শুক্রবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১, ১২ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

পোশাক কারখানায় ‘সবুজ’ বিপ্লব

ইতিহাসে ৩য় বৃহত্তম শিল্প দুর্ঘটনা ‘রানা প্লাজা’ ধসের পর সবকিছু বদলে গেছে বিশ্বের শীর্ষ ১০০ সবুজ কারখানার অর্ধেকই বাংলাদেশের হ বিশ্ব দরবারে বাড়ছে দেশের ভাবমর্যাদা হ উদ্যোক্তাদের পর

হাসান সোহেল | প্রকাশের সময় : ১৬ অক্টোবর, ২০২২, ১২:০০ এএম

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল, সকাল ৮:৪৫। রাজধানীর পার্শ্ববর্তী সাভার বাসস্ট্যান্ডের পাশে রানা প্লাজা নামের একটি বহুতল ভবন ধসে পড়ে। ভবনের কয়েকটি তলা নিচে ডেবে যায়। কিছু অংশ পাশের একটি ভবনের ওপর পড়ে। এ দুর্ঘটনায় এক হাজার ১৭৫ জন শ্রমিক নিহত এবং দুই হাজারেরও বেশি মানুষ আহত হয় যা বিশ্বের ইতিহাসে ৩য় বৃহত্তম শিল্প দুর্ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। রানা প্লাজা ধসের পর দেশের নিটওয়্যার ও গার্মেন্ট শিল্পে কিছুটা ভাটা পড়েছিল। বিদেশি ক্রেতাদের কাছে আস্থা সঙ্কটে পড়েছিল এই খাত। ফলে বাংলাদেশের নীটওয়্যার ও গার্মেন্ট কারখানার মালিকরা একে একে গড়ে তোলেন পরিবেশবান্ধব সবুজ কারখানা। তৈরি পোশাক খাতে সবুজ কারখানা নির্মাণের ধারণা দিন দিন জনপ্রিয়তা পাচ্ছে। এতে বিশ্ব দরবারে পোশাক শিল্পের তথা দেশের ভাবমূর্তি দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলেন, পরিবেশবান্ধব সবুজ কারখানা স্থাপনে সাধারণ কারখানা থেকে খরচ বেশি হয়, কিন্তু দীর্ঘ মেয়াদে তা কারখানার মালিক ও শ্রমিক উভয়ের জন্য লাভজনক। এতে শতকরা ২৪ শতাংশ জ্বালানি সাশ্রয় হয়। আবার ৫০ শতাংশ পানির অপচয়ও রোধ হয়। এর পাশাপাশি কারখানার পরিবেশ সুন্দর হয়, এর সঙ্গে শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসেবা, নিরাপত্তা বজায় থাকলে পোশাক উৎপাদনও বৃদ্ধি পায়।

সূত্র মতে, তৈরি পোশাকশিল্পে পরিবেশবান্ধব ও নিরাপদ কারখানার তালিকায় বিশ্বে বাংলাদেশ এখন উদাহরণ। মাত্র এক দশকের ব্যবধানে এ খাতের কর্মপরিবেশে আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। অথচ এক দশক আগেও দেশে পরিবেশবান্ধব সবুজ কারখানার সংখ্যা ছিল মাত্র একটি। গতকালও নতুন করে তিনটি তৈরি পোশাক কারখানাকে স্বীকৃতি দিয়েছে ইউনাইটেড স্টেটস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল (ইউএসজিবিসি)। বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল গতকাল জানিয়েছেন, ভবানীপুর গাজীপুরের সিএ নিটওয়্যার লিমিটেড, বানিয়ারচলা গাজীপুরের সিলকেন সুইং লিমিটেড এবং মেহেরাবারি ময়মনসিংহের অবস্থিত সুলতানা সুয়েটার লিমিটেড প্লাটিনাম রেটিং পেয়েছে। এই নিয়ে এখন দেশে ‘সবুজ কারখানা’ সংখ্যা বেড়ে ১৭৬টিতে দাঁড়িয়েছে। এর আগে চলতি মাসের শুরুতে গাজীপুরের আমান টেক্সটাইল লিমিটেড পেয়েছে প্লাটিনাম রেটিং এবং রাজধানীর আয়েশা ফ্যাশন লিমিটেড পায় গোল্ড রেটিং।

মহিউদ্দিন রুবেল জানান, গাজীপুরের সিএ নিটওয়্যার লিমিটেডকে ১০ অক্টোবর স্বীকৃতি দিয়েছে ইউএসজিবিসি। তারা প্রতিষ্ঠানটিকে ৮৭ পয়েন্ট দিয়েছে। বানিয়ারচলা গাজীপুরের সিলকেন সুইং লিমিটেডকে ১১ অক্টোবর স্বীকৃতি দিয়েছে ইউএসজিবিসি। তারা প্রতিষ্ঠানটিকে ৯২ পয়েন্ট দিয়েছে। মেহেরাবারি ময়মনসিংহের সুলতানা সুয়েটার লিমিটেডকে ১২ অক্টোবর স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি পেয়েছে ৮১ পয়েন্ট। ‘সবুজ পোশাক কারখানা’ ভবনে বিশ্বে শীর্ষ স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। ৫৭টি কারখানা প্লাটিনাম রেটিং, ১০৫টি গোল্ড রেটিং ও ১০টি সিলভার রেটিং পেয়েছে। এছাড়া চারটি কারখানা সনদ পেয়েছে।
অনেক আগেই সবুজ কারখানার তালিকায় বিশ্বে শীর্ষে অবস্থান করছে বাংলাদেশ। যা এই খাতের রফতানি বাড়াতে অবদান রাখছে বলে জানিয়েছেন রফতানিকারকেরা। তালিকায় বাংলাদেশের পরের অবস্থানে রয়েছে ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়া। ইতোমধ্যে বিশ্বের সবচেয়ে নিরাপদ ও সবুজ পোশাক কারখানার দেশ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলাদেশ। ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড সেন্টার (আইটিসি) তাদের সবশেষ অক্টোবর প্রকাশনায় বাংলাদেশকে এ স্বীকৃতি দিয়েছে। এদিকে বিশ্বের শীর্ষ ১০০ সবুজ কারখানার অর্ধেকের মতোই বাংলাদেশের।
সূত্র মতে, পরিবেশবান্ধব কারখানা স্থাপনার মধ্য দিয়ে রফতানি প্রবৃদ্ধির সঙ্গে ঘটছে সবুজ বিপ্লব। এর ফলে দেশের পোশাক শিল্পের প্রতি আবার আকৃষ্ট হচ্ছেন বিদেশি ক্রেতারা। সবুজ কারখানার ফলে কর্মসংস্থান হচ্ছে হবে লাখ লাখ মানুষের। আর শ্রমিকরা পাচ্ছেন আন্তর্জাতিক মানের সুযোগ-সুবিধা।

সবুজ পোশাক শিল্প স্থাপনে একসঙ্গে কাজ করছে সরকার, তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বিটিএমএ ও উদ্যোক্তারা। আমেরিকা থেকে ‘ইউনাইটেড স্টেটস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল (ইউএসজিবিসি)’ থেকে ধারণা নিয়ে দেশে গ্রিন ফ্যাক্টরি বা সবুজ কারখানা নির্মাণ করছেন উদোক্তারা। এসব কারখানা ওই কাউন্সিল থেকেই সার্টিফিকেট নিয়ে কাজ শুরু করেছে। সূত্র মতে, গ্রিন ফ্যাক্টরি করতে প্রচুর বিনিয়োগের প্রয়োজন। বিনিয়োগের এ পরিমাণ কারখানার আকার অনুযায়ী সর্বনিন্ম ৩০০ কোটি টাকা থেকে সর্বোচ্চ দেড় হাজার কোটি টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে।

২০০১ সাল থেকে লিড সনদ পাচ্ছে বাংলাদেশ। সংস্কার, জ্বালানি, পানি, বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ কয়েকটি মানদণ্ডের ভিত্তিতে কারখানাগুলোকে ‘সবুজ কারখানা’ স্বীকৃতি দেয় ইউএসজিবিসি। প্লাটিনাম, সিলভার, গোল্ড ও অনুমোদিত। এ সার্টিফিকেট নিয়ে অন্য উদ্যোক্তারাও আস্তে আস্তে গ্রিন ফ্যাক্টরির দিকে ঝুঁকছে। ফ্যাক্টরি স্থাপন করা হচ্ছে ক্রেতা এবং ইউএসজিবিসির সব ধরনের শর্ত মেনে।

সবুজ কারখানা নিয়ে তৈরি পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান জানান, গ্রিন ফ্যাক্টরি দেশের অর্থনীতিতে নতুনমাত্রা যোগ করেছে। এতে বিদেশি ক্রেতারা আকৃষ্ট হচ্ছেন। রফতানি বাড়ছে কয়েকগুণ। প্লামি ফ্যাশনসের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও নিট পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিকেএমইএ’র সাবেক সভাপতি ফজলুল হক বলেন, পরিবেশবান্ধব কারখানার সংখ্যার দিক দিয়ে আমাদের ধারেকাছেও নেই কোনো প্রতিযোগী দেশ। সাধারণত অন্যান্য স্থাপনার চেয়ে পরিবেশবান্ধব স্থাপনায় ৫ থেকে ২০ শতাংশ খরচ বেশি হয়। তবে বাড়তি খরচ হলেও দীর্ঘমেয়াদি সুফল পাওয়া যায়। পোশাকের দাম বেশি পাচ্ছেন কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, হাঁ, দাম একটু বেশি পাচ্ছি। তবে তা প্রত্যাশার চেয়ে কম।

বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, পোশাক খাতে কিছু অনাকাক্সিক্ষত দুর্ঘটনার পর আমরা শিল্পটিকে পুনর্গঠনের চ্যালেঞ্জ নেই। গত এক দশকে আমাদের উদ্যোক্তাদের অক্লান্ত পরিশ্রম, নিরাপত্তা খাতে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় এবং সরকার-ক্রেতা-উন্নয়ন সহযোগীদের সহায়তায় বর্তমানে বাংলাদেশের পোশাকশিল্প একটি নিরাপদ শিল্প হিসেবে বিশ্বে রোল মডেল হিসেবে নিজের অবস্থান তৈরি করেছে। তিনি বলেন, পরিবেশ ও শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়টিকে প্রাধান্য দিয়ে আমরা শিল্পে আমূল পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছি। আমাদের এই উদ্যোগ ও অর্জন বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত হয়েছে।

পরিবেশ বান্ধব সবুজ কারখানায় আসলে কী?
পরিবেশ বান্ধব সবুজ কারখানায় আসলে এমন একটি কারখানা যেখানে আন্তর্জাতিক সকল নিয়ম মেনে করা হয়। যে পরিমাণ জমির ওপর কারখানা হবে তার অর্ধেকটাই ছেড়ে দিতে হবে সবুজায়নের জন্য। সবুজ বাগান থাকবে। কারখানার চারপাশে খোলা জায়গা থাকবে। আর কারখানার ভেতরেও থাকবে খোলা জায়গা। শ্রমিকদের কাজের পরিবেশ থাকবে সুন্দর। এক শ্রমিক থেকে অন্য শ্রমিকের দূরত্বও থাকবে বেশ। এছাড়া সব কিছুই অটোমেশনে হবে। মেশিনারিজ হবে অত্যাধুনিক। ৭০ শতাংশ বিদ্যুৎ সাশ্রয়ী হবে। থাকবে সোলার প্যানেল, এলইডি লাইট। এছাড়া পানি রিসাইক্লিং হবে। শ্রমিকদের সুযোগ-সুবিধা : আন্তর্জাতিক নিয়ম অনুযায়ী শ্রমিকরা সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাবেন। কারখানার ভেতরে আবাসন ব্যবস্থা থাকবে। শ্রমিকদের যাতায়াতের জন্য থাকবে বিশেষ সুবিধা। চিকিৎসা ভাতাসহ রেশনিংয়েরও ব্যবস্থা থাকবে।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন