বাংলাদেশ ২০২৬ সালের পর এলডিসি থেকে বের হয়ে উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পাবে। এরপর আমাদেরকে বিশ্ববাজারে টিকে থাকতে হবে প্রতিযোগিতা করে। সেজন্য প্রয়োজন টেকসই বা দীর্ঘস্থায়ী উন্নয়ন। আর তা নিশ্চিত করতে হলে কোম্পানিগুলোকে পরিবেশবান্ধব পণ্য উৎপাদনে নজর দিতে হবে। গতকাল শনিবার রাজধানীর একটি হোটেলে ‘সাসটেইনেবিলিটি রিপোর্টিং বাই দ্য প্রাইভেট সেক্টর ইন বাংলাদেশ’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন। ইউএনডিপির সহযোগিতায় নাগরিক প্ল্যাটফর্ম ফর এসডিজি আয়োজিত এই সেমিনারে পরিবেশ দূযণ না করে ব্যবসা-বাণিজ্য করার দাবি উঠেছে।
সেমিনারে বক্তারা বলেন, অধিকাংশ করপোরেট প্রতিষ্ঠান সাসটেইনেবল রিপোর্ট সম্পর্কে ধারণা রাখে না। এক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশ অনেকটা পিছিয়ে আছে। উন্নয়ন টেকসই করতে এ বিষয়ে একটি গাইডলাইন জরুরি। একইসঙ্গে আগামী অর্থবছরের বাজেটে এ খাতে আলাদা বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয় সেমিনারে।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বন ও পরিবেশ বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, সাসটেইনেবিলিটি রিপোর্টিং সম্পর্কে অনেকেরই পরিষ্কার ধারণা নেই। করপোরেট কোম্পানিগুলোকে এ বিষয়ে বুঝাতে হবে। জনগণের মাঝে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে। সংবিধানে সাসটেইনেবিলিটি শব্দটি নেই। কিন্তু এটা বলা আছে, আগামী প্রজন্মের জন্য পরিবেশ দূষণ করা যাবে না। তার মানে পরোক্ষভাবে এ বিষয়টি বলা হয়েছে। কাজেই পরিবেশ সুরক্ষায় এ সংক্রান্ত আইন করতে বাধা নেই। আর আইন হলে করপোরেট কোম্পানিগুলো পরিবেশসম্মত উপায়ে পণ্য তৈরি করতে বাধ্য হবে, যা টেকসই উন্নয়নকে আরও সহজ করবে।
সাবের হোসেনের মতে, প্রাইভেট কোম্পানির আসল উদ্দেশ্য থাকে তিনটি-উৎপাদন খরচ কমানো, আয় বাড়ানো ও লাভ বেশি করা। সব দেশেই প্রাইভেট সেক্টরের এই বৈশিষ্ট্য। ফলে জলবায়ুর অভিঘাত মোকাবিলায় প্রাইভেট সেক্টর খুব একটা ভূমিকা রাখে না। তিনি মনে করেন, পরিবেশকে বাঁচিয়েই উন্নয়ন টেকসই করতে হবে। এজন্য সরকারি-বেসরকারি খাতকে যৌথভাবে কাজ করতে হবে।
টেকসই রিপোর্টের জন্য টেকনিক্যাল ও প্রযুক্তিগত সহায়তার ওপর গুরুত্ব দেন ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি আসিফ ইব্রাহিম। তিনি বলেন, কোম্পানিগুলো পরিবেশবান্ধব উপায়ে পণ্য উৎপাদন করে কিনা তা নিশ্চিত করবে দুটি সংস্থা। লিস্টেড কোম্পানির জন্য কাজ করবে ঢাকা ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ। আর নন-লিস্টেড কোম্পানির দায়িত্ব থাকবে বাংলাদেশ ব্যাংকের হাতে।
সেমিনারে মিউচ্যুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনিস এ খান এ ধরনের আইনের খসড়া তৈরির আগে ব্যাপক সচেতনতা ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রশিক্ষণ দেয়ার প্রস্তাব করেন। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে টেকসই উন্নয়ন বিষয়ে কোর্স চালুর প্রস্তাব করেন একজন শিক্ষক। টেকসই উন্নয়ন রিপোর্টের জন্য বাংলাদেশ ব্যংকের সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন তৈরির প্রস্তাব করেন বিকেএমইএর সাবেক সভাপতি ফজলুল হক। টেকসই উন্নয়নের ক্ষেত্রে তথ্য-উপাত্তের ঘাটতি বড় বাধা বলে মনে করেন ব্যাংকার সাজেদুল হক। এনজিওকর্মী সদর উদ্দীন ওমর মনে করেন, যারা পরিবেশবান্ধব পণ্য বানাবে তাদের বেশি হারে কর রেয়াত দিতে হবে।
গবেষণা সংস্থা বিল্ড-এর ফেরদৌস আরা বেগম বলেন, দেশের শিল্প খাতে ৯৮ শতাংশই ক্ষুদ্র শিল্প। এদের বেশিরভাগেরই সক্ষমতার অভাব রয়েছে। তারা সব নিয়মকানুন মেনে পরিবেশবান্ধব পণ্য উৎপাদন করতে পারবে কিনা, তা বিবেচনায় নিয়ে আইন করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. ইউসুফ মনে করেন, টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে রেগুলেটরি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় জরুরি।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের অমিতাভ চক্রবর্তী বলেন, টেকসই উন্নয়নের জন্য কিভাবে পরিবেশবান্ধব পণ্য উৎপাদন করা যায় সে বিষয়ে গাইডলাইন আছে। ২০০৮ সালে এটি চালু হয়। এতে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর পারফরমেন্সের কথা উল্লেখ আছে। কিন্তু অনেক প্রতিষ্ঠান তা মানছে না। করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসা করে আয় করবে তাতে কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু পরিবেশ দূষণ করা যাবে না। এজন্য প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। পাশাপাশি জনগণকে সচেতন করতে হবে। আগামী এক বছরের মধ্যে সাসটেইনেবিলিটি নীতিমালা প্রণয়ন করা হবে বলে জানান তিনি।
অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের বিশেষ ফেলো ও নাগরিক প্ল্যাটফর্ম ফর এসডিজির আহবায়ক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, বাংলাদেশ উত্তরণ প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। কিন্তু দুঃখজনক হলো, গুরুত্বপূর্ণ এসব বিষয়ে আমাদের পরিষ্কার কোনো ধারণা নেই। তথ্য-উপাত্তেও ঘাটতি আছে। টেকসই উন্নয়নের বিষয়টি উত্তরণ প্রক্রিয়ায় যুক্ত করতে হবে এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে এ বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিপিডির সিনিয়র রিসার্চ ফেলো ড. তৌফিক ইসলাম।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন