জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে এখন থেকেই প্রশাসন সাজানো হচ্ছে। একারণে প্রশাসনে ৬ মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে রদবদল, প্রায় দুই শতাধিক উপসচিব থেকে যুগ্মসচিব পদে পদোন্নতি এবং ২০ জেলার ডিসিকে মাঠ প্রশাসন থেকে প্রত্যাহার করে ২৪ ও ২৫ ব্যাচের কর্মকর্তাদের ডিসি করা হচ্ছে বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সূত্রে নিশ্চিত করেছে। আজ সোমবাব অথবা যে কোনো সময় রদবদল ও পদোন্নতির প্রজ্ঞাপন জারি হতে পারে বলে জানা গেছে।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের নিয়োগ, পদোন্নতি ও প্রেষণ (এপিডি) অনুবিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. আব্দুস সবুর মন্ডল ইনকিলাবকে বলেন, চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ হবে কি না তা জানা নেই। শূন্য পদে সিনিয়রিটির সঙ্গে যারা সরকারের আস্থায় উপনীত হবেন, তাদেরই পদায়ন করা হবে। প্রশাসনে অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে এখন পদায়ন ও পদোন্নতি দেওয়া হয় বেশ হিসাব-নিকাশ করে দেয়া হয়।
জানা গেছে, মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগসহ ১১/১২টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের শীর্ষ পদ আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে শূন্য হচ্ছে। এসব শূণ্য পদ পুরণে নতুন সচিব নিয়োগ ও বদবদল করা হচ্ছে। সে সব মন্ত্রণালয়ের সচিবদের রদবদল করা হচ্ছে, তা হচ্ছেন, জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব,স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব, ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিব, মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবকে সচিব পদে পদোন্নতি দেয়া হচ্ছে। গত ২০ জেলার ডিসিদের মাঠ থেকে তুলে নেয়া হচ্ছে, তারা হলেন মধ্যে নড়াইলের ডিসি, যশোর, মেহেরপুর, মাগুড়া, ময়মনসিংহ, সিরাজগঞ্জ, জয়পুরহাট, ঝালকাঠি, কুমিল্লা, খাগড়াছড়ি, রংপুর, লালমনির হাট, কুড়িগ্রাম ও গোপালগঞ্জসহ বেশ ২০টি জেলার ডিসিকে মাঠ থেকে তুলে নেয়া হচ্ছে। এসব পদে নতুন জেলা প্রশাসক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। এসব পদে নতুন কোনো কর্মকর্তাকে পদায়ন করতে নানা হিসাব-নিকাশ করা হচ্ছে। কারণ এ পদগুলোতে যারা দায়িত্ব পালন করেন, তারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কাজে সম্পৃক্ত থাকেন। আর এখন যাদের পদায়ন করা হবে, তারা আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করবেন। এমন প্রেক্ষাপটে কোনো ধরনের ঝুঁকি না নিয়ে সরকার এসব গুরুত্বপূর্ণ পদে আস্থাভাজন কর্মকর্তাদের নিয়োগ দিতে চাইছে। এভাবেই ঢেলে সাজানো হচ্ছে প্রশাসন। অতীতেও দেখা গেছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে সরকার প্রশাসন ঢেলে সাজাতে একই ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছিল।
প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শীর্ষ পদে নিয়োগ পেতে সব সময় কর্মকর্তাদের মধ্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতা দেখা যায়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সেই প্রতিযোগিতা প্রশাসনের অনেক কর্মকর্তার মধ্যেই দেখা যাচ্ছে না। তারা চাকরি জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে কোনো ধরনের ঝুঁকি নিতে চাচ্ছেন না। কারণ আর এক বছর কয়েক মাস পরই জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচন সামনে রেখে দেশের সার্বিক রাজনীতির গতি প্রবাহ কোন দিকে যাবে- এ ভাবনা তাদের মাথায় কাজ করছে। বর্তমান সরকারের তিন দফায় যারা পদোন্নতি ও কাক্সিক্ষত মন্ত্রণালয়ে পদায়নের জন্য সরকারদলীয় সমর্থিত তকমা নিয়েছেন, এখন তাদের কেউ কেউ গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব নিতে আগ্রহ কম দেখাচ্ছেন। পুলিশ ও প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের ক্ষেত্রে এ চিত্র বেশি দেখা যাচ্ছে।
জানা গেছে, জেলা প্রশাসক ও জেলার পুলিশ সুপারসহ মাঠ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে পদায়নের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের বিষয়ে নানা সূত্র থেকে খোঁজখবর নেওয়ার রেওয়াজ দীর্ঘ বছর ধরে চলে আসছে। এ ক্ষেত্রে যাকে গুরুত্বপূর্ণ পদে বসানো হবে, তিনি সরকারের প্রতি অনুগত কিংবা বিরোধী পক্ষের সঙ্গে ব্যক্তিগত বা পারিবারিক যোগসূত্র আছে কিনা তা দেখা হয়ে থাকে। নানা কারণে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠায় এখন নির্বাচনী কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত যে কোনো পদে কোনো কর্মকর্তাকে পদায়নের ক্ষেত্রে দফায় দফায় খোঁজ নেওয়া হয়েছে।
গতকাল রোববার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব মো. আখতার হোসেন অবসরে গেছেন। জননিরাপত্তা বিভাগের অধীনে বাংলাদেশ পুলিশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, বাংলাদেশ কোস্টগার্ড, বাংলাদেশ আনসার ও গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনী, এনটিএমসি (ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন মনিটরিং সেন্টার) র্যাব ও পুলিশের শাখা রয়েছে। মো. আখতার হোসেন গত ১২ জানুয়ারি দায়িত্ব নিয়েছিলেন। জাতীয় নির্বাচনকালে এ বিভাগ মূলত নির্বাচনের শান্তি শৃঙ্খলা ও ভোটকেন্দ্রের নিরাপত্তা বিধানের মূল দায়িত্ব পালন করে থাকে। এ জন্য এ বিভাগে সচিবের পদে বসাতে সরকার একজন দক্ষ ও আস্থাভাজন কর্মকর্তা খুঁজে নেয়া হয়। গত ২৭ অক্টোবর প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. আমিনুল ইসলাম খানকে জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব পদে নিয়োগ করা হয়। একই সঙ্গে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয় এবং নির্বাচন কমিশন সচিবালয় ছাড়াও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষে (রাজউক) নতুন চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. আমিনুল ইসলাম খানকে জননিরাপত্তা বিভাগের সচিব করা হয়েছে। অপর আদেশে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব মোহাম্মদ মেজবাহ উদ্দিন চৌধুরীকে সিনিয়র সচিব করে একই বিভাগে পদায়ন করা হয়। যা ৩০ অক্টোবর থেকে কার্যকর হবে বলে জানানো হয়েছে। শিল্প মন্ত্রণালয়ের সচিব জাকিয়া সুলতানাকে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সচিব করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের সচিব মো. হুমায়ুন কবীর খোন্দকারকে শিল্প সচিব হিসেবে বদলি করা হয়েছে।
শীর্ষ পদ শূন্য হতে যাওয়া সরকারের গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি বিভাগ হচ্ছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এ বিভাগ সরকারের মন্ত্রিসভার সাচিবিক দায়িত্ব পালন করে। এ বিভাগ সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হয়। এ বিভাগ থেকে কার্যবিধিমালা এবং মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলোর মধ্যে কার্যবণ্টন করাসহ মন্ত্রিসভা ও কমিটিগুলোর সাচিবিক সহায়তা প্রদান, মন্ত্রিসভা ও কমিটির সিদ্ধান্তগুলোর অগ্রগতি ও বাস্তবায়ন পর্যালোচনাসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করা হয়ে থাকে। এ বিভাগের সচিব পদে সাধারণথ পদায়ন করা হয় প্রশাসনের জ্যেষ্ঠ সচিবকে। বর্তমান মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলামের দুবছরের চুক্তিভিত্তিক মেয়াদ শেষ হবে ডিসেম্বর মাসে। কে হবেন তার স্থলাভিষিক্ত-এ নিয়ে প্রশাসনে জোর আলোচনা হচ্ছে। সেই পদে যাচ্ছেন পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়ন সচিব কবির বিন আনোয়ার।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদ হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিবের পদ। মুখ্যসচিব ড. আহমদ কায়কাউসের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের মেয়াদও শেষ হবে এ বছরই। মুখ্যসচিব পদে কে নিয়োগ পেতে পারেন, তা নিয়েও চলছে নানা গুঞ্জন।
এদিকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিব পদও শূন্য হচ্ছে। এ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কেএম আলী আজমের মেয়াদ ২ নভেম্বর শেষ হচ্ছে। এ পদের জন্য মাঠপ্রশাসনের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন কর্মকর্তাদের সাধারণত নিয়োগ দেয় সরকার। নির্বাচনের সময় এ মন্ত্রণালয় মাঠপ্রশাসনে নিয়োগ ও বদলির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এ পদের জন্য সরকারের প্রয়োজন আস্থাভাজন একজন কর্মকর্তা, যিনি নির্বাচনকালীন মাঠপ্রশাসনের নেতৃত্ব দেবেন। কেএম আলী আজমের স্থলাভিষিক্ত হওয়ার আগ্রহ রয়েছে সচিবালয়ের ৭ নম্বর ভবনের একজন সচিবের। তবে তিনি আগবাড়িয়ে তদবির করছেন না বলে জানা গেছে। ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪ পর্যন্ত চাকরির মেয়াদ থাকা ওই কর্মকর্তা সরকারের সবুজ সংকেতের অপেক্ষায় রয়েছেন।
চাকরির বয়স অনুযায়ী, নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসে অবসরে যাবেন ভূমি আপিল বোর্ডের চেয়ারম্যান অমিতাভ সরকার। পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য মামুন আল রশিদ, বিপিএটিসির রেক্টর রমেন্দ্রনাথ বিশ্বাস, ডাক ও টেলিযোগাযোগ সচিব এম খলিলুর রহমান, কৃষি মন্ত্রণালয়ের সচিব এম সাইদুল ইসলাম এবং বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন সচিব এম মোকাম্মেল হোসেন।
২০০৯ সাল থেকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগে দায়িত্ব পালন করে সরকার সমর্থক হিসেবে পদোন্নতি এবং গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব নিয়েছেন, এখন তারা চাকরিতে থাকতে চাইছেন না। এমন দুই-তিনজন সচিব অবসর উত্তর ছুটির আবেদন করেছেন সরকারের কাছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন