বৈশ্বিক টালমাটাল পরিস্থিতির আঁচ লেগেছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও। গুরুত্বপূর্ণ ও স্পর্শকাতর সূচক রিজার্ভের পরিমান দিনের পর দিন কমছে। বেড়েই যাচ্ছে বাণিজ্য ঘাটতি। সেই ঘাটতি পূরণের পরিপূরক রেমিট্যান্স আহরণেও পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব। চলতি অর্থবছরের (২০২২-২৩) বড় আকৃতির বাজেট ঘোষণার পর রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্যমাত্রাও বেড়েছে। তবে বাড়েনি সে হিসেবে আদায়ের পরিমাণ। বাজেট বাস্তবায়নে চাপ বাড়ছে সরকারের। ফলে ব্যাংক থেকে সরকারের ঋণ নেওয়া বাড়বে, ব্যাহত হবে বেসরকারি খাতে ঋণ বিতরণ, বাধাগ্রস্ত হতে পারে বেসরকারি খাত, বাড়বে মূল্যস্ফীতি, যা মানুষের জীবনযাপনে দুর্ভোগ বয়ে আনবে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদরা। বড় লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে চাপ বাড়ছে রাজস্ব আদায়ে, সে হিসেবে আদায় হচ্ছে না রাজস্ব। এতে কঠিন চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
চলতি অর্থবছরে এনবিআরের কাঁধে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য রয়েছে। যদিও অর্থনীতিবিদরা এই লক্ষ্যমাত্রাকে অস্বাভাবিক বলেছেন। তাদের মতে, অর্থবছর শেষে বড় ধরনের ঘাটতি থাকবে। এনবিআরের পরিসংখ্যান বলছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) এনবিআর রাজস্ব আদায় করেছে ৬৭ হাজার ১০৪ দশমিক ৪৫ কোটি টাকা। লক্ষ্য ছিল ৭১ হাজার ১৭৮ দশমিক ৮৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ চার হাজার ৭৪ দশমিক ৩৯ কোটি টাকার মতো ঘাটতি রয়েছে।
সেপ্টেম্বর মাসে রাজস্ব আদায় হয় ২৬ হাজার ৮৩৩ দশমিক ৯৩ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরের একই মাসে আদায় হয় ২৪ হাজার ৯২২ দশমিক ৬৭ কোটি টাকা। রাজস্ব আদায়ের প্রবৃদ্ধি ৭ দশমিক ৬৭ শতাংশ। অথচ অর্থবছরের প্রথম দুই মাসে প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ২৩ শতাংশ।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে মূল্য সংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট সবচেয়ে বেশি আদায় হয়েছে। এ খাতে আদায় হয় ২৪ হাজার ৫৪৬ দশমিক ৬৫ কোটি টাকা। ঘাটতি হয়েছে ৯৫ দশমিক ৩৪ কোটি টাকা। এরপর আমদানি ও রফতানি পর্যায়ে শুল্ক-কর আদায় হয় ২২ হাজার ৪৫৪ দশমিক ৯৪ কোটি টাকা। এ খাতে ঘাটতি ২ হাজার ৫৮৮ দশমিক ৯১ কোটি টাকা। অন্যদিকে প্রথম তিন মাসে আয়কর খাতে আসে ২০ হাজার ১০২ দশমিক ৮৬ কোটি টাকা। এ খাতে লক্ষ্যের চেয়ে ১ হাজার ৩৯০ দশমিক ১৪ কোটি টাকা পিছিয়ে আছে এনবিআর। যদিও গত অর্থবছরের সেপ্টেম্বরের তুলনায় চলতি বছরের একই মাসে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হয়েছে ১৫ দশমিক ৬৫ শতাংশ। গত বছরের সেপ্টেম্বরে রাজস্ব আহরণের পরিমান ছিল ৫৮ হাজার ২৩ দশমিক ৫১ কোটি টাকা। চলতি বছরে যা ৬৭ হাজার ১০৪ দশমিক ৪৫ কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে।
ডলার সঙ্কটের কারণে পণ্য আমদানি কড়াকড়ি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এতে কমে গেছে পণ্য আমদানি। আর আমদানি কমায় শুল্ক আয় কমেছে। অপরদিকে সব ধরনের পণ্যের দাম চড়া। কিন্তু মানুষের আয় বাড়েনি। মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ায় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে। আর ক্রয়ক্ষমতা কমে যাওয়ায় মানুষের ভোগব্যয়ের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে। এরই প্রভাবে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে ভ্যাট আদায়ে।
রাজস্ব আহরণে তিন খাতেই উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যমাত্রা দেওয়া হয়েছে। মধ্যবিত্তদের ওপর চাপটা থাকবে বেশি। তবে এ চাপ এনবিআরের জন্যও কম নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, সংস্কার ছাড়াই বিপুল রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রা থাকায় এবারও চাপে থাকবে এনবিআর। এ ছাড়া বিশাল অংকের রাজস্ব আহরণে যে কাঠামোগত পরিবর্তন, নীতিমালা, সংস্কার কিংবা সক্ষমতা প্রয়োজন, তা নেই। ভ্যাট আইন চালুর পরও সম্পূরক শুল্ক এবং নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্কের ক্ষেত্রে সমন্বয়ের কথা ছিল। কিন্তু তা করা হয়নি। ফলে ভ্যাটের পুরো চাপ জনগণের ওপর আসবে।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে অভ্যন্তরীণ খাত বিশেষ করে এনবিআরের শুল্ক-কর আদায় বাড়ানোর জন্য সরকারের উচ্চ মহল থেকে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। তবে বাস্তবে তার কোন প্রতিফলন দেখা যায়নি।
চলতি অর্থবছরে এনবিআরকে ৩ লাখ ৭০ হাজার কোটি টাকার বিশাল লক্ষ্য দেওয়া হয়েছে, যা বিদায়ী অর্থবছরের চেয়ে ৪০ হাজার কোটি টাকা বেশি। বিদায়ী অর্থবছরে সব মিলিয়ে ৩ লাখ ২ হাজার কোটি টাকার শুল্ক কর আদায় করেছে এনবিআর। লক্ষ্য অর্জনে চলতি অর্থবছরে রাজস্ব আদায়ে প্রায় ২৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হতে হবে।
এনবিআরের কর্মকর্তারা বলছেন, সরকারি প্রকল্প থেকে বিশাল পরিমাণে রাজস্ব আদায় হয়ে থাকে। বিশেষ করে সরকারি প্রকল্পে উৎসে কর থেকে বিশাল পরিমাণে রাজস্ব আসে। বৈশ্বিক সঙ্কটের কারণে প্রকল্প কমে যাওয়ার একটা প্রভাব পড়েছে সার্বিক রাজস্ব আয়ে। এছাড়া পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় একদিকে যেমন ভ্যাট আদায় কমেছে, অন্যদিকে আমদানি-রফতানিতে রাজস্ব আহরণ বেড়েছে। এই কারণে রাজস্ব আয়ে আমদানি-রফতানি খাতে ভালো প্রবৃদ্ধি অর্জন করা সম্ভব হয়েছে। অর্থনৈতিক এমন পরিস্থিতিতে এনবিআরের পক্ষে বিশাল পরিমাণে রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা অর্জন অসম্ভব। তবে একটা যৌক্তিক পর্যায়ে রাজস্ব আহরণ হবে বলেও আশাবাদ এনবিআরের কর্মকর্তাদের।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, এনবিআরের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের প্রক্রিয়াতে রয়েছে সমস্যা। এছাড়া বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমাকেও রাজস্ব ঘাটতির কারণ বলে মনে করেন তারা। তবে এনবিআরকে সক্ষমতা ও করের আওতা বৃদ্ধির পরামর্শ তাদের। এছাড়া বকেয়া টাকাও আদায় করার উপর জোর দেন তারা।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. মো. আইনুল ইসলাম বলেন, কখনোই এনবিআর যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে তা অর্জন হয় না। কিসের উপর ভিত্তি করে তারা লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে জানি না। সক্ষমতা ও করের আওতা বাড়ানোর কথা বলি আমরা। কিন্তু এটার কোন প্রতিফলন পাওয়া যায় না। সুতরাং এটা প্রত্যাশিতই ছিল যে, রাজস্ব আয় লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না।
ড. মো. আইনুল ইসলাম বলেন, এছাড়াও মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমে গেছে, মানুষ কর দিতে গড়িমসি করবে; এটাই স্বাভাবিক। যারা ট্যাক্স দেয়, ভ্যাট দেয়-তাদের খরচ যদি বেড়ে যায়, বাজারে যদি মানুষ কম দ্রব্য কেনে, তাহলে ভ্যাট থেকে যে আয়টা আসে তাতো কমে যাবে। মানুষ এখন শুধু খাদ্যদ্রব্য ছাড়া অন্যান্য দ্রব্য কিনতে একটু হলেও সাবধানতা অবলম্বন করছে। এজন্যই রাজস্ব আয় কমছে এবং আরো কমার সম্ভবনা আছে। নির্বাচনী বছরে খরচের পরিমাণ একটু বেড়ে যাওয়ায় রাজস্ব ঘাটতিতে সরকার একটু হলেও চাপে থাকবে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।
এনবিআরের সদস্য (কর তথ্য ব্যবস্থাপনা ও সেবা) মো. জাহিদ হাসান বলেন, আমরা টিডিএসকে গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছি। টিডিএস বাড়লেই রাজস্ব আদায় কাছাকাছি হয়ে যাবে, পুরোও হয়ে যেতে পারে। আমরা নতুন কিছু প্রোগ্রাম ডেভলপ করেছি, টিআরপি করছি এবং অটোমেশন সিস্টেমের উপরে কাজ করছি। অটোমেশনের কারণে আমাদের রেভিনিউ গ্রোথ হবে। আর কাস্টমসের ডিউটি বেড়ে গেলেতো কালেকশন বেড়ে যায়। আমরাতো ২০-২১ শতাংশ গ্রোথে আছি। অটোমেশনের কারনে কিছু সিস্টেম ডেভলপমেন্ট হচ্ছে। আমরা আশাবাদী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রফেসর ড. রুমানা হক বলেন, একটাতো হলো আমাদের করজাল (যারা নিয়মিত কর দেয়) ফিক্সড হয়ে আছে, সময়ের সাথে সাথে বাড়ছে না। নতুন করে অনেককে করের আওতায় আনা যেতে পারে। অনেক ইনফরমাল সেক্টরের কারণে হয়তো এগুলো নিয়মিত করা হয় না, যার কারণে একটা বড় অংশ করের আওতার বাইরে চলে যায়। আর যাদের কর দেয়ার কথা, তারাও সঠিকভাবে দিচ্ছে কিনা, এটাও আরো জোড়ালোভাবে মনিটর করা যেতে পারে। আয়ের একটা বড় অংশ হয়তো অপ্রদর্শিত থাকে কিনা, সেগুলো কিভাবে ট্র্যাক করা যায়; সেগুলোকে দেখা। এজন্য জনবল দরকার আরো।
তিনি বলেন, কর দেয়ার বিষয়টাকে অভ্যাসের মধ্যে নিয়ে আসার জন্য যে ধরণের করমেলা শুরু করা হলো। পদ্ধতিটাকে সহজ করা, করভীতি দূর করা, মানুষের জ্ঞানের অভাবও একটা কারণ। করমেলা বা অন্য যেকোনভাবে পদ্ধতিগুলোকে যদি আরেকটু সহজ করা যায়, তাহলে মানুষজন কর দিতে উৎসাহী হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন