বাণিজ্য আদালত গঠনের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন হয়নি ১৩ বছরেও। ২০০৯ সালের ১৯ জুলাই সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশনের তৎকালীন চেয়ারম্যান মো. রকিবুর রহমানের নেতৃত্বে ৮ সদস্যের প্রতিনিধি দল সাক্ষাৎ করতে গেলে তাদেরকে ওই সময়কার আইনমন্ত্রী বাণিজ্য আদালত গঠনের আশ্বাস দেন। আইনমন্ত্রী প্রতিনিধি দলের সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেছিলেন, উচ্চ আদালতে অনিষ্পন্ন বাণিজ্যিক মামলার কারণে পুঁজিবাজার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কোম্পানিগুলো তাদের লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারছে না। এ সঙ্কট নিরসনে সরকার বাণিজ্য আদালত গঠনসহ সম্ভব সব রকম সহযোগিতা দেবে। তৎকালীন আইনমন্ত্রীর এ প্রতিশ্রুতির পর পুঁজিবাজারসহ সকল বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান আশ্বস্ত হয়েছিলেন যে, বিভিন্ন আদালতে বছরের পর বছর ধরে ঝুলে থাকা অনিষ্পন্ন মামলাগুলোর নিষ্পত্তি হবে।
কিন্তু এক দশকের বেশি সময় অতিক্রান্ত হলেও বাণিজ্য আদালত গঠনের কোনো উদ্যোগই দৃশ্যমান নয়। বরং সেই সময়কার আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ এখন বলছেন, অর্থ ও বাণিজ্য সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তির জন্য পৃথক আদালত গঠনে সরকারের কোনো পরিকল্পনা নেই। এরকম কোনো আশ্বাসও কাউকে দিয়েছিলেন বলে মনে করতে পারছেন না তিনি। সরকারের অবস্থান পরিবর্তনের ফলে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে বাণিজ্য আদালত গঠনে। এমনকি বর্তমান আইনমন্ত্রণালয় ওই প্রতিশ্রুতির কথা স্মরণও করতে পারছে না।
বাড়ছে মামলা, ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা : অ্যাটর্নি জেনারেল কার্যালয়সূত্রে জানা যায়, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ, হাইকোর্ট বিভাগ ও নিম্ন আদালতে ২০১৯ সালে নিষ্পত্তি হয়েছে মাত্র ৬,৩০৯টি মামলা, ২০২০ সালে ২২১৩টি, ২০২১ সালে ৮ হাজার এবং চলতিবছর জুন পর্যন্ত নিষ্পত্তি হয় ৫ হাজার ২০৩টি মামলা। এর মধ্যে পুঁজিবাজার সংক্রান্ত মামলা উচ্চ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে ২৩৪টি। বিভিন্ন কোম্পানির পরিচালকদের আভ্যন্তরীণ বিরোধের কারণে মামলাগুলোর সৃষ্টি। মামলাগুলো নিষ্পত্তি না হওয়ায় পুঁজিবাজারসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো নানামুখী জটিলতায় খাবি খাচ্ছে। বিশেষ করে পুঁজি বাজার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো ডিভিডেন্ড ঘোষণা করতে পারছে না। এতে কোম্পানি ও বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
কোম্পানি আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার শাহ আহসানুর রহমান বলেন, বাণিজ্য সংক্রান্ত বিরোধগুলো নিয়ে বিভিন্ন আইনে মামলা হয়। যেমন ফৌজদারি, দেওয়ানি, সালিশি আইন ও কোম্পানি আইনসহ অন্তত: ৩০টি আইনে এসব মামলা হয়।
তার মতে, বাণিজ্য সংক্রান্ত বিরোধগুলো মীমাংসা ও মামলা নিষ্পত্তির জন্য একটি অভিন্ন আইন থাকা প্রয়োজন। যে আইন অনুযায়ী পৃথক আদালত ও হাইকোর্টে পৃথক বেঞ্চ থাকবে। সেই বেঞ্চ ও আদালতগুলোর বিচারকদের বাণিজ্য সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য বিশেষভাবে নিয়োগ দেয়া হবে। এছাড়াও ইংল্যান্ডের মতো বাংলাদেশেও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও আইন মন্ত্রণালয় সাময়িক আদালত গঠন করতে পারে এসব মামলা নিষ্পত্তির জন্য। যে আদালত ও বেঞ্চগুলোতে বাণিজ্য আইন সংক্রান্ত অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কোনো বিশেষজ্ঞদের নিয়োগ দেয়া যেতে পারে।
ব্যবসায়ীদের মাঝে হতাশা : পুঁজিবাজারের ব্যপকতা ও প্রসার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে কিছু সমস্যা এবং বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। ডিএসই’র বিভিন্ন তালিকাভুক্ত কোম্পানি তাদের পরিচালনা পরিষদের কোন্দলের ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ভুক্তভোগী মিউচুয়াল ফান্ডগুলো ডিভিডেন্ড দেয়া না দেয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। ইচ্ছাকৃতভাবে ভালো কোম্পানিগুলোকে ‘জেড’ ক্যাটাগরিতে রূপান্তর করছে। বিষয়গুলোর দ্রুত নিষ্পত্তি প্রয়োজন। অথচ আইনের জটিলতায় কোম্পানিগুলোর সমস্যা অনির্দিষ্টকালের জন্য ঝুলে আছে। সামগ্রিকভাবে পূঁজিবাজারের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। বিনিয়োগকারীরা লাভের আশায় পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করে অথচ কোম্পানির আভ্যন্তরীণ কোন্দলের ফলে বিনিয়োগকারীরা শুধু কোম্পানির লভ্যাংশ থেকেই বঞ্চিত হন না, এসব কোম্পানির ট্রেড বন্ধের ফলে তাদের পুঁজির বিরাট একটি অংশ বছরের পর বছর আটকে থাকে। দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান হতে পারে পুঁজিবাজার বিষয়ক বিশেষ আদালত গঠন করা। পুঁজিবাজার সংক্রান্ত বিভিন্ন আইনের সংশোধন, পরিবর্তন, পরিবর্ধন করতে এ আদালত বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে। প্রতিশ্রুত বাণিজ্য আদালত গঠনের কোনো উদ্যোগই এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান না হওয়ায় পুঁজিবাজার, বিনিয়োগকারী, আর্থিক ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মাঝে নেমে এসেছে হতাশা।
মামলা সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা জানান, হাইকোর্টে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (এসইসি) তালিকাভুক্ত পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি সম্পর্কিত মামলা হলে অনে ক্ষেত্রে নিষ্পত্তিতে বেশি সময় লাগে। এসব মামলার দ্রুত নিষ্পত্তিকল্পে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পক্ষ থেকে হাইকোর্টে পৃথক বেঞ্চ গঠনের দাবিটি দীর্ঘদিনের। ডিএসই প্রতিনিধিদল এসইসি’র তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর পরিচালক ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে পারস্পরিক বিরোধসমূহের দ্রুত নিষ্পত্তিকল্পে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের অধীন আপিল ট্রাইব্যুনাল গঠন, সুশাসন প্রতিষ্ঠায় কোম্পানির নিরীক্ষকদের জবাবদিহির আওতায় আনতে অডিটর রিপোর্টিং কাউন্সিল গঠনের লক্ষ্যে ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্র্টিং অ্যাক্ট প্রণয়ন, পুঁজিবাজারের উন্নয়নের স্বার্থে কোম্পানি আইন-১৯৯৪ সংশোধন করে সিকিউরিটিজের বাই-ব্যাক সংক্রান্ত বিধান অন্তর্ভুক্তকরণ এবং স্টক এক্সচেঞ্জের ডিমিউটালাইজেশন সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করার প্রস্তাব রয়েছে ব্যবসায়ী মহলের। আইনমন্ত্রণালয় থেকে স্বীকারও করে নেয়া হয়েছিল যে, প্রস্তাবগুলো যৌক্তিক। এগুলো বাস্তবায়নে সরকারের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহণের আশ্বাস ছিল। পুঁজিবাজার ও বিনিয়োগকারীদের স্বার্থে সরকার প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ নেবে-মর্মে আশ্বাস দেয়া হয়েছিল ২০০৯ সালে।
ওই সময় আইনমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর সরকারি প্রতিষ্ঠান সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ৬২তম সভায় পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট মামলা দ্রুত নিষ্পত্তিতে বিশেষ আদালত (বাণিজ্য আদালত) গঠনের সুপারিশ করা হয়। সুপারিশ বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে আইনমন্ত্রীর কাছে চিঠি পাঠানোরও সিদ্ধান্ত হয়। সংসদীয় কমিটির তৎকালীন সভাপতি অ্যাডভোকেট টিআইএম ফজলে রাব্বি বলেন, গত আওয়ামী সরকারের সময়ে ‘পুঁজিবাজার কারসাজির’ পর যেসব মামলা হয়েছিল সেগুলো এখনো নিষ্পত্তি হয়নি। ভবিষ্যতে এ ধরনের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তিতে বিশেষ আদালত (বাণিজ্য আদালত) গঠন দরকার, যাতে দোষীদের দ্রুত শাস্তি দেয়া যায়। যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের আদলে স্বাধীন সিকিউরিটি এক্সচেঞ্জ কমিশন (এসইসি) গঠনেরও সুপারিশ করে কমিটি।
যৌক্তিকতা দেখছে না সরকার : কিন্তু এসব বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে জানান আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি বলেন, অর্থ ও বাণিজ্য সংক্রান্ত মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে ‘কমার্স-কোর্ট’ গঠনের কোনো পরিকল্পনা সরকারের নেই। তিনি বলেন, এ দাবিটির কোনো যৌক্তিকতা এখন নেই। কারণ, অর্থ সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তির জন্য অর্থঋণ আদালত রয়েছে। ওই আইনে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির বিধান অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সিভিল প্রসিডিউরও সংশোধন করে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি চালু করা হচ্ছে। অর্থ-বাণিজ্য সংক্রান্ত মামলা দ্রুত নিষ্পত্তিতে বিকল্প বিরোধ বা এডিআর ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে বলে আমি মনে করি।
‘নোগোশিয়েবল ইনুস্ট্রুমেন্ট অ্যাক্টে (চেক ডিজ-অনার মামলা) দায়ের করা অন্তত দেড় হাজার মামলা হাইকোর্টে ঝুলে আছে। পুঁজিবাজার সংক্রান্ত মামলা রয়েছে আড়াইশ’র মতো। এগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির উপায় কি?’ এমন প্রশ্নের উত্তরে আইনমন্ত্রী বলেন, মামলা নিষ্পত্তি করতে চাইলে যেকোনো পক্ষ হাইকোর্টের স্থগিতাদেশ ভ্যাকেট চেয়ে আপিল করতে পারে। তাছাড়া মামলার যেকোনো পর্যায়ে আপসেরও বিধান আছে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি পদ্ধতিতে।
তবে পৃথক বাণিজ্য আদালত গঠনের পক্ষে মতামত দিয়ে কোম্পানি আইন বিশেষজ্ঞ ব্যারিস্টার তানজীব-উল আলম বলেন, কোম্পানি মামলা নিষ্পত্তিতে বিলম্ব হওয়ার অন্যতম কারণ, দেশে উপযুক্ত আদালত ও বিচারকের সংখ্যা অনেক কম। এছাড়াও দক্ষ বিচারকের অভাব রয়েছে। বিচারিক আদালতগুলোতে বাণিজ্য সংক্রান্ত মামলার বিচার পরিচালনার জন্য কোনো পৃথক আদালত নেই। যা উন্নত দেশগুলোতে রয়েছে।
হাইকোর্টে বাণিজ্য সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তির জন্যও কোনো পৃথক বেঞ্চ নেই। কোম্পানি সংক্রান্ত মামলা ও বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য মাত্র একটি বেঞ্চ রয়েছে। শুধু কোম্পানি সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তির জন্য হাইকোর্টে অন্তত: ৫টি বেঞ্চ থাকা জরুরি বলে জানান এই আইনজীবী।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন