গ্রেটার ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রকল্পের আওতায় বাস র্যাপিড ট্রানজিট বা বিআরটি নির্মাণ করা হচ্ছে গাজীপুর থেকে শাহজালাল বিমানবন্দর পর্যন্ত। চীনের তিনটি এবং বাংলাদেশের একটি কোম্পানি এই প্রকল্পের ঠিকাদার হিসেবে কাজ করছে। এ সেবা পরিচালনার জন্য ৪২০ কোটি টাকায় ১৩০টি বিলাসবহুল বাস কিনতে চায় সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়।
প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুযায়ী, এই রুটে ৫৮ কোটি টাকায় ৫০টি বাস কেনার কথা ছিল। কিন্তু গত বছরই সে পরিকল্পনা বাদ দেয় সরকার। এক দশক ধরে চলমান বিআরটি প্রকল্পের তৃতীয় সংশোধনী প্রস্তাব যদি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) অনুমোদন পায়, তাহলে বাস ক্রয়ের মূল্য সাত গুণেরও বেশি বেড়ে যাবে। বিআরটি প্রকল্পের তৃতীয় সংশোধিত প্রস্তাব অনুসারে, প্রতিটি বাস ক্রয়ে ব্যয় হবে ৩ কোটি ২৩ লাখ টাকা। প্রতিটি বাসের জন্য আগের প্রাক্কলনের তুলনায় খরচ বাড়বে ১৭৭ শতাংশ।
জানা গেছে, মূল প্রকল্পটিতে ইন্টেলিজেন্ট ট্রান্সপোর্টেশন সিস্টেম (আইটিএস), জিপিএস এবং টিকিটিংয়ের অনুষঙ্গ সংগ্রহের জন্য ৬৭ দশমিক ৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ ছিল। অন্যদিকে, সিসিটিভি, ট্রাফিক লাইটসহ ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন সরঞ্জাম সংগ্রহের জন্য বরাদ্দ ছিল ২৪ দশমিক ১৬ কোটি টাকা। বিআরটি কোম্পানি ৯১ দশমিক ৬৬ কোটি টাকার এ দুটি খাতকে ২০০ কোটি টাকা মূল্যের একটি গ্রুপে নিয়ে এসেছে, যা মূল বরাদ্দের চেয়ে ১১৮ শতাংশ বেশি। প্রস্তাবনা থেকে আরো জানা গেছে টোয়িং ট্রাক, এমিশন টেস্টিংসহ ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের জন্য বিভিন্ন সরঞ্জাম সংগ্রহে সংশোধিত প্রস্তাবে ২২ দশমিক ১ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে, যা শুরুর ১০ দশমিক ৫২ কোটি টাকার চেয়ে দ্বিগুণেরও বেশি। তাছাড়া, সৌর লাইটের জন্য খরচ হয়েছে ৬৫ কোটি টাকা, যা মূল বরাদ্দ ২০ দশমিক ৯৭ কোটি টাকার তিনগুণ।
প্রকল্প সংশোধন প্রস্তাবের বিশ্লেষণে দেখা গেছে, সরকারকে এ প্রকল্পে অতিরিক্ত ৫২৬ কোটি টাকা ব্যয় করতে হবে, যা মূল বরাদ্দের চেয়ে ২৯০ শতাংশ বেশি। প্রকল্প বাস্তবায়নে অদক্ষতা, কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তহীনতা আর বিআরটি পরিচালনার মতো অভিজ্ঞ জনবলের অভাবে প্রকল্পটির কেনাকাটায় ব্যয় বাড়ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, করিডোরটি উন্নয়নে কর্তৃপক্ষের যতটা আগ্রহ রয়েছে, এর কয়েক গুন বেশি আগ্রহ কেনাকাটায়। অপরিকল্পিত সিদ্ধান্তে সম্পদ কেনাকাটা করা হলে তা দায়ে পরিণত হতে পারে বলে আশঙ্কা তাদের।
বুয়েটের সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যপক ও গণপরিবহণ বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল হক বলেন, বিশ্বের সবচেয়ে সহজ ও সাশ্রয়ী আপদকালীন পরিবহণ ব্যবস্থা হিসেবে বিআরটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছিল। প্রকল্প বাস্তবায়নের শেষ পর্যায়ে এসে বলা হচ্ছে, ৫০ বাসের যায়গায় ১৫০টি বাস কেনা হবে। এই বাড়তি বাস কোথায় রাখা হবে, চালানোই বা হবে কোথায়?
ঢাকা বিআরটি কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সফিকুল ইসলাম এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন, সিএনজি ও বৈদ্যুতিক মিলিয়ে মোট ১৩০টি বাস কেনা হবে। আধুনিক ও বিলাসবহুল বাস কেনায় ব্যয় একটু বেশি লাগবে বলেও তিনি জানান। তবে এই বাসগুলো কোথায় রাখা হবে, কত মিনিট পর পর চালনা করা হবে, আর আগের পরিকল্পনা অনুযায়ী তিন মিনিট পর পর বাস ছাড়লে মোট কতটি বাস লাগবে, এ বিষয়ে তিনি বলেন, বাসের বিষয়ে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি।
এদিকে, উত্তরায় গার্ডার দুর্ঘটনা ক্ষতিপূরণেই পার পাবে চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। রাজধানীর উত্তরার জসীমউদ্দীন মোড়ে গার্ডার স্থানান্তরের সময় ক্রেন কাত হয়ে প্রাইভেট কারের ওপর পড়ে ৫ জন নিহত হন গত ১৫ আগস্ট। ঘটনার দিনই তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। প্রথমিক তদন্তে দুর্ঘটনার পরপরই চুক্তি বাতিল করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না গেঝুবা গ্রুপ কোম্পানি লিমিটেডকে কালো তালিকাভুক্ত করার কথা বলা হয়। কিন্তু শেষমেশ সে পথে যাচ্ছে না সরকার। প্রায় এক মাস বন্ধ থাকার পর আবারো শুরু হয়েছে কাজ।
গ্রেটার ঢাকা সাসটেইনেবল আরবান ট্রান্সপোর্ট প্রকল্পের (বিআরটি) আওতায় প্রায় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বাস র্যাপিড ট্রানজিট বা বিআরটি নির্মাণ করা হচ্ছে গাজীপুর থেকে শাহজালাল বিমানবন্দর পর্যন্ত। চীনের তিনটি এবং বাংলাদেশের একটি কোম্পানি এই প্রকল্পের ঠিকাদার হিসেবে কাজ করছে। উত্তরার যে এলাকায় ওই দুর্ঘটনা ঘটেছে, সেই অংশের কাজ করছে ঠিকাদার কোম্পানি চায়না গ্যাঝুবা গ্রুপ করপোরেশন (সিজিজিসি)।
দুর্ঘটনার দিনই সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব নীলিমা আখতারকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি করা হয়েছিল। প্রাথমিক প্রতিবেদনে কমিটি বলেছে, দুর্ঘটনার পেছনে চীনা ঠিকাদার কোম্পানি সিজিজিসির ‘গাফিলতি’ পাওয়া গেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঠিকাদারের চুক্তি বাতিল হলে প্রকল্প ঝুলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। নতুন করে দরপত্র প্রক্রিয়ায় গেলে প্রকল্প পিছিয়ে যেতে পারে ৩-৪ বছর। চীনের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতিরও আশঙ্কা রয়েছে। তাই শাস্তি না দিয়ে ঠিকাদারের কাছে নিহতের জন্য ক্ষতিপূরণ দাবি করেছে সড়ক ও জনপথ অধিদফতর (সওজ)। আর এ ক্ষতিপূরণের টাকা নেয়া হবে বীমার মাধ্যমে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন