রাজধানী ঢাকায় বিভিন্ন রুটে কালো ধোঁয়া উড়িয়ে বেপরোয়াভাবে চলছে পুরনো বাস। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সামনেই এসব গণপরিবহণ চললেও তারা নীরব। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এসব বাস থেকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী নিয়মিত চাঁদা নেয়ায় বাসগুলো নির্বিঘ্নে চলাচল করছে। সড়কে এসব লক্কড়-ঝক্কড় বাস বেপরোয়া। তবে সড়কে হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে গেছে যাত্রীদের অবর্ণনীয় দুর্দশায় পড়তে হয়। বিশেষ করে ফ্লাইওভারে এসব বাস আটকে গেলে মূহূর্তেই তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়।
রাজধানীর বিভিন্ন রুটে চলাচল করা বাসগুলোর প্রায় এক হাজার বাসের নেই ফিটনেস। কোনটার জানালা ভাঙা কোনটার দরজা ভাঙা। আবার কোনো কোনো বাসের সামনে পিছনে দুইদিকেই লক্কড়-ঝক্কড় বাস দিনের পর দিন দাপিয়ে বেড়াচ্ছে রাজপথ। রাজধানীর রাস্তায় ফিটনেসবিহীন এসব বাস একটি আরেকটির সাথে আঁচড় দিয়ে চলছে নিয়মিত। এই আঁচড়ে চিহ্ন লেগে আছে বাসের গায়ে। এসব বাসের অপ্রাপ্ত বয়স্ক ও লাইসেন্সবিহীন চালকের হাতে রয়েছে শত শত গাড়ির স্টিয়ারিং। রাজধানীতে বিভিন্ন রুটে চলাচলরত টেম্পোর চিত্রও একই। মহাসড়কে চলাচলকারী অধিকাংশ গাড়ির নেই ডিজিটাল নম্বর প্লেট। এসব নানা কারণে প্রতিদিনই বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা। ঝরছে তাজা প্রাণ। পঙ্গু হচ্ছে অনেকে।
এদিকে, অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য থেকে যাত্রীদের মুক্তি দিতে কয়েকটি গণপরিবহনে চালু করা হয় ই-টিকেটিং ব্যবস্থা। এ ব্যবস্থার ফলে কাউন্টারে একটি পজ মেশিনের মাধ্যমে যাত্রীরা টিকেট কেটে গাড়িতে উঠছেন। হেলপারদের সঙ্গে ভাড়া নিয়ে প্রতিনিয়তই বিবাদ হতো। কিন্তু ই-টিকিটিংয়ের ফলে এখন ঝামেলা হবে না। এই প্রজেক্টে সফলতা আসলে পরে পুরো ঢাকা শহরেই গণপরিবহনে ই-টিকেটিং সিস্টেম চালু হয়ে যাবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু রাজধানীজুড়ে এভাবে ফিটনেসহীন লক্কড়-ঝক্কড় গাড়ি চলতে থাকলে এই মহৎ উদ্যোগ নষ্ট হয়ে যাবে বলে জানান তারা।
এমন অবস্থার প্রেক্ষিতে ঢাকা মহানগরে চলাচলরত যানবাহনগুলো ক্রটিমুক্ত করার নির্দেশ দিয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)। আগামী ৩০ নভেম্বরের মধ্যে এটি বাস্তবায়ন না হলে, মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। গতকাল শুক্রবার বিআরটিএর সদর কার্যালয়ের এক জরুরি গণবিজ্ঞপ্তিতে তথ্য জানানো হয়। এতে বলা হয়, গণপরিবহনের সৌন্দর্যের ওপর নগরের সৌন্দর্য ও দেশের ভাবমূর্তি অনেকাংশে নির্ভর করে। লক্ষ্য করা যাচ্ছে কিছু বাস-মিনিবাসের রঙচটা, জরাজীর্ণ, জানালা-দরজার কাঁচ ভাঙা, সামনে-পেছনের লাইট ভাঙা।
কোনো কোনো বাস থেকে কালো ধোঁয়াও নির্গমন হচ্ছে। এছাড়া কিছু বাস-মিনিবাসে ভেতরে ফ্যান থাকলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে তা ভাঙা ও অচল দেখা যায়। সিটের কভারও অপরিষ্কার। অস্বাস্থ্যকর ও ত্রুটিযুক্ত যানবাহনে যাত্রীদের চলাচলে নানাবিধ ভোগান্তির সৃষ্টি হচ্ছে। সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ এর ধারা-২৫ অনুযায়ী ত্রুটিমুক্ত যানবাহন চলাচলের বাধ্যবাধকতা এবং এর ব্যত্যয়ে আইনের ধারা ৭৫ অনুযায়ী কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান রয়েছে। এ অবস্থায়, সংশ্লিষ্ট মোটরযান মালিকদের আগামী ৩০ নভেম্বর মধ্যে রঙচটা, জরাজীর্ণ, জানালা-দরজার কাঁচ ভাঙা, সামনে-পেছনের লাইট ভাঙা, কালো ধোঁয়া নির্গমনকারী ত্রুটিপূর্ণ বাস-মিনিবাসগুলো ত্রুটিমুক্ত করতে অনুরোধ করা যাচ্ছে। অন্যথায়, আগামী ৩০ নভেম্বরের পর মোবাইল কোর্ট পরিচালনার মাধ্যমে এসব যানবাহনের বিরুদ্ধে কঠোর আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
তবে এ বিষয়ে সেভ দ্য রোড জানায়, চলমান সময়ে সড়ক পথ দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ ফিটনেসহীন বাহন যার পরিমাণ সেভ দ্য রোডের গবেষণা সেল ও সেচ্ছাসেবীদের মতে ৩৬ শতাংশ। বিআরটিএ চাইলে এর পরিমাণ আশানুরূপ কমিয়ে ফেলতে পারতো। এই অভিযান মালিক সমিতির কাছ থেকে তাদের বাস ডিপো অথবা বাস রাখার যে স্থানগুলো রয়েছে তা সংগ্রহ করে সেখানে গিয়ে অভিযানটি পরিচালনা করে। সেভ দ্য রোডের পক্ষ থেকে একটি দাবী, ফিটনেসলেস বাহনগুলোকে যেন কোনভাবেই আর মালিক পক্ষ ব্যবহার করতে না পারে সেদিক বিবেচনা করে সেগুলোকে স্থায়ীভাবে অচল করে দেয়া হয়। সর্বোপরি কোনভাবেই যেন বিআরটিএর কর্মকর্তা-কর্মচারী বা সংশ্লিষ্ট কেউ মালিকদের সাথে আঁতাত করে এই প্রক্রিয়াটি অকার্যকর করে দিতে না পারে সেদিকে বিশেষ নজরদারি রাখতে হবে পুলিশ প্রশাসনের উর্ধতন কর্তৃপক্ষ ও দুদকের।
জানা যায়, ঢাকার রাস্তায় চলাচলকারী কতটি বাসের রুট পারমিট নেই তার সঠিক পরিসংখ্যান কারো কাছে নেই। একেকটি রুটে কোন পরিবহনের কতটি বাস চলার কথা আর কতটি চলছে সেই হিসাবও নেই। বিভিন্ন সময়ে নানা কারণে কোনো কোনো রুটের বাসের রুট পারমিট বাতিল করার পর সেই বাস রাস্তায় চলছে অন্য কোনো পরিবহন কোম্পানির নামে। প্রশিক্ষিত চালক তৈরির উদ্যোগ শুধু কাগজে-কলমে। রাস্তায় থামানোর জায়গা সুনির্দিষ্টকরণে উদ্যোগ নেয়া হলেও নির্ধারিত বাসস্ট্যান্ডে বাস থামছে না। সড়ক-মহাসড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করা হলেও সুফল মিলছে না। একেকটি দুর্ঘটনার পর ছাত্র আন্দোলনের মুখে তদন্ত কমিটি গঠন করা হলে তাদের করা সুপারিশ বাস্তবায়নের নজির নেই।
যাত্রীদের অভিযোগ, রাজধানীতে লক্কড়-ঝক্কড় ফিটনেসহীন গাড়ি চললেও এগুলোর বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছেনা। কোনো কোনো সময় কয়েকটি বাসকে অভিযানে আটক করলেও এসব বাসের দৌরাত্ম্য কমছেনা। ঢাকার সব রুটেই এসব বাস চলতে দেখা যায়। সাধারণ যাত্রীরাও জরুরি প্রয়োজনে গন্তব্যে যেতে হবে বলে এসব বাসে উঠতে বাধ্য হয়।
সেভ দ্য রোডের মহাসচিব শান্তা ফারজানা ইনকিলাবকে বলেন, অতীতেও বিআরটিএর এমন অনেক ঘোষণা শুনেছি যা কখনো তারা কার্যকর করতে পারেনি। অতীতের মতো এবারের এই ঘোষণাও যেন অকার্যকর না হয় সে বিষয়ে লক্ষ রাখতে হবে। পাশাপাশি আরো একটি কথা বলে রাখতে চাই, তা হলো ম্যাজিস্ট্রেট টিম রাস্তায় গাড়ি বের হওয়ার পর যেন এই অভিযান না চালায়। এই অভিযান মালিক সমিতির কাছ থেকে তাদের বাস ডিপো অথবা বাস রাখার যে স্থানগুলো রয়েছে তা সংগ্রহ করে সেখানে গিয়ে অভিযানটি পরিচালনা করে। তাতে করে এই অভিযানের কারণে চলমান বাসে থাকা সাধারণ যাত্রীদের ভোগান্তি থেকে রেহাই মিলবে।
বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী ইনকিলাবকে বলেন, অতীতেও আমরা দেখেছি বিআরটিএ ফিটনেসবিহীন ও লক্কড়-ঝক্কড় গাড়ির বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করেছে। কিন্তু এতে কাজ তেমন হয়নি। তাদেরকে কৌশল পরিবর্তন করতে হবে। কৌশল পরিবর্তনের মাধ্যমে ব্যবস্থা নিতে হবে। ২০০৮ সালে বিশ বছর আগের গণপরিবহন উঠিয়ে দেয়ার কথা বলা হয়। ২০১৫ সালে এসে আবার একই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু গণপরিবহনের চেহারা পরিবর্তন হয় না। যানজট, জনজট ও জনগণের ভোগান্তি কমানো কর্মপরিকল্পনা নিতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন