এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নে (আকু) আমদানি বিল পরিশোধের পর বাংলাদেশের বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভ আবারো ধাক্কা খেলো। গত রোববার রিজার্ভ ছিল ৩৫ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলার। এরপর ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার আকু বিল পরিশোধ করায় তা কমে ৩৪ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও আইএমএফের চলমান বৈঠকগুলোতে রিজার্ভের হিসাব নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়। জানা গেছে, রফতানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) সরবরাহ করা ৭ বিলিয়ন ও শ্রীলঙ্কাকে দেওয়া ২০ কোটি ডলার রিজার্ভে দেখাচ্ছে। এছাড়া গ্রিন ট্রান্সফরমেশন ফান্ড (জিটিএফ) ২০ কোটি, লং টার্ম ফিন্যান্সিং ফ্যাসিলিটি (এলটিএফএফ) তহবিলে ৩ কোটি ৮৫ লাখ, সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিমানকে ৪ কোটি ৮০ লাখ এবং ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স করপোরেশনের (আইটিএফসি) আমানত রিজার্ভে দেখাচ্ছে। কিন্তু ঋণ দেওয়া এসব অর্থ রিজার্ভে অন্তর্ভুক্ত করতে নারাজ আইএমএফ।
গত বছরের ডিসেম্বরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪৬ দশমিক ১৫ বিলিয়ন ডলার। আগস্টে ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার। এই রিজার্ভ কমতে কমতে এখন ৩৪ বিলিয়ন ডলারে এসে দাঁড়ালো।
আকু হলো এমন একটি ব্যবস্থা যার মাধ্যমে অংশগ্রহণকারী দেশগুলো আঞ্চলিক লেনদেনের জন্য আমদানি পেমেন্ট নিষ্পত্তি করে। বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত, ইরান, মালদ্বীপ, মিয়ানমার, নেপাল, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা এর সদস্য। এই ব্যবস্থায় দেশগুলোর কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোকে প্রতি দুই মাস অন্তর আমদানির অর্থ পরিশোধ করতে হয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আছে ৩৫ দশমিক ৭২ বিলিয়ন ডলার। রোববার আন্ত-আঞ্চলিক লেনদেন নিষ্পত্তিকারী সংস্থা-আকুর (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর) আমদানি বিল বাবদ ১৩০ কোটি ডলার পরিশোধ করা হয়। এতে করে রিজার্ভ নেমেছে ৩৪ দশমিক ৪২ বিলিয়ন ডলারে। আইএমএফের দেওয়া শর্তে হিসাব করলে যা কমে দাঁড়াবে ২৬ দশমিক শূন্য ২ বিলিয়ন ডলারে।
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের এ পর্যন্ত ৫১৪ কোটি ২৩ লাখ ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত ২০২১-২২ অর্থবছরে বিক্রি করা হয় ৭৬২ কোটি ১৭ লাখ ডলার। তার আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক যেখানে বিভিন্ন ব্যাংক থেকে কিনেছিল প্রায় ৭৯৩ কোটি ডলার। ফলে ডলার কেনার চেয়ে এখন বিক্রির চাপ বেশি হওয়ায় রিজার্ভ কমছে।
রফতানি আয় বাড়লেও অস্বাভাবিকভাবে আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়া, প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) কমে যাওয়ায় ডলারের ওপর চাপ তৈরি হয়, রিজার্ভে যার প্রভাব পড়েছে বলে মনে করেন অর্থনীতিবিদরা। কয়েক মাস ধরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডলারের মজুত চাপে আছে বলেও জানান তারা।
জানা গেছে, গত বছরের শুরুতে মহামারি করোনার কারণে প্রবাসীরা এক ধরনের অনিশ্চয়তা থেকে তাদের জমানো টাকা দেশে পাঠিয়েছিলেন। অনেকে চাকরি হারিয়ে কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ করে সব অর্থ দেশে এনেছেন। এছাড়া গত বছরের শুরুতে করোনার স্থবিরতার কারণে হুন্ডি প্রবণতাও কমে যায়। ফলে ব্যাংকিং চ্যানেলে পাঠানো অর্থের পরিমান বেড়ে যায়।
এসব কারণে মহামারির মধ্যেও রেমিট্যান্সপ্রবাহ বেড়েছিল। এখন অনেকে দেশে এসে আটকা পড়েছেন। আবার অনেক প্রবাসী নতুন করে ব্যবসা শুরু করতে গিয়ে দেশে রেমিট্যান্স পাঠানো কমিয়ে দিয়েছেন। হুন্ডিও বাড়ছে। ফলে প্রবাসী আয় নিম্নমুখী রয়েছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ বলেন, বর্তমানে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সঙ্কটে দিন কাঁটাচ্ছি। রিজার্ভ কমে যাওয়াটা অর্থনীতির জন্য ভালো খবর না। বাংলাদেশ এখন বড় চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে। এ চ্যালেঞ্জ রুখতে হলে আমাদের রেমিট্যান্স বাড়ানোর ওপর জোর দিতে হবে। ডলারের রেট একেক সময় একেকটা দেওয়া হচ্ছে, এটা ঠিক নয়। এখন বাজারের ওপর রেট ছেড়ে দেওয়া উচিত। অর্থাৎ প্রয়োজন মতো রেট দিয়ে ব্যাংকগুলো ডলার কিনবে। এতে করে ১১২ হোক, তা বিষয় নয়। রেমিট্যান্স আনা জরুরি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ১০ বছর আগে ২০১৩ সালের জুন শেষে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ১৫ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলার। পাঁচ বছর আগে ছিল ৩৩ দশমিক ৬৮ বিলিয়ন ডলার। সেখান থেকে বেড়ে ২০২০ সালের ১ সেপ্টেম্বর বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৯ বিলিয়ন ডলারের ঘরে পৌঁছায়। ওই বছরের ৮ অক্টোবর ৪০ বিলিয়ন ডলারের নতুন মাইলফলক অতিক্রম করে। এর পর তা বেড়ে গত বছরের আগস্টে প্রথমবারের মতো ৪৮ দশমিক শূন্য ৬ বিলিয়ন ডলার হয়। এরপর থেকে গত কয়েক মাস ধরে রিজার্ভ ধারাবাহিকভাবে কমছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন