অধ্যাপক কাজী সামশুর রহমান : বিশ্বমানবতার মুক্তিদূত নবীকুল শিরোমণি সৃষ্টিকুলের রহমত। প্রিয় নবী হযরত আহমদ মুজতবা মুহাম্মদ মোস্তফা সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার সোবহে ছাদেক সময়ে মা আমেনা রাদ্বিয়ালাহু তা’আলা আনহা’র কোল আলোকিত করে আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগে মক্কার সম্ভ্রান্ত কুরাইশ পরিবারে শুভাগমন করেন। ঘোর অমানিশার বুকচিরে নূরের জ্যোতির শুভাগমনে সৃষ্টিকুলের সকলেই পুলকিত হল। প্রিয় নবীর শুভাগমনের পূর্ব হতেই অনেক অলৌকিক ঘটনার অবতারণা হয়, হযরত মা আমেনা রাদ্বিয়ালাহু তা’আলা আনহা স্বপ্ন দেখলেন এক বৃদ্ধপুরুষ আকাশ থেকে নেমে এসে তাঁর গৃহে প্রবেশ করেন এবং নিজ পরিচয় প্রদানপূর্বক বলেন, আপনার গর্ভে যিনি আছেন তিনি দো-জাহানের সর্দার। স্মরণ রাখবেন তাঁর নাম হবে ‘আহমদ মোস্তÍফা’।
একদিন চিন্তামগ্ন অবস্থায় সহসা এক পরিন্দা (পাখি) এসে মা আমেনার মাথা টিপে দিতে শুরু করলো। একটু পরে কে যেন শিরনী এনে দিল। তিনি শিরনী খাওয়া শেষ করতেই তাঁর থেকে এক নূর অতিদ্রুত বের হয়ে ঊর্ধ্বাকাশের দিকে উঠে গেল। শিশু ভূমিষ্ঠ হবার সাথে সাথে দৈববাণী-শোনা গেল ‘নূরে মুহাম্মদী’ দুনিয়ায় এলেন। শিশুর কোন কান্না নেই। শিশুটি খতনাযুক্ত, নাভীকাটা ও মাথার মাঝখান দিয়ে সুন্দর পরিপাটি করা। ‘সিতাপাড়া’ অবস্থায় একটু পরেই শিশুকে সিজদারত দেখে মা আমেনা কান পেতে শোনেন ‘রব্বি হাবলী উম্মতি’ শব্দ কয়টি শিশুর মুখে উচ্চারিত হচ্ছে সোবহানাল্লাহ্। দুনিয়াতে এসেই উম্মতের জন্য প্রার্থনা শুরু করলেন আমাদের আকা মাওলা। আরো অনেক অলৌকিক ঘটনা স্থানাভাবে বিধৃত করা গেল না। দাদাজান হযরত আবদুল মোতালেব প্রিয় নাতির নাম রাখলেন ‘মুহাম্মদ’ আর স্বপ্নযোগে প্রাপ্ত মা আমেনা নাম রাখলেন ‘আহমদ’। ‘মুহাম্মদ’ অর্থ প্রশংসিত আর ‘আহমদ’ অর্থ প্রশংসাকারী। সোবহানালাহ্! প্রিয় নবীর শুভাগমনের সাথে সাথে অনেক মোজেজা প্রকাশ পেল। মক্কা শরীফে ‘ছামওয়া’ নামক একটি নদী বহুকাল যাবৎ শুষ্ক পড়েছিল। প্রিয় নবীর শুভাগমনের সাথে সাথে ওই নদীর পানি প্রবাহিত হতে শুরু করল।
* বেশ ক বছর থেকে আরব দেশে দুর্ভিক্ষ বিরাজমান ছিল। প্রিয় নবীর শুভাগমনে সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলাসমৃদ্ধ এবং সহসা সারাদেশ খাদ্য-শস্যে ভরপুর হয়ে উঠে।
* পারস্য সম্রাটের রাজপ্রাসাদের দেয়ালে লাগানো স্বর্ণপ্রস্তÍর খ-গুলো থেকে ১৪ খানা স্বর্ণখ- একসাথে হঠাৎ দেয়ালচ্যুত হয়ে পড়েছিল।
* অগ্নি উপাসকদের শত শত বছরের প্রজ্ব¡লিত অগ্নিকু- ঠিক একই সময়ে হঠাৎ নিভে যায়।
* প্রিয় নবী পাকের তাওয়ালুদ শরীফের দিনে ভোর রাত্রি হতে সপ্তাকাশ থেকে মা আমেনার গৃহ পর্যন্ত অসংখ্য ফিরিশতা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে রাসূল করীম সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র সম্মানার্থে বলতে লাগল ‘ইয়া নবী সালাম আলায়কা.......... সালাওয়াতুলাহ্ আলায়কা’ এবং আরো বিভিন্ন প্রশংসা সম্বলিত সালাম ও দরূদ পড়ে বিশ্বনবীকে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করেন। তাই ফিরিশতাদের অনুকরণে আমরা নবী প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে সালাত সালাম পড়ি।
* উক্ত দিবসে কাবাগৃহের ভিতর রক্ষিত মূর্তিসমূহের মাথা ভেঙে উপুড় হয়ে পড়েছিল। এ ঘটনায় কাফিররা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে।
* হঠাৎ করে সাফা ও মারওয়া পাহাড় দুটি কেঁপে উঠেছিল।
* ওই দিবসে সকাল থেকে একঝাঁক পাখি মা আমেনার গৃহের চারিদিকে উড়ন্ত অবস্থায় কাটিয়েছিল।
* হুজুর সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র শুভাগমনের মাত্র ৫৫ দিন পূর্বে ঐতিহাসিক ‘আসহাবে ফীল’ এর মতো ঘটনা ঘটে যায়। যা অলৌকিক ঘটনাবলীর মধ্যে অন্যতম ইতিহাসের পৃষ্ঠায়। এসব ইতিহাসের ঘটনা থেকে আমরা বুঝতে পারি যে শিশু নবীর সাথে পৃথিবীর কোন শিশুর সাথে তুলনা হয় না। তাই তিনি নূরের নবী। নূরে মুহাম্মদ সালালাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম পরম করুণাময় আল্লাহ্ তা’আলা প্রিয় নবীকে সম্বোধন করে বান্দাদের উদ্দেশ্যে পবিত্র কোরআন মজীদে ইরশাদ করেছেন, “হে হাবীব আপনি বলুন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাস তবে আমাকে (নবীকে) অনুসরণ কর। তাহলে আল্লাহ্ও তোমাদেরকে ভালবাসবেন এবং তোমাদের পাপরাশি ক্ষমা করে দেবেন।” [সূরা আল-ইমরান]
তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের মধ্যে রয়েছে সর্বোত্তম আদর্শ। [সূরা আল-আহযাব]
নিশ্চয় যারা আনুগত্যের শপথ করে! আল্লাহ্র কুদরতের হাত তাদের হাতের উপর রয়েছে। [সূরা আল ফাতাহ্]
“রাসূল সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম যা প্রদান করেন তা গ্রহণ করো, তিনি যা নিষেধ করেন তা থেকে বিরত থাক।” [সূরা হাশর]
প্রিয় নবীর শুভাগমনে খুশী উদযাপন করার জন্য আল্লাহ্ পাক বান্দাদের উদ্দেশ্যে ইরশাদ করেন, “কুল বি-ফাদলিল্লাহি ওয়া বি রাহমাতিহী ফা-বিযালিকা ফালইয়াফরাহু” “হে নবী, আপনি উম্মতদের বলে দিন আল্লাহ্র ফজল ও রহম প্রাপ্তিতে তারা যেন খুশী প্রকাশ করে।” প্রিয় নবী আল্লাহ্ তা’আলার ফজল তথা অনুগ্রহ এবং রহমত উভয়ই। অন্য এক আয়াতে রয়েছে, “লাক্বাদ মান্নালাহু আলাল মু’মিনীনা ইয্ বাআছা ফিহিম রাসূলা।” অর্থাৎ নিশ্চয়ই আল্লাহ্ তা’আলা মু’মিনদের উপর বড়ই অনুগ্রহ বা ফজল করেছেন যে, তাদের মধ্যে একজন সম্মানীত রাসূল প্রেরণ করেছেন।” অপর এক আয়াতে ঘোষিত হয়েছে- “ওয়ামা আরছালনাকা ইলা রাহমাতাল্লিল আলামীন।’’ অর্থাৎ হে প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আমি আপনাকে সমগ্র আলমের জন্য রহমত করেই পাঠিয়েছি।”
উপরে বর্ণিত আয়াতগুলো দ্বারা স্পষ্ট হয়ে গেল হযরত মুহাম্মদ মোস্তÍফা সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আল্লাহ্ তা’আলার ফজল ও রহমত। কাজেই ১২ রবিউল আউয়াল দিবসে, যথাযোগ্য মর্যাদায় খুশী উদ্যাপন করা মুসলমানদের অবশ্যই পালনীয় কর্তব্য।
মিলাদুন্নবী উদ্যাপন উপলক্ষে আলোচনা সভা ফাতেহাখানি সালাত-কেয়াম প্রভৃতি এদেশের জনগণের পূর্বপরিচিত। যদিও নবী বিদ্বেষী কিছু কিছু ব্যক্তি ও সংগঠন এসব কার্যক্রমকে ‘নাজায়েজ’ ‘বিদআত’ বলে সরলপ্রাণ মুসলমানদের বিভ্রান্ত করে আসছে। ঐ বাতিলপন্থীদের বিরুদ্ধে চট্টলার কৃতিসন্তান আশেকে রাসূল আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত’র বজ্রকণ্ঠ হযরতুল আল্লামা আলহাজ্ব শেরে বাংলা আজিজুল হক আল-কাদেরী রাহমাতুল্লাহি আলায়হি বলতে গেলে একাই লড়ে যাচ্ছিলেন। ওহাবীদের বেদম প্রহারে তার শরীর হতে রক্তস্রোত বয়ে যায়। মৃত বলে লাশ মর্গে ফেলে রাখা হয়। কিন্তু আল্লাহ্, রাসূল তাকে পুনঃজীবন দান করেন। ১৯৩৬ সালে প্রিয় নবীর ৩৮ তম বংশধর কুতুবুল আউলিয়া বিশ্বখ্যাত বুজুর্গ হযরতুল আল্লামা আলহাজ্ব হাফেজ ক্বারী সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি চট্টগ্রামের জমিনে শুভাগমন করেন। তার আগমনে সুন্নীয়ত তথা নবী-প্রেমিকদের আন্দোলন বেগবান হয়ে উঠে।
এ রকম একজন কামিল মুর্শিদ আওলাদে রাসূল পেয়ে হযরত আজিজুল হক আল-কাদেরী নুতন করে প্রেরণা লাভ করেন। উভয়ের প্রচেষ্টায় এদেশে সুন্নীয়ত প্রতিষ্ঠায় বিভ্রান্ত মুসলিম সম্বিৎ ফিরে পায়। আ’লা হযরত’র মস্লক’র উপর প্রতিষ্ঠিত হয় খ্যাতনামা দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামেয়া আহমদিয়া সুন্নীয়া আলিয়া ১৯৫৪ সালে, যার প্রতিষ্ঠাতা সৈয়্যদ আহমদ শাহ্ ছিরিকোটি রাহমাতুল্লাহি আলায়হি। ৩৯তম আওলাদে রাসূল গাউসে জামান সুন্নী মুসলমানদের প্রাণপ্রিয় মুর্শিদ হযরতুল আল্লামা আলহাজ্ব হাফেজ ক্বারী সৈয়্যদ মুহাম্মদ তৈয়্যব শাহ্ রাহমাতুল্লাহি আলায়হি ১২ রবিউল আউয়াল খুশী উদ্যাপনের জন্য এক কালজয়ী সিদ্ধান্ত দিলেন। আনজুমান-এ রহমানিয়া আহমাদিয়া সুন্নীয়া কর্তৃপক্ষকে এদিনে ‘জশনে জুুলুছ-এ ঈদে মিলাদুন্নবী সাল্লাল্লাহু তা’আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম উদ্যাপন করার আদেশ দিলেন। সে থেকে অদ্যাবধি এ ‘জশনে জুলুছ’ ব্যাপক থেকে ব্যাপকতার মধ্যদিয়ে উদ্যাপিত হয়ে আসছে।
‘জশনে জুলুছ’ তথা বর্ণাঢ্য মিছিলের বিরুদ্ধে বাতিলপন্থীরা বিষোদগার শুরু করলো। নাজায়েজ, বিদ্আত, গর্হিত বলে জিগির তুললো। শুধু তাই-ই নয় কিছু কিছু সুন্নী মুসলমান দরবারও এর বিরোধিতা করলো। আলহামদু লিল্লাহ্, তারাও এর বৈধতা ও গুরুত্ব বুঝতে পেরে ‘জশনে জুলুছ’ বের করছেন। হুজুর ক্বিবলার নির্দেশে আন্জুমান কর্তৃপক্ষ সকল মুসলমানদের জশনে জুলুছ উদ্যাপন করার আহ্বান জানালো, দাওয়াত দিয়ে সভার মাধ্যমে এর গুরুত্ব বোঝানোর চেষ্টা করা হলো। কিন্তু কে শোনে কার কথা। কোন যুক্তি-তর্ক অবুঝ লোকেরা মানতে নারাজ। প্রিয় নবীর শুভাগমনের দিন লক্ষ লক্ষ ফিরিশতাকুল মিছিল করে সারিবদ্ধভাবে খোশ আমদেদ জানিয়েছিল। এখনো প্রিয় নবীর রওয়াজা মুবারকে ৭০ হাজার করে দিনে ও রাত্রে তওয়াফ করছেন ফিরিশতারা আল্লাহ্র নির্দেশে। হুজুর করীম মক্কা মুয়াজ্জামা হতে হিজরত করে আসার পথে মদীনা শরীফের সীমানায় ও ঘরের ছাদে দাঁড়িয়ে মদীনার আবাল বৃদ্ধবনিতার কণ্ঠে ধ্বনিত হয়েছিল!
তালাআল বদরু আলায়না
মিন ছানিয়াতিল ওয়াদায়ি
ওয়াজাবাশ শুকরু আলায়না
মাদাআ লিলাহিদায়ি।
এবং এয়া রাসূলুল্লাহ্ ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত করে প্রিয় নবীকে মিছিল সহকারে সাদর সম্ভাষণ জ্ঞাপন করেন। সম্পূর্ণ শরীয়তসম্মত কোরআন-হাদীস, ইজমা-কিয়াস দ্বারা এ জুলুছের বৈধতা রয়েছে এবং এটা মুস্তাহাব।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন