বাংলাদেশের ৯২ ভাগ মুসলমান ‘নারায়ে তাকবীর’ শব্দের সঙ্গে ব্যাপকভাবে পরিচিত। ইসলামী জলসা, ওয়াজ মাহফিল এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মিছিল-মিটিংয়ে সেøাগানটি প্রায় ব্যবহৃত হয়। ‘নারায়ে তাকবীর’ এর মধ্যে ১ম ‘নারায়ে’ শব্দ উর্দু। এর অর্থ : ধ্বনী বা উচ্চ আওয়াজ। আর দ্বিতীয় ‘তাকবীর’ আরবি শব্দ। অর্থ : আল্লাহর বড়ত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব। উর্দু ও আরবি শব্দের সংমিশ্রণে ‘নারায়ে তাকবীর’ অর্থ হলো, ‘তোমরা উচ্চ আওয়াজে আল্লাহর বড়ত্বের ঘোষণা দাও।’ এ দেশে তো এই স্লোগান খুবই প্রাসঙ্গিক এবং তাৎপর্যপূর্ণ। প্রশ্ন হচ্ছে- নারায়ে তাকবীর স্লোগানে বিএনপির চট্টগ্রামের কিছু স্থানীয় নেতার গোস্সা কেন?
বাংলা ব্যাকরণ ও ইংরেজি গ্রামারে দেখা যায়, নানান ভাষার শব্দের সংমিশ্রণে বাংলাভাষা সমৃদ্ধি লাভ করেছে। প্রচলিত যেসব শব্দ ব্যবহার করে আমরা বাংলায় কথা বলি তার অনেক শব্দ বাংলা নয়, বিদেশি। যেমন- আমাদের ব্যবহৃত শব্দ চেয়ার। এটা বিদেশি শব্দ। চেয়ারের বাংলা শব্দ কেদারা। চেয়ারকে ‘কেদারা’ নাম বললে কতজন চিনতে পারবেন? দেশের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নামকরণ। ‘আওয়াম’ উর্দু শব্দ, এর অর্থ জনগণ আর ‘লীগ’ শব্দের অর্থ দল। একসঙ্গে হয়ে আওয়ামী লীগ অর্থ জনগণের দল। কবিতা, সাহিত্যে যত বেশি ভাষার সংমিশ্রণ ঘটেছে, ততই সাহিত্য সমৃদ্ধি লাভ করেছে।
দেশের ১০ বিভাগীয় শহরে বিএনপি মহাসমাবেশের কর্মসূচি ঘোষণা করেছে। প্রথম সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় ১২ অক্টোবার চট্টগ্রামে। সমাবেশে একজন বক্তা বক্তৃতায় ‘নারায়ে তাকবীর’ সেøাগান দেন। ওই সেøাগানে উপস্থিত লাখো জনতা উচ্ছসিতভাবে ‘আল্লাহু আকবর’ সেøাগানের মাধ্যমে জবাব দেন। এই ‘নারায়ে তাকবীর’ স্লোগান নিয়ে বিএনপির দু’তিনজন তথাকথিত প্রগতিশীল নেতা বলেছেন, ‘ওই স্লোগান বক্তার নিজের ব্যক্তিগত, এটা দলের সেøাগান নয়।’ প্রশ্ন হচ্ছে- ওই স্লোগান নিয়ে এতো বিতর্ক কেন? বিপুল জনসমাগম দেখে প্রতিবেশী দেশের শাসকদের খুশি করতে দেশের কিছু গণমাধ্যম বিএনপির সমাবেশে ‘নারায়ে তাকবীর’ শব্দটি ‘পাকিস্তানপ্রীতি’ আবিষ্কার করার অপচেষ্টা করেন। এ জন্য সমাবেশের ব্যাপকতা প্রচারের বদলে শব্দটির ব্যবহার নিয়ে বিএনপির স্থানীয় নেতাদের প্রশ্ন করেন। তার জবাবে সবজান্তার মতো তথাকথিত প্রগতিশীল নেতারা জানান, ‘ওটা বিএনপির সেøাগান নয়, ওটা বক্তার ব্যক্তিগত সেøাগান।’ আরেক নেতা তথাকথিত প্রগতিশীলতার ঢংয়ে বলেছেন, ‘সমাবেশে এই সেøাগান কেউ দেয়নি। একজন বক্তা তার বাবার সেøাগান দিয়েছেন।’ আরেক নেতা আরো কয়েক হাত এগিয়ে গিয়ে বলেছেন, ‘বক্তার বাবা ধর্মীয় রাজনীতি করতেন; তিনি তার বাপের সেøাগান দিয়েছেন’। চমৎকার! প্রশ্ন হলো- তাহলে বিএনপির সেøাগান কি? গণমাধ্যমের যে সাংবাদিক সমাবেশের বিশালত্বতা তুলে ধরার বদলে একটি শব্দকে ‘হাইলাইট’ করার প্রয়াস পায় তার উদ্দেশ্য কি বিএনপির ওই নেতারা বুঝতে পারেননি? বিএনপির ওই নেতারা আসলে বুঝতে না পেরেই লাখো জনতার সমাবেশে ‘নারায়ে তাকবীর’ শব্দটির ব্যবহার নিয়ে বিদ্বেষ প্রকাশ করেছেন? নাকি তথাকথিত প্রগতিশীলতার খাতায় নিজেদের নাম লেখানোর জন্য দাদাদের খুশি করতে চাচ্ছেন?
নির্বাচন কমিশনে ৪০ থেকে ৪২টি রাজনৈতিক দল নিবন্ধিত হলেও দেশে প্রায় দেড় শতাধিক রাজনৈতিক দল রয়েছে। এসব দলের বেশির ভাগেরই আদর্শ, নীতি এবং উদ্দেশ্যে ‘দেশের মানুষের মঙ্গলের’ কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এসব দলের প্রতি মানুষের আস্থা তেমন নেই। যেসব দল মানুষের ‘প্রত্যাশা’ অনুসারে পরিচালিত হয়, সেসব দলকে আমজনতা সমর্থন করে। গণমানুষের সমর্থন আদায়ের প্রত্যাশা থেকে ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর ১৯৯৩-৯৪ সালে আওয়ামী লীগ গঠনতন্ত্রে ব্যপক পরিবর্তন এনেছে। বাংলাদেশের মুসলমানদের চিন্তাচেতনা, চাওয়া পাওয়া, বিশ্বাস অবিশ্বাস এবং প্রত্যাশার কথা বিবেচনা করেই আওয়ামী লীগ দলের গঠনতন্ত্রে পরিবর্তন আনে। পরবর্তী সময়ে তার সুফলও দলটি পেয়েছে। শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসীদের নিয়ে রাজনীতি করতে ১৯ দফা কর্মসূচির মাধ্যমে বিএনপি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি দেশের আলেম-ওলামাদের দল ভারি করার পাশাপাশি বামদের চেতনায় রূপান্তর ঘটিয়ে বিএনপিতে ভিড়িয়েছিলেন। যার কারণে সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহ’ সংযোজন করেছিলেন। চট্টগ্রাম বিএনপির তথাকথিত প্রগতিশীল দু’তিনজন নেতা মুসলমানদের ধর্মীয় চেতনায় উজ্জীবিত স্লোগান ‘নারায়ে তাকবীর’কে নাকচ করতে চান? তারা কি দিল্লির দাদাদের খুশি করতে এমন মন্তব্য করেছেন, নাকি দাদাদের এদেশীর এজেন্টদের ফাঁদে পা দিচ্ছেন? প্রশ্ন হলো- যে সমাবেশে নারায়ে তাকবীর স্লোগান দেয়া হয়েছে, সেখানে লাখো মানুষ কি ওই স্লোগানের প্রতিবাদ করছে? নাকি মানুষ উচ্ছসিত হয়েছেন? খবরের ভিডিও ফুটেছে দেখা যায়, সমাবেশে উপস্থিত হাজার হাজার মানুষ ওই স্লোগান ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।
ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও মন্ত্রীরা হরহামেশাই বলছেন, ‘বিএনপির মাজা ভাঙা দল, দলটির কোমর ভেঙে গেছে, উঠে দাঁড়াতে পারবে না। ফেইসবুক-ইউটিউব ও গণমাধ্যমে গলাবাজির দলটি সম্বল। দলটির নেতারা হুংকার দিয়ে যাবেন, রাজপথে দাঁড়াতে পারবেন না। ১৫ বছরেও আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেনি; এবারও পারবে না ইত্যাদি ইত্যাদি।’ প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতাদের এমন বক্তব্যের মধ্যেই বিএনপির সমাবেশগুলোতে ব্যাপক জনসমাগম হচ্ছে। সারা দেশে সমর্থক নির্ভর দলটির প্রতিটি সমাবেশে নানা বাঁধা-বিপত্তি পেরিয়ে হাজার হাজার মানুষ হাজির হচ্ছেন, নেতাদের বক্তব্য শোনার জন্য। রাজনৈতিক দলগুলোর সমাবেশে উপস্থিত জনতা কি শুনতে চায় বক্তাদের বক্তৃতার সময় সেটা খেয়াল রাখতে হয়। বক্তব্য পছন্দ হলে হাততালি দেয় এবং অপছন্দ হলে মানুষ উঠে যায়। রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশ, সিনেমা-নাটক এবং ফুটবল-ক্রিকেট খেলা নয়, নেতার বক্তৃতায় আকৃষ্ট নাহলে মানুষ বসে থাকবে! কেন শুধু বক্তব্য শুনতে যাবে ঝুঁকি নিয়ে? চট্টগ্রামের সমাবেশকে কেন্দ্র করে অনেক জায়গায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চেকপোস্ট বসিয়ে সমাবেশমুখি মানুষকে বাস থেকে নামিয়ে দিয়েছেন। এমনকি কিছু এলাকায় ক্ষমতাসীন দলের নেতারা ঘোষণা দিয়েছিল ‘যারা বিএনপির সমাবেশে যাবেন, তারা আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকা পর্যন্ত গ্রামে ফিরতে পারবেন না।’ এসব বক্তব্য ও ফুটেজ ইউটিউবে ঘুরছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমর্থকরা সমাবেশে গেছেন। সেখানে মানুষের প্রত্যাশা অনুযায়ী বক্তারা বক্তৃতা করবেন, সেটাই স্বাভাবিক। আর ‘নারায়ে তাকবীর’ সেøাগান কোনো রাজনৈতিক দল ও ব্যক্তির নয়। এটা এ উপমহাদেশের মুসলমানরা উজ্জীবিত হয়েই সভা-সমাবেশে ব্যবহার করেন। জনগণের সেন্টিমেন্টের বিপক্ষে গিয়ে কেউ ক্ষমতায় যেতে পারেনি এবং দলকে জনসম্পৃক্ত করতে পারেনি। এদেশের রাজনীতিতে ইসলামী চেতনা উপেক্ষা করে বিজাতীয় সংস্কৃতির চর্চা করে কখনোই তথাকথিত প্রগতিশীলরা জনগণের সমর্থন পায়নি। ইসলামবিদ্বেষী বিজাতীয় সংস্কৃতিমনা ব্যক্তিরা যুগের পর যুগ ধরে রাজনীতি করলেও তারা ক্ষমতায় যাওয়া দূরের কথা, ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার পদেও নির্বাচন হওয়ার ভোট পান না। তাদের যারা এমপি-মন্ত্রী হয়েছেন, তারা প্রগতিশীলতার দূরে ঠেলে গণমানুষের রাজনীতি করেন, এমন দলগুলোর ব্যানারে ভোট করে এমপি-মন্ত্রী হয়েছেন। কাজেই বিএনপির তথাকথিত প্রগতিশীল নেতাদের বুঝতে হবে ৯২ ভাগ মুসলমানের দেশে তথাগথিত প্রগতিশীলতার নামে মানুষের সেন্টিমেন্টের বিপক্ষে গেলে মানুষের সমর্থন পাওয়া যাবে না।
বিএনপির সমাবেশে লাখো মানুষের স্বতঃস্ফ‚র্ত উপস্থিতিকে পাশ কাটিয়ে ‘নারায়ে তাকবীর’ সেøাগানকে যারা বেশি গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করছেন, তাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য পরিষ্কার। বিএনপির সমাবেশে এতো বেশি মানুষ উপস্থিত হোক, তারা সেটা চায় না। না চাওয়ার পেছনে কারণ পরিষ্কার। কিন্তু প্রগতিশীলতার নামে জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী বিএনপির ওই নেতারা কি নিজেদের প্রগতিশীল জাহির করতে চাচ্ছেন? এতো ঈশপের গল্প কাকের মতো! একটি দাঁড়কাক উড়ে যাওয়ার সময় তার চোখ পড়ে এক ময়‚রের দিকে। ময়‚রের পেখম দেখে সে মুগ্ধ। কাকের খুব ইচ্ছা হলো ময়‚র হতে! মনে মনে বুদ্ধি এঁটে সে ময়‚রের পেখম কুড়িয়ে নিয়ে নিজের গায়ে লাগিয়ে ময়‚রের দলে ভিড়তে চেষ্টা করে। কিন্তু ময়‚রের দল তাকে দেখে চিনে যায়। তারা তাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দেয়। মনের দুঃখে সে ফিরে যায় দাঁড়কাকের দলে। কিন্তু শরীরে ময়‚রের পেখম দেখে তারাও তাকে তাড়িয়ে দেয়। মনের দুঃখে সে একাই থাকতে লাগল। ঈশপের এ গল্প থেকে বিএনপির ওই নেতারা শিক্ষা নেবেন কি-না, সেটাই দেখার জন্য অপেক্ষা করছে মানুষ। কারণ জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী দল করে বিজাতীয় প্রগতিশীলতার তালিকায় নাম লেখানো যায় না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন