বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সঙ্কটের প্রভাবে চাপ পড়েছে দেশের অর্থনীতিতেও। দেশের চলমান অর্থনৈতিক চাপ উত্তরণে এই মুহূর্তে ইন্টারন্যাশনাল মনিটরিং ফান্ডের (আইএমএফ) ঋণ পেতে মরিয়া বাংলাদেশ। এই ঋণ পেতে সরকারের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছে সফররত আইএমএফ প্রতিনিধি দল। এরই ধারাবাহিকতায় আজ রোববার জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সঙ্গে বৈঠক করবে দলটি।
এনবিআর সূত্রে জানা গেছে, এই বৈঠকে আয়কর খাতে মোটা দাগে ক্যাপাসিটি বিল্ডিং, কর জিডিপি বাড়ানো, ভ্যাট অটোমেশন, রাজস্ব প্রশাসনে সংস্কার, ট্রেড ফ্যাসিলেশন, স্কিল ডেভেলপমেন্ট, টোবাকো খাতে করহার পুনর্বিবেচনাসহ প্রায় ডজনখানেক ইস্যু নিয়ে আলোচনার কথা রয়েছে। এসব বিষয়ে ঐক্যমতে পৌঁছালেই সহজ হয়ে উঠতে পারে ঋণ পাওয়া।
সূত্র জানায়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ অর্থনৈতিক সঙ্কটে পড়লে আইএমএফের দ্বারস্থ হয়। বাংলাদেশেও চলমান অর্থনৈতিক চাপ কাটিয়ে উঠতে সংস্থটির কাছে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলারের ঋণ আবেদন করেছে। ঋণ দেয়ার আগে আবেদনকারী দেশকে অর্থনৈতিক সঙ্কট কাটিয়ে উঠতে সাধারণত আইএমএফ বেশ কিছু শর্ত দিয়ে থাকে। এই শর্ত পরিপালন সাপেক্ষে ঋণ দেয় আইএমএফ। এরই ধারাবাহিকতায় প্রতিষ্ঠানটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিতীয় ধাপের আলোচনা চলছে। গত বৃহস্পতিবার রিজার্ভের হিসাব পদ্ধতি থেকে শুরু করে ঋণের ক্যাপসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আইএমএফ প্রতিনিধি দলের বৈঠক হয়েছে। আইএমএফ ঋণ দেয়ার আগে অর্থনৈতিক সংস্কারের বিষয়টিতে জোর দিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় আজ এনবিআর কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন আইএমএফের প্রতিনিধি দলের সদস্যরা।
এক্ষেত্রে বেশ কিছু বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে। এর মধ্যে অন্যতম হলো দেশের কর জিডিপি বাড়ানো। বলা হয়ে থাকে, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন কর জিডিপি বাংলাদেশে। আইএমএফের ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে কর জিডিপি বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। আয়করের ক্যাপাসিটি বিল্ডিংয়ের বিষয়টিও খুব জোরেশোরে আলোচনায় উঠবে। মোটা দাগে এনবিআরের অটোমেশনে জোর দিবে আইএমএফ। এক্ষেত্রে এনবিআরের আগের নেয়া অটোমেশন পদ্ধতির বাস্তবায়ন নিয়ে আলোচনা হবে। আলোচনায় থাকবে করের আওতা বাড়ানোর বিষয়টি। ই-রিটার্ন থেকে শুরু করে ই-পেমেন্ট, অ্যাসেসমেন্ট সিস্টেমসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে বলে নিশ্চিত করেছে এনবিআর সূত্র।
আইএমএফের সঙ্গে বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে এনবিআরের কর নীতির সদস্য মো. সামসুদ্দিন আহমেদ বলেন, রোববার আইএমফের আয়কর খাতের বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হবে। কর জিডিপি বাড়ানোর বিষয়ে কোনো আলোচনা হবে কিনা-এমন প্রশ্নের জবাবে এনবিআরের এই সদস্য বলেন, এসব বিষয় আসলে আলোচনার পরই পরিষ্কার হবে।
এনবিআর সূত্র জানায়, আইএমএফের সঙ্গে বৈঠকে এনবিআরের ভ্যাট অটোমেশনের বিষয়টি অন্যতম এজেন্ডা হিসেবে আলোচনায় আসবে। যদিও ইতোমধ্যে এনবিআরের নেয়া ভ্যাট অনলাইন প্রজেক্টের কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এর মধ্যে ভ্যাট রেজিস্ট্রেশন এবং ভ্যাট রিটার্নের কাজ ৭০ শতাংশ শেষ হয়েছে। এছাড়া আগামী তিন বছরের মধ্যে ভ্যাট আদায় বাড়ানোর লক্ষ্যে কী ধরনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বা হবে তা নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা হবে। ভ্যাট ইস্যুতে আলোচনার ক্ষেত্রে আরেকটি অন্যতম ইস্যু হচ্ছে-ভ্যাট প্রশাসনের সংস্কার। এক্ষেত্রে ভ্যাটের আওতা সম্প্রসারণসহ বিভিন্ন বিষয় আলোচনায় আসবে। এছাড়া টোবাকো খাতের ভ্যাট হার এবং নতুন করে রেট বাড়ানো হবে কিনা-এসব বিষয়ও বৈঠকের আলোচনায় থাকবে। আরেকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণভাবে আলোচনায় উঠবে; তা হলো-প্রসাশনিক সংস্কার। ভ্যাট আদায় বাড়ানোর ক্ষেত্রে এই সংস্কার খুবই গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন খোদ এনবিআরের কর্মকর্তারাও। তবে রাজস্ব বাড়ানোর স্বল্প এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনারও কথা রয়েছে আইএমএফের এই বৈঠকে।
আইএমএফের বৈঠক নিয়ে এনবিআরের কাস্টম পলিসির সদস্য মো. মাসুদ সাদিক বলেন, দেশের বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে আইএমএফের প্রতিনিধি দলের বৈঠক হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় এনবিআরের সঙ্গেও বৈঠক হবে। তবে আলোচনায় অনেক বিষয় উঠবে। আলোচনার পরই বলা যাবে আসলে কোন কোন বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের সাবেক সিনিয়র অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ পলিসি এক্সচেঞ্জের চেয়ারম্যান ড. মাসরুর রিয়াজ বলেন, সাধারণত আইএমএফের ঋণ পাওয়ার ক্ষেত্রে কিছু শর্ত পরিপালন করতে হয়। এটা সংস্থাটির নিয়ম। কারণ হিসেবে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে আইএমএফের শর্ত দেয়ার মূল কারণ সঙ্কট থেকে মুক্তি। কারণ অর্থনৈতিক চাপে পড়েই মূলত আইএমএফের ঋণ নেয় বিভিন্ন দেশ। আর সংস্থাটির এসব শর্ত পরিপালন করলে অর্থনৈতিক সক্ষমতাও বাড়ে।
মাসরুর রিয়াজ বলেন, প্রতিটি দেশের রাজস্ব হলো রাষ্ট্র পরিচালনার মূল শক্তি। এক্ষেত্রে কর জিডিপি বাড়ানোর শর্ত আসলে দেশের অর্থনীতির ভিতকে মজবুত করবে। এছাড়া রাজস্ব প্রশাসনে সংস্কারের যেসব বিষয় আলোচনায় আসছে তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে রাজস্ব ব্যবস্থায় অটোমেশন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ বর্ধিত অর্থনীতির দেশে কিভাবে আয়কর, ভ্যাট কিংবা কাস্টমসে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা হবে তা বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন টুলস এবং মডিউলের মাধ্যমে নির্ধারণ করা হয়। বাংলাদেশে কিন্তু তা হয় না। এছাড়া রিটার্ন সিস্টেম থেকে শুরু করে ভ্যাট এবং কাস্টমসে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা রয়েছে। এক্ষেত্রে অনেক পুরনো আইন দিয়ে এসব খাতে রাজস্ব আহরণ করা হচ্ছে। তাই এসব খাতে সংস্কার হলে সরকারের রাজস্বও বাড়বে। সেই সঙ্গে অর্থনৈতিক চাপও কমবে বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ। এরই ধারাবাহিকতায় আইএমএফের প্রতিনিধি দলের সঙ্গে দ্বিতীয় দফার বৈঠক।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন