২০১৩ সালে জাতীয় সংসদের অধিবেশন চলার সময় খাদ্যে বিষক্রিয়ায় সাবেক প্রেসিডেন্ট মরহুম এইচ এম এরশাদ গুরুত্বর অসুস্থ হয়ে পড়েন। ২৪ ঘণ্টায় ১৫ থেকে ২০ বার টয়লেটে গিয়ে কাহিল হয়ে সিএমএইচে ভর্তি হন। বিষয়টি জাতীয় সংসদে স্পিকারের নজরে আনা হয় এবং ভেজাল খাদ্য ইস্যুতে উত্তপ্ত হয়ে উঠে সংসদ। বিরোধী দলের এমপিরা খাদ্যে ভেজাল বন্ধের জন্য নতুন আইন করার দাবি তোলেন। বেগম রওশন এরশাদ খাদ্যে ভেজাল মেশালে সর্বনিম্ন ৭ বছর জেল এবং সর্বোচ্চ মৃত্যুদণ্ডের বিধান করে আইন পাসের দাবি জানান। ওই সময় ‘ভেজালমুক্ত খাদ্য’ নিশ্চিত করতে ‘নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩’ আইন পাস করা হয়। কিন্তু ওই পর্যন্তই। এরশাদের মতোই দেশের কত মানুষ ভেজাল খাবার খেয়ে অসুস্থ হয়েছেন, ক্যান্সার, কিডনি, লিভারের রোগে আক্রান্ত হয়েছেন তার সঠিক হিসেব নেই। গত ১০ বছরে ভেজালমুক্ত খাদ্য নিশ্চিত করতে আইনের প্রয়োগ নেয়া হয়নি। মাঝেমধ্যে অভিযান, ভ্রাম্যমাণ আদালত বসানো হলেও সেটা টিভি ক্যামেরানির্ভর। খাদ্যে ভেজাল মেশানোর অপরাধে কয়েক হাজার টাকা জরিমানা করা হয়, এ পর্যন্তই। ফলে সারাদেশ ভেজাল খাদ্যে সয়লাব হয়ে গেছে।
বর্তমানে বাজারের চিত্র কি? সব খাদ্যেই ভেজাল। বাজার থেকে ভেজালমুক্ত খাদ্য ক্রয় করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে। দেশের প্রতিটি খাদ্যপণ্যের মূল্য ঊর্ধ্বমুখী। যে পণ্যের দাম যতবেশি বাড়ে সে পণ্যে ততবেশি ভেজাল মেশানো হয়। আর এই ভেজাল খাদ্য এবং খাদ্যের বিষে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। বাড়ছে ক্যান্সার, কিডনি ও লিভারের রোগ। দূষিত খাবার ক্রমাগত গ্রহণের কারণে অকালে মানুষ মারা যাচ্ছে। ফলে কর্মক্ষম মানুষের অভাবে প্রকারান্তরে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে দেশের অর্থনীতি।
জানতে চাইলে কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, আমরা যে যেখানে আছি, সবাই যেটা করছি, সেটা হলো নিজের লাভ করছি। অন্যের ক্ষতি দেখছি না। আমাদের নীতি-নৈতিকতা, মানবতাবোধ-এগুলোর অবক্ষয় হয়েছে। লাভের জন্য আমরা মানুষকে বিষ খাওয়াতে পিছপা হই না। এটার পরিবর্তন দরকার। সামাজিক আন্দোলন দরকার। জনসচেতনতার পাশাপাশি শাস্তির যে ব্যবস্থা করতে হবে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ছিল কোনোদিন? ছিল না। এখন কাজ করছে। তবে এসব সংস্থা এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কার্যক্রমকে আরো জোরদার করতে হবে। যাতে যারা অপকর্ম করে, তাদেরকে দ্রুত বিচারে আওতায় এনে কঠোর শাস্তি দেয়া যায় এবং বিচার ব্যবস্থার একটা বিশাল ভূমিকা আছে। আমাদের বিচার ব্যবস্থায় দীর্ঘসূত্রিতা আছে, এটা দূর করে যে অপরাধ করবে বিশেষ করে ভেজাল, নকল, মানুষের জীবন নিয়ে যারা ব্যবসা করে যারা লাভবান হতে চায়; তাদের দৃষ্টান্তমূলক ও দ্রুততার সঙ্গে শাস্তি দিতে হবে।
গতকাল মহাখালীর স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সম্মেলন কক্ষে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে স্বাস্থ্যসেবার মান বৃদ্ধিতে করণীয় বিষয়ে মতবিনিময় সভায় স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, বিষাক্ত ওষুধ মেশানো ভেজাল খাদ্য দিয়ে দেশ ভরে গেছে। যে খাবারগুলোই আমরা খাচ্ছি তার সবই প্রায় ভেজাল মেশানো। চাল, ডাল, মশলা, মাছ থেকে শুরু করে শাক-সবজিসহ প্রায় সব খাদ্যেই বিষ মেশানো হচ্ছে। সেই বিষ মেশানো খাবারগুলো আমরা নিজেরা খাচ্ছি, আমাদের পরিবারের ছোট-বড় সবাই খাচ্ছে।
রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরগুলোতে বিক্রি হওয়া সব খাবারই ভেজাল। চাল-ডাল-তেল-লবণ থেকে শুরু করে শাকসবজি, ফলমূল, শিশুখাদ্য সবকিছুতেই ভেজাল। মাছে ও দুধে ফরমালিন, সবজিতে কীটনাশক ও ফরমালিন, মচমচে করার জন্য জিলাপি ও চানাচুরে মবিল, লবণে সাদা বালু, চায়ে করাতকলের গুঁড়ো, মসলায় ভুসি, কাঠ, বালি, ইটের গুঁড়ো ও বিষাক্ত গুঁড়ো রং মেশানো হয়। এমনকি ইসবগুলের ভুসিতে ভুট্টার গুঁড়ো মিশানো হচ্ছে বলে পরীক্ষায় ধরা পড়েছে। টেক্সটাইল ও লেদারের রং মেশানো হচ্ছে সস্তা মানের বিস্কুট, আইসক্রিম, জুস, সেমাই, নুডলস ও মিষ্টিতে। শুধু কি তাই, মুড়িতে মেশানো হচ্ছে হাইড্রোজ, ফলে মুড়ি দেখতে চকচকে ও সাদা হয়, ফুলে-ফেঁপে বড় আকৃতি ধারণ করে। হাইড্রোজ একটি ক্ষারীয় পদার্থ, যা পেটে গিয়ে পড়ে রক্তের সঙ্গে মিশে শ্বেত কণিকা ও হিমোগ্লোবিনের কার্যকারিতা নষ্ট করে দেয়।
খাদ্য উৎপাদনেরও ফসলে কীটনাশকের ব্যাপক অপপ্রয়োগ এবং মাত্রাতিরিক্ত সার ব্যবহারে খাদ্য দূষিত হচ্ছে। একই সঙ্গে অনেক মজুতদার, পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা খাদ্যে বিভিন্ন ক্ষতিকর রাসায়নিক ফরমালিন, কার্বাইড, ইথোফেন, কীটনাশক, কাপড়ের রং মেশাচ্ছে। মেশানো হচ্ছে হরমোন ও অ্যান্টিবায়োটিক। প্রক্রিয়াজাত খাদ্যেও নানা ধরনের বিষাক্ত রাসায়নিক মেশানো হচ্ছে। অথচ ২০১৩ সালের ১০ অক্টোবর জাতীয় সংসদে দেশের নাগরিকের জীবন ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় নিরাপদ খাদ্যপ্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে ‘নিরাপদ খাদ্য আইন-২০১৩’ অনুমোদিত হয়। এ আইন বাস্তবায়নের জন্য নিরাপদ খাদ্য বিধিমালা ২০১৪ তৈরি হয়েছে। খাদ্যে ভেজাল ও ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ মেশানোর দায়ে সর্বোচ্চ ৫ বছরের কারাদণ্ড ও ২০ লাখ টাকার জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে। ২০১৫ সালের ২ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ গঠিত হয়েছে। একই সঙ্গে ২০১৮ সালে অনুমোদিত হয়েছে ‘নিরাপদ খাদ্য (স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ সংরক্ষণ) প্রবিধানমালা ২০১৮’। কিন্তু ওই আইন কেতাবের মধ্যে সীমাবদ্ধ! ভেজাল খাদ্যে বাজার ছয়লাব হয়ে গেছে। রাস্তার ফুটপাত থেকে শুরু করে বড় বড় হোটেলে ভেজাল খাবারের মহাসমারোহ চলছে। কিন্তু বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ কি কাজ করছে তা নিয়ে প্রশ্ন রয়ে গেছে।
গবেষণা সংস্থা গ্লোবক্যানের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতি বছর দেড় লাখ মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়, যার মধ্যে মারা যায় ৯১ হাজার ৩০০ জন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, কিডনি জটিলতায় দেশে ২০১৯ সালে যত মানুষ মারা গেছে, তার প্রায় তিন গুণ মানুষ মারা গেছে ২০২০ সালে। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে কিডনি সংক্রান্ত জটিলতায় আক্রান্ত হয়ে মারা গেছে ২৮ হাজার ১৭ জন। আর ২০১৯ সালে মারা গেছে ১০ হাজার ৬২২ জন। বাংলাদেশে প্রতি বছর ২ লাখ ৭৭ হাজার মানুষ হৃদরাগে মারা যায়, যার ৪ দশমিক ৪১ শতাংশের জন্য দায়ী ট্রান্সফ্যাট।
দেশের বাজারগুলোতে ভেজাল খাবার তদারকি দায়িত্ব যাদের সেই সব প্রতিষ্ঠান কার্যত দায়সারাভাবে দায়িত্ব পালন করছে। বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর, বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস এন্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) জেগেই ঘুমাচ্ছে। ভেজাল খাদ্য নিয়ে হৈচৈ শুরু হলে এসব প্রতিষ্ঠান অভিযান চালায় এবং ভ্রাম্যমাণ আদালত বসায়। কিছু প্রতিষ্ঠানের জরিমানা করেন। বড় বড় কর্পোরেট হাউজ এবং বড় হোটেল, সুপারশপগুলোতে অভিযান চালিয়ে ভেজাল খাদ্য ও নকলপণ্য পেলে পর্দার আড়ালে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে সমঝোতা করে; নামে মাত্র জরিমনা করে নিজেদের পকেট ভরে থাকে। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় নামকরা হোটেল এবং ফাস্টফুডের দোকানে অনুসন্ধান করে এ চিত্র পাওয়া গেছে। মাঝেমধ্যে দেখা যায় পণ্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে বাজারে তদারকিতে গিয়ে বেশি মূল্য নেয়ায় দোকানীদের জরিমানা করা হয়। অথচ ভেজাল পণ্যের বিষয়ে কোনো প্রশ্ন করা হয় না।
শুধু তাই নয়, যুক্তরাজ্যভিত্তিক দি ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (ইআইইউ) ‘গ্লোবাল ফুড সিকিউরিটি ইনডেক্স ২০২২’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের সর্বোত্রই ভেজাল খাবার চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয় ভেজাল খাদ্যের তালিকায় বিশ্বের ১১৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৮০তম। দেশের ন্যাশনাল ফুড সেফটি ল্যাবরেটরির গবেষণায়ও গরুর দুধ, দইয়ের মধ্যে বিপজ্জনক মাত্রায় অণুজীব, অ্যান্টিবায়োটিক, কীটনাশক এবং সিসা পাওয়া যায়। জনস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের পরীক্ষাগারে বাজারের বিভিন্ন কোম্পানির তরল দুধের নমুনা পরীক্ষা করে এতে অ্যালড্রিনের উপস্থিতি পেয়েছে।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেন বলেছেন, ভেজাল খাবারের কারণেই দেশে ওষুধের ব্যবসা এত বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, ভেজাল খাদ্যের কারণে মানুষের দেহে ক্যান্সার, কিডনিসহ বড় বড় জটিল রোগগুলো এখন দ্বিগুণ হারে বেড়ে যাচ্ছে। ভেজাল খাবারের কারণেই দেশে ওষুধের ব্যবসা এত বেড়ে গেছে, হাসপাতালে হাসপাতালে রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। সরকারি হাসপাতালের ফ্লোরেও রোগীদের এখন জায়গা হয় না। উন্নত দেশগুলোতে আর যাই হোক খাদ্যে বিষ মেশালে সেই কোম্পানি যত ক্ষমতাধরই হোক, কোনো ছাড় দেয়া হয় না। আমাদের দেশে এখন হোটেলে ভেজাল খাবার, দোকানে ভেজাল খাবার, বাজারে ভেজাল খাবারসহ সর্বোত্র ভেজাল খাবার দেয়া হচ্ছে। মানুষ যাবে কোথায়? খাবে কী? এভাবে তো চলতে দেয়া যায় না। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুস্থ জীবন দিতে হলে এই ভেজাল কারবারিদের এখনই থামিয়ে দিতে হবে। খাদ্যে ভেজাল দেয়া বন্ধ করতে হবে। এটি করতে আমাদের স্বাস্থ্যখাতের ভূমিকা আরো জোরালো করার পাশাপাশি সমাজের সকল স্তরের মানুষকে সম্পৃক্ত করতে হবে এবং একযোগে কাজ করতে হবে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী প্রশ্ন রেখে বলেন, ভেজাল খাদ্য প্রতিরোধে কোনো মন্ত্রণালয়ের কী দায়িত্ব সেটি নিয়ে পড়ে থাকলে এই ভেজাল আর বন্ধ হবে না। ভেজাল প্রতিরোধ করা ও নিয়ন্ত্রণ করা অন্য মন্ত্রণালয়ের কাজ হতে পারে, কিন্তু চিকিৎসা তো স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কেই দিতে হবে। কাজেই আগামী এক মাসের মধ্যেই স্বাস্থ্য খাতের পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট কিছু টিম গঠন করে মাঠে নেমে যেতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন