও মৃত্যু নিবন্ধন না করায় সেগুলো বাদ দেয়া সম্ভব হয়নি। সংখ্যাটি একারণেই হয়তো বেড়েছে। বিভিন্ন তথ্যের কারণ হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির সীমাবদ্ধতার কথাও তিনি অকপটে স্বীকার করেন।
তবে অপ্রাপ্ত বয়স্কদের বয়স বাড়িয়ে নিবন্ধন করা এবং সেটির ভিত্তিতে ভোটার তালিকায় নাম তোলার অভিযোগ উড়িয়ে দেন নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের পরিচালক (জনসংযোগ) মো. আসাদুজ্জামান আরজু। তিনি বলেন, কম বয়সিদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। জেএসসি, এসএসসি পর্যন্ত পড়লেই একজন মানুষের একটি সার্টিফিকেট থাকছে। সেখানে তার জন্মসন, তারিখ, ঠিকানা, বাবা-মায়ের পরিচয় রয়েছে। যাদের কোনো সার্টিফিকেটই নেই তাদের ক্ষেত্রে স্থানীয় সরকারের ইস্যুকৃত জন্ম নিবন্ধন সনদ রয়েছে। জন্ম নিবন্ধনেও বয়স বাড়ানোর কোনা সুযোগ এখন নেই। কারণ এটি এখন ডাটাবেইজ। কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত। জন্ম-মৃত্যু নিবন্ধন কর্তৃপক্ষ এটি নিয়ন্ত্রণ করছে। সেখানে সামান্য ত্রুটি থাকলে সেটি সংশোধন করার প্রক্রিয়া জটিল। তাই জন্ম নিবন্ধনে বয়স কম দেখিয়ে ভোটার তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির সুযোগ নেই। তিনি বলেন, সনাক্তকারীর রাজনৈতিক পরিচয় থাকতে পারে। ইউপি চেয়ারম্যান-মেম্বারগণও রাজনৈতিক হতে পারেন। আওয়ামী লীগ-বিএনপি থাকতে পারেন। তারপরও তারা দলীয় দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে উদ্দেশ্যমূলকভাবে বয়স কমিয়ে জন্ম নিবন্ধন ইস্যু করবেন বলে আমার মনে হয় না। কারণ, জনপ্রতিনিধি রাজনৈতিক দলের হলেও প্রথমত: তিনি জনপ্রতিনিধি। সে হিসেবে তিনি দলীয় বিবেচনায় অপ্রাপ্ত বয়স্কদের বয়স বাড়িয়ে নিবন্ধন দিবেন- এমনটি আমার মনে হয় না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন