বৃহস্পতিবার ২১ নভেম্বর ২০২৪, ০৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৮ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

আমদানি পণ্য খালাসে বিলম্ব

বন্দর ও কাস্টম হাউস হয়রানিতে আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা ষ ঘুষের বিনিময়ে কোটি কোটি টাকার চোরাই পণ্য দ্রুত খালাস করা হচ্ছে, রাজস্ব বঞ্চিত হচ্ছে সরকার ষ পণ্য খালাস করতে বেশি সময় লাগার ক

অর্থনৈতিক রিপোর্টার | প্রকাশের সময় : ২১ অক্টোবর, ২০২২, ১২:০১ এএম

দেশের প্রধান দুই বন্দর ও কাস্টম হাউসে আমদানি পণ্যের চালান আসার পর তা খালাসে গড়ে ১০ দিন সময় লাগে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় চট্টগ্রাম কাস্টম হাউসে পণ্যের চালান খালাসে শুল্কায়ন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে ১১ দিন ৬ ঘণ্টা ২৩ মিনিট সময় লেগে যাচ্ছে। আর বেনাপোল স্থল বন্দরে সময় লাগছে ১০ দিন ৮ ঘণ্টা ১১ মিনিট। আর ঢাকা কাস্টম হাউসে সময় লাগে ৭ দিন ১১ ঘণ্টা ১৯ মিনিট। এ তথ্য জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) নিজস্ব গবেষণার। যদিও বাস্তবে অধিকাংশ পণ্য খালাসে সময় লাগে ১ মাসেরও বেশি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে কয়েক মাসও লেগে যাচ্ছে। আবার ঘুষ দিলে অবৈধ পণ্যও খালাস হয়ে যাচ্ছে দ্রুত। আর এতে বিপাকে পড়ছে আমদানিকারকরা। হযরত শাহজালাল বিমানবন্দরের কার্গো ভিলেজ ঢাকা কাস্টম হাউসকে কেন্দ্র করে চলছে লুটপাট, অনিয়ম আর দুর্নীতি। চলছে রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে চোরাই পণ্য খালাসের মহোৎসব। মোটা অঙ্কের ঘুষ না দিলে প্রকৃত ব্যবসায়ীদের নানা হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের দাবিকৃত টাকা না পেলে ব্যবসায়ীদের পণ্য মাসের পর মাস আটক রাখা হচ্ছে। তাদের হাতে এখন ব্যবসায়ীরা জিম্মি। তবে ঘুষের বিনিময়ে কোটি কোটি টাকার চোরাই পণ্য ঠিকই দ্রুত খালাস করে দেয়া হচ্ছে। ফলে সরকার প্রতি বছর কয়েক শ’ কোটি টাকার রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। আমদানিকারক ও ব্যবসায়ীরা দীর্ঘদিন থেকেই পণ্য শুল্কায়ন ও খালাসে আমদানিকারক এবং ব্যবসায়ীদের হয়রানি বন্ধ করার দাবি জানিয়ে আসছেন। একই সঙ্গে বন্দর ও কাস্টমসের সক্ষমতা বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন। তাদের মতে, এটা না হলে দেশ ধীরে ধীরে অন্য দেশের সঙ্গে ব্যভসা-বাণিজ্য সক্ষমতায় পিছিয়ে পড়বে। একই সঙ্গে আমদানিকারকদের ক্ষতি মানে দেশের ক্ষতি বলে উল্লেখ করেন তারা। অবশ্য সম্প্রতি এনবিআর’র এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে দেশের প্রধান বন্দরগুলো থেকে আমদানি পণ্য খালাসের সময় কমিয়ে আনতে আধুনিক যন্ত্রপাতি সংযোজন ও সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর পরামর্শ দেয়া হয়েছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, অনেক অসাধু ব্যবসায়ী যেমন আছেন, তেমনি অনেক কর্মকর্তাও আছেন অসাধু। কিন্তু সবাই অসৎ নন। ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি থাকলেই দেশ এগিয়ে যাবে। স্মার্ট কাস্টম হাউসই আমাদের কাম্য। চীন, কোরিয়া, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনামের মতো দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হচ্ছে আমাদের। তাই কাস্টম হাউসে পণ্য শুল্কায়ন ও খালাস কাজ দ্রুততম সময়ের মধ্যে করতে হবে। হয়রানি বন্ধ করতে হবে। আবার অনেকের মতে, হয়রাণি করে শুধু কর আদায় করে বিশ্বে কোনো দেশের উন্নত হওয়ার নজির নেই। বাণিজ্য সুবিধা বাড়ানোর মাধ্যমেই দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইর সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেছেন, বন্দর বা কাস্টমস হাউস থেকে পণ্য খালাস করতে বেশি সময় লাগার কারণে খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এফবিসিসিআইর সভাপতি বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরে আমদানি করা পণ্যের পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য ঢাকায় পাঠাতে হয়। এতে পণ্য খালাস করতে দীর্ঘ সময় লেগে যায়, যা ব্যবসার খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে এবং উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। পরিস্থিতির উন্নয়নে বন্দরে টেস্টিং ল্যাব স্থাপন জরুরি। এফবিসিসিআইর সহ-সভাপতি মো. হাবীব উল্লাহ ডন বলেন, পণ্য পরীক্ষায় ত্রুটি না পেলেও বন্দরে ১৫ থেকে ২০ দিন পণ্য আটকে থাকার ফলে বন্দরের চার্জ যেমন বাড়ে, তেমনি দেরিতে পণ্য বিক্রির কারণে লোকসানও গুনতে হয় ব্যবসায়ীদের।

সূত্র মতে, প্রায় ৯ বছর আগে এনবিআর কাস্টমস বিভাগকে ‘কাগজবিহীন’ বা পেপারলেস করার ঘোষণা দিয়েছিলেন সাবেক অর্থমন্ত্রী মরহুম আবুল মাল আবদুল মুহিত। তাতে ব্যবসায়ীরা হয়রানিমুক্ত পরিবেশে ও কম সময়ে রফতানিপণ্য খালাস করতে পারবেন। তার বাস্তবায়ন দৃশ্যমান হয়নি এখনও। কাস্টমস বিভাগের অধীনে দেশের কাস্টমস হাউস ও শুল্ক স্টেশনগুলো চলছে প্রচলিত প্রথায় ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে। ব্যবসায়ীরা বলেছেন, শুল্কায়ন প্রক্রিয়া সহজীকরণ হচ্ছে, তবে ধীরগতিতে। এখনও ব্যবসায়ীদের হয়রানির শিকার হতে হয়, বিশেষ করে পণ্যের শ্রেণীকরণ বা এইচএস কোড নিয়ে। অথচ পাশের ভারতসহ বিশ্বের ৯০টি দেশে কাস্টমস বিভাগের পণ্যের অ্যাসেসমেন্ট থেকে শুরু করে শুল্কায়নের সব কার্যক্রম কাগজ ছাড়া স্বয়ংক্রিয়ভাবে পরিচালিত হচ্ছে।

সরেজমিনে আমদানিকারক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পণ্য খালাস প্রক্রিয়ায় ধাপে ধাপে হয়রানির শিকার হচ্ছেন তারা। হয়রানি থেকে বাঁচতে স্বনামে বক্তব্য দিতেও অস্বীকৃতি জানান তারা। কোনো কারণে প্রতিষ্ঠানের পরিচয় প্রকাশ পেলে পণ্য খালাসে তাদের হয়রানি আরও বেড়ে যাবে বলে মনে করছেন তারা।

চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে প্রতি মাসে শতকোটি টাকার পণ্য খালাস করা এক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক বলেন, সব কাগজপত্র ঠিক থাকার পরও প্রতি কনটেইনার পণ্য শুল্কায়ন করতে অন্তত ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা স্পিডমানি দিতে হয়। কোনো কারণে ডকুমেন্টে ছোটখাটো ভুল থাকলে এ স্পিডমানির পরিমাণ বেড়ে যায় অন্তত তিনগুণ।
আমদানিকারকের প্রতিনিধি হিসেবে কাস্টম হাউসে কাজ করা এক সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট বলেন, ঘুষ ছাড়া ফাইল নড়ে না কাস্টম হাউসে। সহকারী কমিশনার থেকে ওপরের লেভেলে ঘুষের পরিমাণ কম থাকলেও নিচের লেভেলে এটি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। বন্দরের জেটি শাখা ও কাস্টম হাউসের সংশ্নিষ্ট গ্রুপেই লেনদেন হয় ঘুষের ৮০ শতাংশ অর্থ।

সিঅ্যান্ডএফ এজেন্টদের মতে, পণ্য নিয়ে জাহাজ আসার পর অনলাইনে বিল অব এন্ট্রি (আগাম চালান) দাখিল করতে হয় কাস্টম হাউসের অটোমেশন সিস্টেমে। এরপর আইজিএম, ইনভয়েস, প্যাকিং লিস্ট, এলসি কপি, এলসিএ, ইন্স্যুরেন্স কপি, মেরিন পলিসি, কান্ট্রি অব অরিজিন সনদ ও বিল অব এক্সচেঞ্জের মূল কপি নিয়ে সশরীরে যেতে হয় সংশ্লিষ্ট গ্রুপের অ্যাপ্রেইজারের কাছে। এখানে যাচাই-বাছাই শেষে বন্ডের পণ্য হলে ফাইল পাঠানো হয় জেটির ওয়ান স্টপ সার্ভিস পয়েন্টে। ডেলিভারির সম্ভাব্য তারিখ নির্ধারণ করে ফাইল নিতে হয় সহকারী কমিশনারের কাছে। তিনি পণ্য পরীক্ষার জন্য কর্মকর্তা নিয়োগ দেন। এ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে বিভিন্ন পয়েন্টে ঘুষ দিতে হয় ২ থেকে ৫ হাজার টাকা। এরপর বন্দর নিয়োজিত ইয়ার্ড ক্লার্কের সঙ্গে যোগাযোগ করে কনটেইনার খোলার অনুমতি নিতে হয়। ইয়ার্ডে থাকা এএসআই থেকে নিতে হয় সিলগালা কার্ড। এরপর কার্পেন্টার দিয়ে খোলা হয় কনটেইনার। কাস্টমস কর্মকর্তারা কনটেইনারে থাকা পণ্য পরীক্ষা করে জেটি কাস্টম থেকে দেন পরীক্ষার রিপোর্ট। এসব প্রক্রিয়ায় জেটিতে বিভিন্ন ধাপে ঘুষ দিতে হয় ৫ থেকে ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত। কোনো কারণে পরীক্ষণে পণ্যের কান্ট্রি অব অরিজিন কিংবা এইচএস কোড নিয়ে সন্দেহ হলে ঘুষের এ টাকা বেড়ে যায় পাঁচ থেকে ছয়গুণ। জেটি থেকে পরীক্ষণ রিপোর্ট নিয়ে আবার যেতে হয় কাস্টম হাউসের সংশ্লিষ্ট গ্রুপে। সেখান থেকে ফাইল যায় বন্ড আউটপাস গ্রুপে। এরপর সহকারী কমিশনার শুল্কহার নির্ধারণ করে দিলে ফাইল আবার আসে গ্রুপে। এখানে পুনরায় যাচাই-বাছাই শেষে ব্যাংকে শুল্কহার জমা দিলে দেয়া হয় পণ্য খালাসের ফাইনাল ছাড়পত্র। এসব প্রক্রিয়ার বিভিন্ন পর্যায়ে কাস্টম হাউসে দিতে হয় পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকা। কোনো কারণে ফাইলে ত্রুটি থাকলে এখানেও ঘুষের অঙ্ক বেড়ে যায় তিন থেকে পাঁচগুণ। এভাবে শুল্কায়ন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপে আমদানি পণ্য খালাস করতে ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা গুনতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। অটোমেশন প্রক্রিয়া পূর্ণাঙ্গ থাকলে হয়রানির পাশাপাশি ঘুষের ধাপও অনেক কমত বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা।
ঢাকা চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি শামস মাহমুদ বলেন, পণ্যটি কোন শ্রেণির, তা নির্ধারণ নিয়ে কাস্টমস কর্মকর্তাদের সঙ্গে আমদানিকারকের প্রায়ই বাগবিতণ্ডা হয়। এতে করে পণ্য খালাসে কালক্ষেপণ হয়। এই জটিলতা নিরসন হওয়া জরুরি বলে মনে করেন তিনি। এনবিআরের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, একটি কাস্টমস হাউসে গড়ে দৈনিক তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার নথি ব্যবহার করা হয়। সব কাস্টম হাউস পুরোপুরি অটোমেটেড বা স্বয়ংক্রিয় হলে কাগজের কোনো ফাইল থাকবে না। এতে করে পণ্য খালাসের সময় বাঁচবে। কমবে দুর্নীতি। গতিশীল হবে দেশের আমদানি-রফতানি বাণিজ্য।

ইকোনমিক রিপোর্টার্স ফোরামের (ইআরএফ) সাধারণ সম্পাদক এস এম রাশিদুল ইসলাম ইনকিলাবকে বলেন, পদ্মা সেতু ও পায়রা বন্দর চালু হওয়া এবং মোংলা বন্দরের কার্যক্রম বাড়ার কারণে অর্থনীতিতে নতুন সুযোগ তৈরি হচ্ছে। এসব সম্ভাবনা কাজে লাগাতে বন্দর অবকাঠামোর উন্নয়ন করা দরকার। বিশেষ করে চট্টগ্রাম বন্দরের নতুন জেটি তৈরি করা জরুরি। পাশাপাশি কাস্টমস হাউজগুলোকেও দেশের স্বার্থে দ্রুত পণ্য খালাসে দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে। এছাড়া সব কাস্টম হাউসকে পুরোপুরি অটোমেটেড বা স্বয়ংক্রিয় করতে পারলে আমদানিকারদের হয়রানি কমবে বলে উল্লেখ করেন তিনি।

উল্লেখ্য, বর্তমানে এনবিআরের অধীনে চট্টগ্রামসহ বড় কাস্টম হাউস রয়েছে ছয়টি। আর ছোট শুল্ক স্টেশন ১৮৪টি। এর মধ্যে সক্রিয় শুল্ক স্টেশনের সংখ্যা ৩৭টি। চট্টগ্রাম কাস্টম হাউস, কমলাপুর আইসিডি ও ঢাকা কাস্টম হাউস আংশিক অটোমেটেড চালু হলেও বাকিগুলো এর বাইরে এখনও।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন