এক দশকের বেশি সময় ধরে দেশে বিনিয়োগে মন্দা চলছে। বৈদেশিক কর্মসংস্থানেও নানা রকম প্রতিবন্ধকতা অব্যাহত রয়েছে। সউদি আরব, মালয়েশিয়ার মত ট্রাডিশনাল শ্রমবাজারে বাংলাদেশী শ্রমিকদের জন্য ভিসা জটিলতা নিরসন করে আরো বেশি সংখ্যক শ্রমিক পাঠানোর সুযোগ বার বার হাতছাড়া হয়েছে। তবে এসব শ্রমবাজারে অদক্ষ পুরুষ শ্রমিকের নিয়োগ থমকে দাঁড়ালেও নারী শ্রমিক ও গৃহকর্মী নিয়োগ এখনো অবারিত রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে নারী শ্রমিকদের নিয়োগ গত দুই দশকে দেশের বৈদেশিক কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক অগ্রগতি হিসেবে বিবেচনা করা যায়। বিভিন্ন দেশে এক কোটির বেশি প্রবাসী শ্রমিকের মধ্যে ১০ লক্ষাধিক নারী শ্রমিক রয়েছে। বৈশ্বিক মন্দা এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থানে স্থবিরতার মধ্যেও নারী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিটেন্স আশার আলো জাগানিয়া ভ‚মিকা রাখছে। মধ্যপ্রাচ্যে নারী শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের মূল বিশেষত্ব হচ্ছে, শূণ্য অভিবাসন ব্যয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত নারী শ্রমিকরা বছরে গড়ে আড়াই লাখ টাকা আয় করছে। সরকারি হিসাবে শুধুমাত্র সউদি আরবেই সাড়ে চার লাখের বেশি বাংলাদেশী নারী শ্রমিক কর্মরত রয়েছে। সউদিতে কর্মরত নারী শ্রমিকরা প্রতিমাসে সাড়ে ১২শ কোটি টাকা দেশে পাঠাচ্ছে বলে বিএমইটির সুত্রে জানা যায়।
দেশের জনসংখ্যার অর্ধেকই নারী। নারীর শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও সামাজিক-অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকা পালন করে। প্রবাসে পুরুষ শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের পাশাপাশি নারী শ্রমিক নিয়োগের সাম্প্রতিক প্রবনতা গতানুগতিক ধারণাই পাল্টে দিয়েছে। এর ফলে নারী-পুরুষে অর্থনৈতিক বৈষম্য কমিয়ে আনার সাথে সাথে নারীর সামাজিক দায়বদ্ধতা ও আত্মনির্ভরতার স্থানকেও মজবুত করেছে। অনেক পরিবারেই কোনো পুরুষ সদস্য নেই। একটি দরিদ্র পরিবারের পুরুষ সদস্যের মৃত্যুতে সন্তানের লেখাপড়া ও ভরণপোষণের সুযোগ রুদ্ধ হয়ে যখন পুরো পরিবারটির আত্মীয় স্বজন ও সমাজের বোঝা বা গলগ্রহ হওয়া ছাড়া কোনো গত্যন্তর ছিল না। নারী শ্রমিকের প্রবাসে কর্মসংস্থানের সুযোগ পরিবারের অর্থনৈতিক সুরক্ষা দিয়েছে। তবে সব সমাজেই ভালমন্দের সহাবস্থান রয়েছে। সউদী আরবের মত পবিত্র ভ‚মিতেও বাংলাদেশি নারী গৃহকর্মীরা বৈষম্য, নিগ্রহ ও অধিকারহরণের শিকার হচ্ছে। ন্যায্য মজুরি না পাওয়া, যৌন নিগ্রহ ও নির্যাতনের শিকার হয়ে নারী শ্রমিকদের দেশে প্রত্যাবর্তনের কাহিনীও গণমাধ্যমে প্রকাশিত হচ্ছে। সউদী বা আরব আমিরাতে গৃহকর্মী অথবা জর্দানের পোশাক কারখানায় নারী শ্রমিকদের বঞ্চনার শিকার হওয়ার মত ঘটনাগুলোর আইনগত প্রতিকার নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন। সুষ্ঠু বিচার ও প্রতিকার না পেয়ে প্রবাসে নারী শ্রমিকদের আত্মহত্যার মত ঘটনার দায় সরকারের সংশ্লিষ্টরা এড়াতে পারেনা।
রফতানি বাণিজ্য, বৈদেশিক কর্মসংস্থানসহ দেশের অর্থনীতির মূল খাতগুলোতে মন্দা চলছে। এর মধ্যেও দেশ থেকে প্রতিমাসে নানাভাবে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। আশার কথা হচ্ছে, বৈদেশিক কর্মসংস্থান খাতে পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও ক্রমবর্ধমান হারে ভ‚মিকা রাখছে। এ ক্ষেত্রে প্রবাসে নারীদের ব্যক্তিগত ও অর্থনৈতিক নিরাপত্তার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়, দফতর ও দূতাবাসগুলো আশানুরূপ ভ‚মিকা পালন করতে ব্যর্থ হচ্ছে। আমাদের নারী-পুরুষ শ্রমিকরা বিদেশে যেমন মজুরি বৈষম্য মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হচ্ছে, একইভাবে দেশেও সংশ্লিষ্ট রিক্রুটিং এজেন্সি, তাদের দালালদের অতিরিক্ত মুনাফাবাজির শিকার হচ্ছে। শূণ্য অভিবাসন ব্যয়ে নিয়োগ প্রাপ্তির কথা বলা হলেও একেকজন নারী শ্রমিককেও দেড়-দুইলাখ টাকা ব্যয় করে বিদেশে যেতে হচ্ছে। ধার-দেনা, ঋণ করে বিদেশ যাওয়ার পর নিয়োগকর্তার নির্মম আচরণ ও হয়রানির শিকার হয়ে দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হচ্ছে অনেকে। অনেক স্বপ্ন নিয়ে বিদেশ গিয়ে তারা উপরন্তু ঋণগ্রস্ত ও সর্বস্বান্ত হয়ে মানবেতর জীবন বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে। এহেন বাস্তবতায় প্রবাসে নারী শ্রমিক পাঠানোর ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট রিক্রুটিং এজেন্সির কর্মকান্ডে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা জরুরি। সেই সাথে প্রবাসে নিয়োগকর্তার দ্বারা নিগ্রহ, অনৈতিক আচরণের শিকার হওয়ার পর সে দেশের আইনে সুষ্ঠু বিচার ও ক্ষতিপুরণ পাওয়ার আইনগত প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও দূতাবাসসমুহের সংশ্লিষ্ট উইংকে আরো দক্ষতা ও দায়িত্বশীলতা নিশ্চিত করতে হবে। বিদেশে নারী-পুরুষ অদক্ষ শ্রমিক ও গৃহকর্মী পাঠানোর ক্ষেত্রে তাদেরকে নতুন দেশ ও কর্মস্থল সম্পর্কে ন্যূনতম ধারণা ও শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষত জরুরি প্রয়োজনে হটলাইনে যোগাযোগের সুযোগ নিশ্চিত করা হলে নির্যাতনের শিকার প্রবাসী শ্রমিকদের আত্মহত্যা বা মানসিক ট্রমায় আক্রান্ত হওয়ার হার অনেক কমবে। প্রবাসি নারী শ্রমিকদের মর্যাদার সাথে দেশের মানমর্যাদা, সামাজিক অগ্রগতি ও স্থিতিশীলতার গভীর যোগসুত্র রয়েছে। সরকারকে এ দিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে নজরদারি বাড়াতে হবে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন