রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে আগামী বছর উৎপাদন শুরু হলে দেশে বিদ্যুৎ সঙ্কট থাকবে না দেশবাসীকে এ আশাবাদের কথা শুনিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, পাবনার রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের পরিবেশবান্ধব বিদ্যুতে উত্তর অঞ্চলের কর্মসংস্থান বাড়বে। আগামী ২০২৩ সালে বিদ্যুৎকেন্দ্রটির প্রথম ইউননিট এবং ২০২৪ সালে দ্বিতীয় ইউনিট উৎপাদনে যাবে। পরামাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে সেটা অত্যন্ত পরিবেশবান্ধব হবে। এটা আমাদের দেশের কোনো রকম ক্ষতিই করবে না। দেশের মানুষ খুব স্বচ্ছ একটা বিদ্যুৎ পাবে, দেশের বিদ্যুৎ সঙ্কট কেটে যাবে। যে বিদ্যুৎ তাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখবে। গতকাল বুধবার গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের দ্বিতীয় ইউনিটের মূল যন্ত্র রিঅ্যাক্টর প্রেসার ভেসেল (পারমাণবিক চুল্লি পাত্র) স্থাপনকাজের উদ্বোধন করতে গিয়ে তিনি দেশবাসীকে এই সুসংবাদ দেন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের লক্ষ্য ছিল, সবার জন্য আমরা বিদ্যুৎ দেবো। আমরা কিন্তু আমাদের কথা রেখেছি। বাংলাদেশের প্রত্যেক ঘরে ঘরে আমরা বিদ্যুৎ পৌঁছাতে পেরেছি। বাংলাদেশকে আলোকিত করতে পেরেছি। তবে বর্তমান বিশ্বে যে সমস্যাটা দেখা দিয়েছে, যুদ্ধাবস্থা, তার ওপর কোভিড এবং সমস্ত পরিবহন ব্যবস্থা থেকে শুরু করে মূল্যস্ফীতি, যার ফলে এখন উন্নত দেশগুলো হিমশিম খাচ্ছে। তারাও প্রতিটি ক্ষেত্রে সাশ্রয়ের দিকে নজর দিয়েছে। আমরাও, বাংলাদেশ সেদিক থেকে পিছিয়ে নেই। কারণ পৃথিবীটা এখন হচ্ছে একটা গ্লোবাল ভিলেজ। একে অপরের ওপর নির্ভরশীল। সে কারণে সারা বিশ্বে যখন অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয়, তার ধাক্কাটা; কিন্তু আমাদের ওপরও এসে পড়ে। তাই আমাদের কিছু সাশ্রয়ী হতে হচ্ছে, তার মানে এই না যে দেশের মানুষ বিদ্যুৎ পাবে না। মানুষ বিদ্যুৎ পাচ্ছে, পাবে। তবে এখানে সবাইকে একটু মিতব্যয়ী হতে হবে।
দেশের মানুষকে বিতব্যয়ী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাদের মিতব্যয়ী হতে হচ্ছে। আমরা বাধ্য হচ্ছি বর্তমান পরিস্থিতির কারণে। কারণ যে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে, তার ওপর বিভিন্ন দেশের ওপর স্যাংশন, এ স্যাংশন দেয়ার ফলে আরো বেশি সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে। আমি আশা করি, পৃথিবী এ রকম একটা অবস্থা থেকে খুব দ্রুত মুক্তি পাবে। তিনি আরো বলেন, আমরা চাই, আমাদের দেশের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নতি। সে জন্য আমরা যেমন একদিকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করে সেটা গ্রাম পর্যায়ে পৌঁছে দিচ্ছি। পাশাপাশি আমরা যোগাযোগ ব্যবস্থারও উন্নয়ন করছি। বিশেষ করে রূপপুর পাওয়ার প্রজেক্ট থেকে যে বিদ্যুৎ আসবে, আমাদের উত্তরবঙ্গের মানুষ; যেখানে চিরদিন মঙ্গা-দুর্ভিক্ষ লেগে থাকত। এই যে আশ্বিন-কার্তিক মাস এলেই সেখানে দুর্ভিক্ষ হতো। এখন সেগুলো আমরা দুর্ভিক্ষমুক্ত করতে পেরেছি। এ বিদ্যুৎকেন্দ্র যখন বিদ্যুৎ সরবরাহ করবে, তখন সেখানে মানুষের আরো কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। আর্থসামাজিক উন্নতি হবে। এটা হলো বাস্তবতা। আর সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমরা এ উন্নয়নমূলক কাজগুলো করে যাচ্ছি।
দেশকে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত থেকে রক্ষা করার উদ্যোগের কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পরমাণু শক্তি থেকে যে বিদ্যুৎ আসবে, তাতে পরিবেশের কোনো ক্ষতি হবে না। এখন যেমন জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বিশ্বের সবাই উদ্বিগ্ন, আমাদের; কিন্তু এ ব্যাপারে কোনো রকম ইমিশন হবে না। কোনো রকম পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না। সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব বিদ্যুৎ উৎপাদন করে দেশের মানুষকে দিতে পারব। আমরা এখনো আমাদের দেশটাকে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত থেকে রক্ষা করে চলছি। পরামাণু বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে, সেটা অত্যন্ত পরিবেশবান্ধব হবে। এটা আমাদের দেশের পরিবেশের কোনো রকম ক্ষতিই করবে না। বরং আমাদের দেশের মানুষ খুব স্বচ্ছ একটা বিদ্যুৎ পাবে। যে বিদ্যুৎ তাদের আর্থসামাজিক উন্নয়নে অবদান রেখে যাবে। মানুষের কর্মসংস্থান হবে। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে সহযোগিতা করায় পাবনা ও ঈশ্বরদীর মানুষকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে যারা দিনরাত কাজ করে যাচ্ছেন, তাদের ধন্যবাদ জানাই। পাবনা ও ঈশ্বরদীর জনগণকেও ধন্যবাদ জানাই। কারণ বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে তাদের কাছ থেকে আমরা সহযোগিতা পেয়েছি। একটা প্রকল্প করতে গেলে কিছু বাধার সম্মুখীন হতে হয়, কিন্তু এখানে সেটা হয়নি। এ ছাড়া এটা দীর্ঘদিনের একটা প্রকল্প, যা তাদের (পাবনাবাসী) জন্য গর্বের বিষয় বলে আমি মনে করি।
উল্লেখ, স্বাধীনতার পর গত ৫০ বছরের মধ্যে রূপপুর প্রকল্পই দেশের সবচেয়ে বড় এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে সর্বাধিক ব্যয়বহুল প্রকল্প। এটির কাজ সম্পন্ন হলে বাংলাদেশ হবে পারমাণবিক জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের অধিকারী বিশ্বের ৩৩তম দেশ। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এর ফলে প্রকল্পটি নির্ধারিত সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়েই এগিয়ে যাবে। ওই কেন্দ্রের যে যন্ত্রে নিউক্লিয়ার ফুয়েল (পারমাণবিক জ্বালানি) ইউরেনিয়াম থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়, তার মূল কাঠামো হচ্ছে এই বিশেষ যন্ত্র, পারমাণবিক চুল্লি। এটিকে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের হৃৎপিণ্ড বলা হয়।
রাশিয়ার সর্বাধুনিক প্রযুক্তি, আর্থিক ও প্রকল্প বাস্তবায়নসহ সার্বিক সহযোগিতায় পাবনার ঈশ্বরদীতে নির্মিত হচ্ছে দেশের প্রথম রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। এতে স্থাপন করা হচ্ছে রাশিয়ার উদ্ভাবিত সর্বশেষ প্রযুক্তি থ্রিজি (প্লাস) ভিভিইআর ১২০০ মডেলের রিয়াক্টর। রোসাটম প্রকৌশল শাখা এ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। দুটি ইউনিটে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২৩ সালের শেষদিকে প্রথম ইউনিট থেকে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট এবং ২০২৪ সালের শেষ দিকে দ্বিতীয় ইউনিট থেকে ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ বিদ্যুৎকেন্দ্রটি চালু হলে টানা ৬০ বছর কার্বননিঃসরণ ছাড়াই বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হবে। তবে অনেক ক্ষেত্রে পারমাণবিক এ বিদ্যুৎকেন্দ্রের আয়ুষ্কাল আরো ২০ থেকে ৩০ বছর বাড়ানো যায়। সে হিসাবে ৮০ থেকে ৯০ বছর পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন সম্ভব হবে। একই সঙ্গে প্রচলিত জ্বালানি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে যে খরচ হচ্ছে, তার চেয়ে অনেক সাশ্রয়ী মূল্যে এখান থেকে বিদ্যুৎ পাওয়া যাবে।
এর আগে গত বছরের ১০ অক্টোবর প্রথম ইউনিটের রিঅ্যাক্টর প্রেসার ভেসেল স্থাপন কার্যক্রমের উদ্বোধন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
পারমাণবিক চুল্লি পাত্র স্থাপনকাজের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী ইয়াফেস ওসমান। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির হিসেবে বক্তৃতা করেন রোসাটমের মহাপরিচালক আলেক্সি লিখাচেভ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সচিব জিয়াউল হাসান স্বাগত বক্তৃতা করেন। অনুষ্ঠানে নির্মাণাধীন বিদ্যুৎকেন্দ্রের ওপর একটি ভিডিও চিত্র পরিবেশিত হয়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন