গুলিস্তানকে বলা হয় রাজধানী ঢাকার প্রাণকেন্দ্র। এই গুলিস্তানে গেলেই গোলকধাঁধাঁয় পড়তে হয় মানুষকে। কোনটা যানবাহন চলাচলের রাস্তা, মানুষের পায়ে হাঁটার ফুটপাথ, মার্কেট বোঝার উপায় নেই। ফুটপাথজুড়ে হকারদের বিভিন্ন পণ্যের পসরা, সড়কের কোথাও দোকান, কোথাও বাসস্ট্যান্ড, সড়কের উপর সারি সারি দোকান। হেঁটে চলাচলের উপায় নেই। গুলিস্তান বঙ্গবন্ধু অ্যাভেনিউ, জিপিওর আশপাশকে ‘রেড জোন’ ঘোষণা করেছে ডিএসসিসি। রেড জোন ঘোষিত এলাকায় হকার বসতে পারবে না। কিন্তু কে শোনে কার কথা? সকালে পুলিশ উচ্ছেদ করছে; বিকেলে ফের দোকানের পসরা সাজিয়ে হকাররা বসছেন। গুলিস্তানজুড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও হকার, পরিবহন শ্রমিকদের মধ্যে টম জেরির খেলা চলছে। হকার, দোকানদার ও পরিবহন শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী উচ্ছেদ করলেও তাদের প্রতিদিন মোটা অঙ্কের চাঁদা দিয়ে ব্যবসা করা হচ্ছে। যানবাহন রাস্তায় পার্ক করে রাখার জন্যও চাঁদা গুনতে হচ্ছে।
রেড জোন ঘোষণা, বার বার উচ্ছেদের পরও কোনো কাজে আসছে না, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) নির্দেশনা। হকারদের দৌরাত্ম্যে পুরোনো রূপেই ফিরে এসেছে রাজধানীর গুলিস্তান এলাকা। কোনোভাবেই একবারের জন্য হলেও বুঝার উপায় নেই যে, এসব স্থানকে রেড জোন এলাকা হিসেবে নির্দেশনা দিয়ে দেয়া হয়েছে। যেখানে কোনোভাবেই কোনো ধরনের হকার বা দোকান বসানো যাবে না বরং সেখানে আগের মতোই বীরদর্পে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন হকাররা। তবে হকাররা বলছেন, তারা ঠিক মতোই টাকা দিয়ে দোকান বসানোর মৌখিক অনুমতি নিয়েছেন। টাকা দিয়েই ব্যবসা করতে হচ্ছে তাদের। লাইনম্যানকে টাকা দিয়েই ব্যবসা করছেন তারা।
জানা যায়, ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ সড়ক ও পথচারীদের চলাচলের জায়গা হকারদের দখলমুক্ত করার পদক্ষেপ নিয়েছে ডিএসসিসি। সড়কগুলোকে গুরুত্ব অনুসারে লাল, হলুদ ও সবুজ জোনে ভাগ করা হয়েছে। সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে গুলিস্তান, বঙ্গভবন, সচিবালয় ও মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার এলাকাকে লাল চিহ্নিত জোন ঘোষণা করে উচ্ছেদের নির্দেশ দেয়া হয়। মাঝেমঝ্যে হকার উচ্ছেদ অভিযান চালায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি)। ঢাকঢোল পিটিয়ে উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনা করা হয় রেড জোন এলাকায়। কিন্তু উচ্ছেদের পর থেকেই আবার বসা শুরু করে। এভাবে কয়েক দফা অভিযান পরিচালনা করা হয়; কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না। ফের হকারদের দখলে চলে যায় গুলিস্তানসহ আশপাশের ফুটপাথ-রাস্তা। ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ঘোষিত ‘রেড জোন’ ফিরেছে সেই আগের চেহারায়। বঙ্গভবন থেকে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারগামী ও ফ্লাইওভার থেকে গুলিস্তান চত্বর পর্যন্ত সড়ককে রেড জোন ঘোষণা করে হকার উচ্ছেদ অভিযান চালায় ডিএসসিসি। সরিয়ে দেয়া হয় দখলদারদের। ফুটপাথ থেকে সহস্রাধিক হকার উচ্ছেদ করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ভ্রাম্যমাণ আদালত।
ইতোমধ্যে দক্ষিণ সিটির প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ মো. সিরাজুল ইসলামকে আহ্বায়ক করে ৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। দক্ষিণ সিটির সচিব আকরামুজ্জামানের স্বাক্ষরিত এক দফতর আদেশে এ কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটি দক্ষিণ সিটি প্রণীত মহাপরিকল্পনার সাথে সমন্বয় রেখে রাস্তা ও হাঁটার পথ যানবাহন ও মানুষ চলাচলের জন্য নির্বিঘ্ন রাখার লক্ষ্যে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও ব্যবস্থাপনা করবে। লাল শ্রেণি এলাকা হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা এবং রাস্তা বিবেচনায় কখনই উক্ত রাস্তায় হকার বসতে পারবে না; হলুদ শ্রেণি এলাকা হচ্ছে দক্ষিণ সিটি কর্তৃক নির্ধারিত সময়ে ও নির্ধারিত স্থানে হকার বসতে পারবে এবং সবুজ শ্রেণি এলাকা হচ্ছে, যে সকল এলাকায় প্রয়োজন অনুযায়ী আংশিক অংশে হকার বসলে পথচারী বা যান চলাচলে কোনোরূপ বিঘ্ন ঘটবে না।
অফিস আদেশে বলা আছে, কমিটি প্রতিমাসে কমপক্ষে এক বার সভা করবে এবং প্রয়োজন অনুযায়ী একাধিকবার সভা করবে। বিশেষ করে বঙ্গভবন থেকে সচিবালয় (জিরো পয়েন্ট) এবং মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার থেকে গুলিস্তান চত্বর ভিভিআইপি চলাচল করে এবং একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ সড়ক। উক্ত সড়কগুলো হকার মুক্ত করার লক্ষ্যে উক্ত কমিটিতে পেশ করতে হবে।
গতকাল বুধবার সরেজমিন দেখা যায়, গুলিস্তান মোড়ে, হকি স্টেডিয়ামের সামনে থেকে পাতাল মার্কেট, ঢাকা ট্রেড সেন্টারসহ সব ফুটপাথ আবার হকারদের দখলে। এমনকি রাস্তা দখল করেও চলছে হকারদের বেচাকেনা। ফুটপাথে পলিথিন দিয়ে ছাউনি বানিয়ে কাপড়ের পসরা সাজিয়ে বসেছেন হকাররা। গুলিস্তান সাধারণ বীমা করপোরেশন ভবনের সামনের ফুটপাথে চৌকিতে জুতা, গেঞ্জি, কাপড় বিক্রি করছেন হকাররা। গুলিস্তান রাজধানী রেস্টুরেন্টের সামনের রাস্তার দুই অংশই দখল করে রেখেছে হকাররা। এখানে জুতা, বেল্ট, কাপড়, গেঞ্জি, ফলের দোকানসহ রয়েছে নানা পণ্যের দোকান। এসব দোকানের বেচাবিক্রির কারণে রাস্তা দিয়ে যান চলাচল কার্যত বন্ধই থাকে সব সময়। সার্জেন্ট আহাদ পুলিশ বক্স এলাকায় ফুটপাথে বসানো হয়েছে মোবাইল ফোনের যন্ত্রাংশের দোকান। ফুটপাথের কোথাও কোথাও বসানো হয়েছে অস্থায়ী খাবারের দোকান। এসব দোকানের ভিড়ের কারণে রাস্তায় লেগে থাকে যানজট।
ঢাকা ট্রেড সেন্টারের সামনে ব্যবসা করছেন আজহার। তিনি বলেন, এখানেই দীর্ঘদিন যাবত ব্যবসা করছি। এছাড়া আর আমাদের যাবার জায়গা নাই। এখান থেকে যতবার উঠিয়ে দিবে, ততবার বসতে হবে। অন্য কোথাও তো যেতে পারব না। বাসায় আর কেউ ইনকাম করার মতো নেই। একজনের ইনকাম দিয়ে সংসার চলে। এই ব্যবসা ছাড়া অন্য কোনো পথ নাই। যখন অভিযান হয়, তখন জিনিসপত্র নিয়ে চলে যাই, অভিযান শেষে আবার বসে পরি। এভাবেই কষ্ট করে ব্যবসা চালিয়ে যেতে হয়। তবে আমাদের একটা স্থায়ী ব্যবস্থা করে দিলে আমরা তো আর ফুটপাথে দোকান বসাব না।
দক্ষিণ সিটির সম্পত্তি কর্মকর্তা মো. মুনিরুজ্জামান বলেন, পদ্মা সেতু দিয়ে যান চলাচল শুরুর পর হতে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার দিয়ে যান চলাচলের পরিমাণ বেড়েছে। তাই মেয়র হানিফ ফ্লাইওভার দিয়ে যান চলাচল ও সংশ্লিষ্ট এলাকায় জনসাধারণের চলাফেরা নির্বিঘ্ন করতে মেয়র মহোদয়ের নির্দেশনায় গুলিস্তান জিরো পয়েন্ট হতে বঙ্গবন্ধু এভিনিউ হয়ে সার্জেন্ট আহাদ পুলিশ বক্স এবং বঙ্গভবন ও মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারগামী ও ফ্লাইওভার হতে গুলিস্তান চত্ত্বর এলাকাকে ‘রেড জোন’ ঘোষণা করা হয়েছে। এই রেড জোন হতে সকল প্রকার হকার এবং রাস্তা ও ফুটপাথ দখল করে অবৈধভাবে গড়ে তোলা স্থাপনা উচ্ছেদে অভিযান পরিচালনা করা হয়। আমরা এখানে কোনো হকার বসতে এবং কাউকে অবৈধভাবে দোকানপাট ও স্থাপনা নির্মাণ করতে দেবো না। আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে।
তিনি আরও বলেন, বিষয়টি আমরাও খেয়াল করেছি। উচ্ছেদ অভিযানের পর আবার তারা বসে পড়ে তাই হকাররা যতবার ফুটপাথ দখল করবে, ততবার অভিযান চালাব। মেয়রের কঠোর নির্দেশ আছে, কোনোভাবেই আর ফুটপাথ-রাস্তা দখল হতে দেয়া যাবে না।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন