রাজধানীতে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন ও বাস টার্মিনাগুলো অনেকটা অপরাধীদের নিরাপদ অভয়ারণ্য। চুরি, ছিনতাই, যাত্রীদের ব্যাগ টানা-হেঁচড়া, মাদক কেনাবেচা ও পতিতাবৃত্তিসহ এমন কোনো অপরাধ নেই, যা হচ্ছে না। অথচ প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষ ঢাকা ছাড়ছেন রেল ও বাস যোগে। তেমনি জীবন ও জীবিকার প্রয়োজনে রাজধানীতেও আসছেন। আর নানা হয়রানির পাশাপাশি খুন ও ধর্ষণের মতো বড় অপরাধেও শিকার হচ্ছেন অনেকেই।
অন্যদিকে সায়েদাবাদ, গাবতলী, মহাখালী, গুলিস্তান ও ফুলবাড়িয়াসহ বিভিন্ন টার্মিনালে হকার কিংবা সাধারণ যাত্রীর বেশে খাবারের সঙ্গে চেতনানাশক মিশিয়ে অথবা নাকের সামনে গ্যাস স্প্রে করে নিরীহ মানুষকে সর্বস্বান্ত করার ঘটনা প্রায় নিয়মিত ঘটছে। মাত্রাতিরিক্ত চেতনানাশক দেয়ায় অনেকে দূরারোগ্য ব্যধিতে আক্রান্ত হন। আবার অনেক ক্ষেত্রে অচেতন ব্যক্তির মৃত্যুও হচ্ছে।
ভুক্তভোগীদের ভাষ্য, রেলওয়ে স্টেশন ও বাস টার্মিনালগুলোতে অপরাধীদের আনাগোনা বেশি থাকলেও কমলাপুর সব ধরনের অপরাধীদের স্বর্গরাজ্য। ট্রেনে চলাচলকারী সাধারণ যাত্রীদের অভিযোগ, কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনের মূল ভবন ও প্ল্যাটফর্মগুলোর বেশিরভাগ জায়গা ঘিরে সক্রিয় রয়েছে একাধিক ভাসমান অপরাধী চক্র। বিভিন্ন সময়ে যাত্রী ও পথচারীদের মূল্যবান সামগ্রী ছিনতাই করে তারা। তবে খুব কমসংখ্যক ভুক্তভোগী অভিযোগ করেন। যারা অভিযোগ করেন তারাও যথাযথ প্রতিকার পান না।
পরিবারের সাথে রাগ করে গত ৭ অক্টোবর বাসা থেকে বের হয়েছিলেন ১৬ বছরের এক তরুণী। নেত্রকোন জেলার রেলওয়ে স্টেশন থেকে তিনি ওইদিন বিকেলে ৩টার দিকে হাওর এক্সপ্রেস ট্রেনে করে রাত ৮টায় কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে আসেন। ট্রেন থেকে নেমে ভিকটিম স্টেশনের মাঝামাঝি স্থানে এসে বসেন। এর ঠিক ১০ থেকে ১৫ মিনিট পরে ইমরান নামে এক যুবক এসে তার সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলে। এর এক পর্যায়ে যুবক ভিকটিমকে বলেন, এখানে বসে থেকো না তাহলে সর্বনাশ হতে পারে। তারপর ওই যুবক ভিকটিমকে ১ নম্বর প্লাটফর্মের ২১ নম্বর পিলারের সামনে বসিয়ে বলে ‘কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলে, সে যেন বলে, ইমরান ভাই বসিয়ে রেখেছে।’ এর কিছুক্ষণ পর ইমরান আবারও ভিকটিমকে বলেন, তোমার সর্বনাশ করার জন্য কয়েকজন ছেলে স্টেশনে রয়েছে। এই কথা বলে ভিকটিমকে নিরাপদ স্থানে নেয়ার নামে ১ নম্বর প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে থাকা তুরাগ ট্রেনের ৭৪৪ নম্বর বগিতে নিয়ে যায় ইমরান। সেখানে গিয়ে ইমরান বগির দরজা বন্ধ করে পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে ৪ থেকে ৫ যুবক ট্রেনের জানালা দিয়ে বগির ভেতরে ঢুকে ভিকটিমের মুখ চেপে ধরে প্রায় ৩০ মিনিট ধরে তাকে গণধর্ষণ করে।
চলতি বছরের ২ জানুয়ারি কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন থেকে এক দম্পতিকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারের পর তাদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হলে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান মোকসেদ আলী মন্ডল। তিনি পেশায় নিরাপত্তাকর্মী।
ঢাকা রেলওয়ে থানা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, এক স্বজনের মৃত্যুর খবর পেয়ে মোকসেদ গ্রামের বাড়ি জয়পুরহাটে যাচ্ছিলেন। ঘটনার রাতে মোকসেদ ও তার স্ত্রী জীবন নেসা কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে যান। সেখানে তারা কিছু খেয়েছিলেন। পরে উভয়েই অচেতন হয়ে পরেন। স্টেশন থেকে তাদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় ৪ জানুয়ারি মারা যান মোকসেদ। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে জীবন নেসাকে ছেড়ে দেয়া হয়। এ ঘটনায় কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।
গত সোমবার সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে প্রবেশের সময় ঢাকা রেলওয়ে স্টেশন জামে মসজিদের সামনে ভাসমান মানুষের জটলা। মূল প্রবেশ পথের কাছেই শুয়ে আছে বেশ কয়েকজন ভাসমান নারী-পুরুষ। তাদের পাশেই কয়েকজন নারী ভাত বিক্রি করছে। এই জটলার পাশে প্রকাশ্যে গাঁজা বিক্রি করছেন চার-পাঁচজন নারী ও পুরুষ। বিক্রেতাদের মধ্যে নারীদের সংখ্যা বেশি। পেশাদার মাদকসেবীদের পাশাপাশি রিকশাচালক ও নিম্ন আয়ের মানুষদের গাঁজা ও ইয়াবা কিনতে দেখা গেছে।
অভিযোগ রয়েছে, ট্রেন ছাড়ার সময়ে জানালার পাশে থাকা যাত্রীদের মোবাইল ফোনসহ মূল্যবান জিনিস ছোঁ মেরে নিয়ে পালিয়ে যায়। এ ছাড়া ট্রেনের ভেতরে ও ছাদে চলে ছিনতাইয়ের ঘটনা। সাধারণত স্বল্প আয়ের মানুষ ও টিকেট না পেয়ে ছাদে চড়ে বসেন। অনেক সময়ে ছিনতাইয়ে বাধা দিলে ছুরিকাঘাত করে চলন্ত ট্রেন থেকে তাদের ফেলে দেয়া হয়। গত বছর তেজগাঁও ও বনানীতে বেশ কয়েকজনকে ছুরিকাঘাত করে ছাদ থেকে ফেলে দিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে।
রহিম মোল্লা নামে এক যাত্রী ইনকিলাবকে বলেন, স্টেশন ঘিরে অনেক অপরাধী চক্র সক্রিয়। তারা শিশুদের দিয়ে ভিক্ষাবৃত্তি, যাত্রী হয়রানি, ছিনতাই ও মাদক বিক্রি করায়। পুলিশের চোখের সামনে এসব অপরাধ ঘটলেও তারা কোনো ব্যবস্থা নেয় না। আবার মাঝেমধ্যে কয়েকজন ধরা পড়লেও তারা ছাড়া পেয়ে একই কাজ শুরু করে।
কমলাপুর রেলওয়ে থানার ওসি ফেরদৌস আহম্মেদ বিশ্বাস ইনকিলাবকে বলেন, কমলাপুর স্টেশন ঘিরে থাকা সব ধরনের অপরাধীদের বিরুদ্ধে নিয়মিতভাবে অভিযান চালানো হয়। স্টেশনের ভেতরে ও বাইরে সবসময় রেলওয়ে পুলিশ নিরাপত্তার দায়িত্ব পালন করে থাকে। কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ পেলে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া হয়। তবে পুলিশের নিস্ক্রিয়তার অভিযোগ সঠিক নয়। তরুণী ধর্ষণের ঘটনায় ৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। জড়িত অন্যদের গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে।
অনুসন্ধানে জানা যায়, সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে ৮টি গ্রুপের মধ্যে ৩টি গ্রুপ সবচেয়ে বেশি সক্রিয়। গ্রুপগুলো হচ্ছে-জাহাঙ্গীর-সাঈদ গ্রুপ, আলম-তোফা গ্রুপ ও কালাম-আজিজ গ্রুপ। এই তিনটি গ্রুপের সদস্যরাই এ ধরনের প্রতারণার কাজে বেশি সক্রিয়। রাজধানীর অন্যান্য টার্মিনাল গাবতলী, মহাখালী ও সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালেও একই অবস্থা। বিশেষ করে গাবতলী ও কল্যাণপুরে ২০টিরও বেশি গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। এরা বিভিন্ন ধরনের পণ্য প্রতারণার পাশাপাশি বিভিন্ন অপরাধের সঙ্গেও জড়িত।
জানা গেছে, গাবতলী টার্মিনালের টিটু-আজিজ গ্রুপ পণ্য প্রতারণার পাশাপাশি ছিনতাইয়ের সঙ্গেও জড়িত। যাত্রীদের ব্যাগ ধরে টেনে নিয়ে যাওয়া থেকে শুরু নানা অপরাধ সঙ্ঘটিত করে থাকে তারা। সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে ৫টি গ্রুপ সক্রিয় থেকে পণ্য প্রতারণা ও যাত্রীদের টানাহেঁচড়া করে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ঢাকায় আসা ও ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়া বিভিন্ন যাত্রীদের ব্যাগ নিয়ে দৌড় দেয়া এই গ্রুপের কাজ। ৫টি গ্রুপের প্রধান হিসেবে কাজ করে মিন্টু নামে এক ব্যক্তি। মূলত তার নেতৃত্বেই এই টার্মিনালে এ ধরনের অপরাধ সঙ্ঘটিত হয়।
এছাড়া মহাখালীতে দিনের বেলায় এ ধরনের অপরাধ কম হলেও সন্ধ্যার পর পরই বেড়ে যায়। সোহেল ও উজ্জ্বলের নেতৃত্বে পণ্য প্রতারণার কাজে ১০ জন জড়িত। সোহেল ও উজ্জ্বলের বাড়ি মহাখালীর সাততলা বস্তিতে বলেও জানা যায়।
ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশন্স) এ কে এম হাফিজ আক্তার ইনকিলাবকে বলেন, অপরাধীদের বিরুদ্ধে আমরা সব সময় সক্রিয় রয়েছি। জনবহুল এলাকায় অপরাধীদের বিরুদ্ধে প্রায়ই অভিযান চালানো হচ্ছে। তবে টার্মিনালে প্রতারণার হাত থেকে রক্ষা পেতে এ ধরনের কোন জিনিস বা কারও সঙ্গে সাময়িক পরিচিত হয়ে কোনো খাবার না খাওয়ারও পরামর্শ দেন তিনি।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন