জনগণের রক্ষক হয়ে পুলিশের কতিপয় কর্মকর্তা ও সদস্য ভক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। একের পর এক ঘটনা ঘটলেও অনেকটা আড়ালে আবডালে থেকে যায়। ভুক্তভোগী সাহস করে মামলা করলে অপরাধে জড়িত পুলিশের ওইসব সদস্যের চরিত্র উন্মোচিত হয়। চলতি মাসেই ১৫ লাখ টাকা ছিনতাই ঘটনায় তিন পুলিশ সদস্য গ্রেফতার হওয়ার রেশ কাটতে না কাটতেই ক্রসফায়ারের হুমকি দিয়ে ৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে।
রাজধানীর মতিঝিলে গত ১২ অক্টোর একটি মানি এক্সচেঞ্জের দুই কর্মচারির কাছ থেকে ১৫ লাখ টাকা ছিনতাই করে তিন পুলিশ কনস্টেবল। ১৭ অক্টোবর মতিঝিল থানায় মামলা হলে সিসি ক্যামরোর ফুটেজে পরীক্ষা করে গ্রেফতার করা তিন কনস্টেবলকে। পুলিশের এই ক্ষত না শুকাতেই পুরানা পল্টন থেকে এক ব্যবসায়ীকে ধরে থানায় নিয়ে মিথ্যা মামলায় ফাঁসানোসহ পাঁচ লাখ টাকা চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠেছে শাহজাহানপুর থানার এসআই রফিকুল ইসলামসহ কয়েকজন পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে। ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী মো. মাহবুবুর রহমান এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে জড়িত পুলিশ সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইজিপি এবং ডিএমপি কমিশনারসহ সংশ্লিষ্ট দফতরে লিখিত অভিযোগ করেছেন। লিখিত অভিযোগে ভুক্তভোগী মাহবুবুর রহমান উল্লেখ করেন, তিনি রাজধানীর ওয়ারী থানাধীন গোপীবাগ ৮ম লেনের ৮৯/১, আর কে মিশন রোডের ভাড়া বাড়িতে সপরিবারে বসবাস করেন। এছাড়া পুরানা পল্টনে সুপার ওয়েস্টার্ন নামে একটি ট্রাভেলস এজেন্সীতে কাজ করেন। দেশের কোনো থানায় তার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট, মামলা এমনকি একটি জিডিও নেই।
তিনি বলেন, গত ১৬ অক্টোবর বিকাল সাড়ে ৩টায় পুরানা পল্টনে ট্রাভেল এজেন্সীর অফিসে প্রবেশ করার মুহূর্তে ভবনের দ্বিতীয় তলার সিড়িতে পেছন থেকে একজন আমার প্যান্টের বেল্ট টেনে ধরেন। পেছনে ফেরার চেষ্টা করতেই টেনে ধরা ব্যক্তি নিজেকে আইনের লোক পরিচয়ে বলেন, ‘অভিযোগের প্রেক্ষিতে আপনার দেহ তল্লাশী করতে হবে’।
এ সময় তার সঙ্গে আরো ২ জন সহযোগী ছিলো। সাদা পোশাকে থাকা ওই তিন জন আমাকে নিচ তলার সিড়ি সংলগ্ন একটি দোকানের সামনে নিয়ে দেহ তল্লাশী করে। তারা আমার সঙ্গে ট্রাভেল এজেন্সীর ব্যবসায়ীক ডকুমেন্টস ছাড়া কিছুই পায়নি। এরপর তারা অজ্ঞাত কাউকে ফোন দেয়। কিছুক্ষণ পর তারা পারভেজ নামে একজন বাইকারকে আমার সামনে নিয়ে আসে।
এ সময় পোশাক পরিহিত কয়েকজন পুলিশ সদস্য তার সঙ্গে ছিলো। তারা পারভেজের সঙ্গে আমাকেও হ্যান্ডকাপ পরিয়ে একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশায় চেপে শাহজাহানপুর থানার তৃতীয় তলায় নিয়ে যান। সেখানে গিয়ে জানতে পারি পুরানা পল্টনে আমাকে সাদা পোশাকে প্রথম যিনি দেহ তল্লাশী করেছেন তিনি শাহজাহানপুর থানার এসআই রফিক। তার সঙ্গে ছিলেন এএসআই মশিউর, এএসআই জামাল এবং কনস্টেবল মমিন।
এসআই রফিকের ফোন পেয়ে সিএনজি নিয়ে গিয়েছিলেন এএসআই সালাউদ্দিনসহ ২ জন কনস্টেবল। থানার তৃতীয় তলায় একটি কক্ষে তারা আমাকে ও পারভেজকে হ্যান্ডকাপ পরিহিত অবস্থাতেই গামাছা দিয়ে চোখ বেঁধে ফেলেন। তারা পারভেজকে নির্যাতন করে আমাকে মাদক ব্যবসায়ী বলে স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করে। একইভাবে তারা আমাকে নির্যাতন করে আমার কাছে বিপুল পরিমান মাদক আছে বলে স্বীকারোক্তি নেয়ার চেষ্টা করে।
অমানুষিক নির্যাতনে আমার জ্ঞান হারানোর উপক্রম হলে তারা একটি টেবিলে কিছু মাদকদ্রব্য সাজিয়ে রেখে আমার চোখ খুলে তার পাশে দাড় করিয়ে রাখে। মাদকদ্রব্য সামনে রেখে তারা নিজেদের মোবাইলে ভিডিওসহ বিভিন্ন এ্যাঙ্গেলে আমার ছবি তুলেন। এরপর এসআই রফিক মতিঝিল থেকে আমার পরিচিত জনশক্তি রফতানি ব্যবসায়ী মনির, মাসুম, তাজুল, জাকির শিপন, আইনাল সেলিমসহ কয়েক স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতাকে শাহজাহানপুর থানায় ডেকে নেন।
পুলিশ কর্মকর্তাদের মোবাইলে রেকর্ড করা ভিডিও দেখিয়ে আমার মুক্তির জন্য ১০ লাখ টাকা দাবি করেন। অন্যথায় রাতে ক্রসফায়ারে মেরে ফেলার হুমকি দেন। আমার জীবন রক্ষার্থে ব্যবসায়ী মনির এসআই রফিকের হাতে ৫ লাখ টাকা তুলে দেন। ওই টাকা পেয়ে এসআই রফিক আমাকে ছেড়ে দেয়ার নিশ্চয়তা দিয়ে তাদের থানা থেকে চলে যেতে বলেন।
তারা থানা থেকে চলে গেলে রাত ৮টার পর পারভেজসহ আমাকে নিয়ে যায় নাভানা টাওয়ার সংলগ্ন বারাকা হাসপাতালের পাশে। সেখানে আমাদের কিছুক্ষণ দাড় করিয়ে রেখে দু’জন লোক ডেকে আনে। আমাদের কাছ থেকে মাদক উদ্ধার হয়েছে মর্মে একটি কাগজে ওই লোকদের স্বাক্ষর রেখে আমাদেরকে ফের থানায় নিয়ে যায়। সেখানে আমার কাছ থেকে ২ বোতল ও পারভেজের কাছ থেকে ৩ বোতল ফেন্সিডিল উদ্ধার হয়েছে এমন অভিযোগ এনে এসআই রফিক বাদী হয়ে মাদক আইনে একটি মামলা দায়ের করেন।
জামিনের পর এসআই রফিক বিভিন্ন মাধ্যমে ভুক্তভোগী মাহবুবুর রহমানকে মুখ না খোলার জন্য হুমকি দিচ্ছেন। জানতে চাইলে পল্টন থানার ওসি সালাউদ্দিন মিয়া বলেন, ডিএমপির মধ্যে ভিন্ন থানা এলাকা থেকে কোনো আসামি ধরতে হলে ওই থানা কর্তৃপক্ষকে অবহিত করার নিয়ম রয়েছে। সরাসরি না হলেও ওয়্যারলেসের মাধ্যমে ম্যাসেজ দিতে হয়। ম্যাসেজ প্রদানের বিষয়টি এ মুহূর্তে তার মনে পড়ছে না।
এদিকে অন্য থানা এলাকা থেকে আসামি ধরতে যাওয়ার বিষয়টি জানা নেই শাহজাহানপুর থানার ওসি মনির হোসেন মোল্লার। তিনি বলেন, এ ধরনের একটি ঘটনায় তাকে কেউই অভিযোগ করেননি। বিষয়টি তিনি তদন্ত করে দেখবেন।
এসআই রফিকের দায়ের করা মামলার সাক্ষী বারাকা হাসপাতাল সংলগ্ন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হারেছ ও নবী হোসেন প্রায় একই সুরে ইনকিলাবকে বলেন, ঘটনার দিন দারোগা ডেকে নিয়ে দু’জন লোকের হাতে থাকা ব্যাগ থেকে বোতল জাতীয় কিছু বের করেন। এর ভেতর কি আছে না আছে তা আমাদের জানার কথা নয়।
অভিযোগ প্রসঙ্গে এসআই রফিকুল ইসলাম গতকাল ইনকিলাবকে বলেন, পল্টন থানা এলাকা থেকে কোনো আসামিকে গ্রেফতার কিংবা টাকা নেয়ার বিষয়টি সম্পূর্ণ মিথ্যা। মাহবুবুর রহমান নামে কোনো আসামিকে গ্রেফতার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রতিদিনইতো কত জনকে গ্রেফতার করি, সব কিছু কি আর মনে রাখা যায়?
অপরদিকে ভুক্তভোগী মাহাবুব বলেন, এসআই রফিকের লাঠিপেটায় তার দু’হাতের তালু প্রায় অকেজো। জামিনে মুক্তির পর তিনি বিষয়টি পুলিশের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবহিত করেছেন। সঠিকত তদন্ত ও ঘটনাস্থলের সিসি ফুটেজ পর্যালোচনায় আসল সত্য বেরিয়ে আসবে। প্রতিকার না পেলে তিনি আইনের আশ্রয় নিবেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন