‘শতভাগ বিদ্যুতের দেশে’ বিদ্যুৎ ও গ্যাস নিয়ে কোনো সুখবর দিতে পারছেন না সরকারের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। এতে চরম উদ্বিগ্ন হয়ে দেশের ব্যবসায়ী শিল্পপতিরা একের পর এক বৈঠক করছেন; সেমিনার সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করছেন। ষেখানে সরকারের নীতি নির্ধারকরা আগামীতে বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সুখবর নিতে না পারায় হতাশা প্রকাশ করছেন ব্যবসায়ীরা। তারা সরকারকে নানান পরামর্শ দিয়ে বলছেন, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের ব্যবস্থা করা না গেলে হাজার হাজার শিল্প কারখানা বন্ধ হয়ে যাবে, ব্যবসা-বাণিজ্য ডুবে যাবে। এতে দেশের ৪৫ লাখ শ্রমিক বিপাকে পড়ে যাবেন। গতকাল গুলশানের ওয়েস্টিন হোটেলে ‘শিল্পে জ্বালানি সঙ্কট সমাধান’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় এই আশঙ্কার চিত্র তুলে ধরেন দেশের শিল্প উদ্যোক্তারা। বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রি (বিসিআই) আয়োজিত সেমিনারে গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংকটে দেশের শিল্প ব্যবসার ভয়াবহ চিত্র তুলে ধরা হয়।
ভুক্তোভোগী শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীরা জানান, যুদ্ধের প্রভাবে চলমান বৈশ্বিক জ্বালানি সঙ্কটের প্রভাব পড়েছে দেশের সব ধরণের শিল্প কারখানায়। ৬০ শতাংশ পর্যন্ত শিল্প উৎপাদন ব্যাহত হওয়ার চিত্র তুলে ধরে যে কোন মূল্যে এলএনজি আমদানির দাবি করেছেন ব্যবসায়ীরা। রফতানি ধরে রাখতে প্রয়োজনে বেশি টাকা দিয়েও গ্যাস কিনতে রাজি আছেন তারা। এমনকি বাসাবাড়ি, সার কারখানা বা বিদ্যুৎ খাতের গ্যাস কমিয়ে দিয়ে উৎপাদনশীল কারখানায় গ্যাস দেয়ার জোরালো দাবি ব্যবসায়ী নেতাদের।
সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানী বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-এলাহি চৌধুরী। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ভোলা থেকে ৮০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস লরিতে করে নিয়ে আসার পরিকল্পনা হচ্ছে। আর দিনের বেলায় সবাই যদি বিদ্যুৎ ব্যবহার না করে তাহলে শুধু শিল্প আর কৃষিখাতে বিদ্যুৎ দেয়া যাবে। এসি ব্যবহার বন্ধ বা সীমাবদ্ধ করে দিয়েও বিদ্যু ব্যবস্থাপনা করা যায়।
সভায় আরও বক্তব্য দেন এফবিসিসিআই সভাপতি জসিম উদ্দিন, বিসিআই সভাপতি আনোয়ারুল আলম চৌধুরি, বিটিএমইএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন, বিজিএমইএ সভাপতি ফারুক হাসান, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক ড. বিনায়ক সেন, এফবিসিসিআই’র সাবেক সভাপতি এ কে আজাদ, বুয়েটের সাবেক শিক্ষক প্রফেসর ড. ইজাজ হোসাইন, বিদেশি চেম্বার ফিকির ভাইস প্রেসিডেন্ট স্বপ্না ভৌমিক প্রমুখ।
সভাপতির স্বাগত বক্তব্যে বিসিআই সভাপতি আনোয়ারুল আলম চৌধুরি বলেন, জ্বালানি সঙ্কটে শিল্পখাতে উৎপাদন কমেছে ৪০-৬০ শতাংশ। গত মাসে রফতানি আয় কমেছে সাড়ে ৭ বিলিয়নের চেয়ে বেশি। এমন পরিস্থিতিতে রফতানি বৃদ্ধির মাধ্যমে রিজার্ভ বাড়ানোর জন্য জ্বালানি কৌশল নিয়ে আলোচনা করতে এ সেমিনার আয়োজন করা হয়েছে।
সভায় বর্তমান জ্বালানি পরিস্থিতি ও করণীয় নিয়ে মূল প্রবন্ধ তুলে ধরেন বুয়েটের সাবেক প্রফেসর ড. ইজাজ হোসেন। তিনি বলেন, শিল্পের স্বার্থে প্রয়োজনে আরো লোডশেডিং করা যেতে পারে। বর্তমানে বাসা-বাড়িতে ৫৬ শতাংশ গ্যাস ব্যবহার করা হয়। যেখানে শিল্পে ব্যবহার হচ্ছে ২৮ শতাংশ গ্যাস। গ্যাসের এ ব্যবহার উল্টিয়ে ফেলার কথা বলেন তিনি। গত বছর শিল্পে ৮৪২ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস পেলেও এখন ৫০০ মিলিয়ন ঘনফুটের কম গ্যাস পাচ্ছে। তাই প্রতি মাসে ৪০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি আমদানির আবেদন করা হয়। যেখানে ৩০ ডলার প্রতি ইউনিটের খরচ ধরলে মাসে ৩৬০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় হবে।
সিলেটে-চট্রগ্রামে গ্যাস পাওয়া গেলেও সাভার, গাজীপুর, নারায়নগঞ্জে ৭০-৮০ শতাংশ কারখানাতে গ্যাস সঙ্কট চলছে। তাই সার কারখানা থেকে প্রয়োজনে গ্যাস কমিয়ে শিল্প কারখানায় সরবরাহ করতে বলা হয়। গত বছরও ৪ বিলিয়ন ডলারের এলএনজি আমদানি করা হলেও এ বছর কেন তা আনা হচ্ছে না সে প্রশ্নও তুলেন এ জ্বালানী বিশেষজ্ঞ। প্রয়োজনে সার ও বিদ্যুৎ আমদানি করে এসব খাতের গ্যাস শিল্পে দেয়ার বিকল্প প্রস্তাব তুলে ধরেন তিনি। তাছাড়া বাসাবাড়ি ও বাণিজ্যিক খাতে এলপিজির ব্যবস্থা করার আহ্বান জানান তিনি। সর্বোপরি আংশিকভাবে হলেও আপাতত এলএনজি আমদানির দাবি জানানো হয়। আলোচনায় অংশ নিয়ে ড. বিনায়ক সেন বলেন, এলএনজির আমদানির ক্ষেত্রে যে ২৫ ডলার হিসেব করা হলো তা যদি ৪০ ডলার হয়ে যায় তাহলে আবার হিসেব পাল্টে দ্বিগুণ হয়ে যাবে। তবে শিল্প ক্ষতিগ্রস্থ হলে ৪৫ লাখ শ্রমিকও বিপদে পড়বে বলে মনে করছেন তিনি।
এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন বলেন, ৭/৮ ঘন্টা কারখানা বন্ধ থাকায় অনেকে আমাকে ফোন করে জানতে চান শিল্পখাতে তো বিদ্যুৎ থাকার কথা ছিল। বিদ্যুতের জন্য সোলার, কেপটিভ ও জেনারেটর রেখেও সমাধান হচ্ছে না। কোন দেশের শিল্পখাত এতো বিকল্প হাতে রাখে না। এমন অবস্থা চলতে থাকলে ব্যাংকখাত আর ব্যবসা ডুবে যাবে বলে মন্তব্য করেন দেশের শীর্ষ ব্যবসায়ী সংগঠনের এ সভাপতি। সাভার- গাজীপুরকে শিল্প নগরী না ধরা হলে আর কোন এলাকাকে শিল্প নগর ধরা হবে সে প্রশ্নও রাখেন তিনি। তেলের ওপর এখন ২৪ টাকা করে ভ্যাট নেয়ার কী দরকার তাও জানতে চান তিনি। ব্যাংক থেকে লোন নিয়ে হলেও এলএনজি আমদানির দাবি জানান এ ব্যবসায়ী। করাখান বন্ধ থাকলে মধ্যম আয়ের দেশে হতে ২০৩০ সালের মধ্যে যে ৩০০ বিলিয়ন ডলার রফতানি লক্ষ্য ধরা হয়েছে তা কীভাবে বাস্তাবায়ন হবে সে প্রশ্ন তুলেন তিনি। ব্যবসায়ীদের বিষয়গুলো প্রধানমন্ত্রীর কাছে তুলে ধরতে জ¦ালানি উপদেষ্টার প্রতি আহ্বান রাখেন জসিম উদ্দিন।
সভায় ব্যবসার অবস্থা তুলে ধরে এফবিসিসিআই’র সাবেক সভাপতি ও শিল্পপতি এ কে আজাদ বলেন, রাতের শিফটে টেক্সটাইল চলছে না। কাজ না থাকায় শ্রমিকদের ছাঁটাই করতেও পারছি না। কীভাবে তাদেরকে কাজে রাখা যায় সে পরার্মশ চান তিনি। গত বছর রফতানিতে ৩৮ শতাংশ ব্যবসা বাড়লেও গত মাসে তা কমেছে। চীন-ভিয়েতনাম থেকে এ দেশে ব্যবসা এসেছিল। এ অবস্থা চলতে থাকলে সামনের ৬ মাস পর কী হবে সে আশঙ্কার কথা প্রকাশ করেন তিনি।
বিটিএমএ সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন বলেন, ট্রেক্সটাইল খাতে মোট ১ লাখ ৬০ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ রয়েছে। যার মাধ্যমে বার্ষিক ২৮ বিলিয়ন ডলার আয় হচ্ছে। তাছাড়া দেশে ৮ বিলিয়ন ডলারের কাপড়ের চাহিদা মেটানো হচ্ছে। তবে বর্তমানে এ খাত অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় আছে। ৫ টার পর গ্যাস বন্ধ হয়ে গেলে ১২ ঘন্টা করাখানা চলে না। অথচ জ্বালানী আর সস্তা শ্রমের কারণেই এদেশে দ্রুত এ শিল্প গড়ে ওঠেছিল। দাম বাড়িয়ে হলেও গ্যাস দিতে বলেন তিনি। এ সময় তিনি ১ লাখ ডলারের গ্যাস দিলে ২৪ লাখ ডলার রফতানি আয় দিতে পারবেন বলে জানান তিনি।
পোশাক শিল্পের পক্ষ থেকে আকতার হোসেন অপূর্ব বলেন, ৪০ শতাংশ উৎপাদন হচ্ছে না। আর বিদ্যমান অর্ডারের ১২ শতাংশ যথাযময়ে দেয়া যাচ্ছে না। ফলে বায়াররা মুখ ফিরিয়ে নিলে তাদেরকে আর ফিরিয়ে আনা যাবে না। তাই এমন পরিস্থিতিতে কোন বিকল্প পথ দেখানোর আবদার করেন তিনি। প্রয়োজনে কারখানায় এলপিজি সেটআপ স্থাপন করতে ২/৩ কোটি টাকার মতো যে খরচ হয় সেখানে সরকারকে সহায়তা করতে বলেন। অন্তত বয়লারটা চালু রাখার ব্যবস্থা করার দাবি জানান তিনি। বিদেশি চেম্বার ফিকির ভাইস প্রেসিডেন্ট স্বপ্না ভৌমিক বলেন, ২ মাসে ২৭ কারখানা ঘুরে দেখে ভয়ের অভিজ্ঞতা হয়েছে। দামি মেশিন ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। তবে আত্মবিশ্বাস না হারানোর অভয় দেন তিনি। মেট্রোপলিটন চেম্বারের সাইফুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘ মেয়াদি গ্যাস চুক্তির কিস্তিও নাকি ঠিকমতো দেয়া হয়নি। তাই সমস্যা তৈরি হচ্ছে জানান তিনি।
সবশেষে এসব দাবির বিষয়ে ড. তৌফিক-ই-এলাহি চৌধুরী বলেন, ২৫ ডলার করে বলা হলেও বর্তমান বাজারদরে এলএনজির দাম ৩২ ডলার করে। সেখানে ৬ মাসের গ্যাস আনতে গেলে ব্যয় হবে ১ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। যা যুদ্ধের এ অনিশ্চিত সময়ে সম্ভব হবে না। তবে ভোলা থেকে সিএনজি হিসেবে ৮০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস লরিতে করে নিয়ে আসার পরিকল্পনা হচ্ছে বলে জানান তিনি। আর এলপিজি স্থাপনের বিষয়ে কীভাবে সহায়তা করা যায় তা নিয়ে প্রস্তাব দিতে বলেন তিনি। এদিকে ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র উৎপাদনে আসলে গ্যাসের ওপর কিছুটা চাপ কমে আসবে বলেও জানান তিনি। সোলার বিদ্যুৎ তৈরির জন্য দ্রুত কাজ করা হচ্ছে। বিদেশি সহায়তা নিতে একটি টিম কাজ করছে জানান তিনি। যুদ্ধ বন্ধ করার করা জন্য বিদেশি কূনীতিকদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে বলেন তিনি। তবে এসব আশ্বাসে ব্যবসায়ীরা সন্তুষ্ট না হওয়ায় ড. তৌফিক-ই-এলাহী বলেন, তাহলে সবাই যদি দিনের বেলা বিদ্যুৎ ব্যবহার না করার শপথ নিতে পারেন তাহলে শুধু শিল্প আর কৃষিতে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা যাবে। ##
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন