‘বাইরে ফিটফাট ভেতরে সদরঘাট’ প্রবাদটি এখন বিমানবন্দর টু গাজীপুর চৌরাস্তা মহাসড়কটির জন্য যুতসই উদাহরণ। বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) একাংশ চালু হওয়ায় উপরে ধকধকে তকতকে; অথচ নিচে খানাখন্দ, ভাঙাচোরা, নির্মাণসমগ্রীর স্তূপ, উঁচু-নিচু বেহাল দশা। রাজধানীতে প্রবেশমুখ এবং অত্যন্ত ব্যস্ত সড়কটি চলাচলকারী মানুষের জন্য নিদারুণ দুর্ভোগে পরিণত হয়েছে। ব্যস্ত সড়কটির উপর দিয়ে বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের কাজ কচ্ছপ গতিতে হচ্ছে। মানুষের দুর্ভোগ কমাতে নির্মাণকাজ অসমাপ্ত রেখেই ৬ নভেম্বর একাংশ খুলে দেয়া হয়েছে। আহা কি চমৎকার!
গুরুত্বপূর্ণ উপরে চমৎকার হলেও বিআরটির ফ্লাইওভারের নিচের সড়কের বেহাল দশা। বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা পর্যন্ত মূল সড়ক যেন বিধ্বস্ত কোনো গিরিখাদ। যত্রতত্র খানাখন্দ, রাস্তার মাঝখানে নির্মাণ সমগ্রীর স্তূপ, খানাখন্দে পানি জমানো, উঁচুনিচু সড়কে যানবাহন চলাচলে প্রতিদিন দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে। আগামী বছরের জুন মাসে উদ্বোধনের টার্গেট করে বিআরটি প্রকল্পের বাকি অংশের কাজ এগিয়ে চলছে। কিন্তু সড়কের নিচের অংশ দেখভালের যেন কেউ নেই। প্রতিদিন হাজার হাজার যানবাহন চলাচল করা এ সড়কে প্রতিদিন ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে পড়তে হচ্ছে। প্রকল্পের নিচের সড়ক চলাচল উপযোগী করা হচ্ছে না। বাধ্য হয়ে যাদের ওই সড়কটি ব্যবহার করতে হয় তারা ভোগান্তির ঝুঁকি বুঝেই রাস্তায় নামেন। রংপুর, রাজশাহী ও ময়মনসিংহ বিভাগের জেলা গুলোর মানুষ এ পথেই যাতায়াত করেন। এমনকি ঢাকার মিরপুর, উত্তরা এলাকার মানুষ এ পথ ব্যবহার করে থাকেন। ভুক্তভোগীরা বলছেন, দায়িত্বশীলরা বিআরটি প্রকল্পের উদ্বোধনের তোড়জোর করছেন; অথচ নিচের সড়কের সংস্কার, মেরামত করছেন না।
দুর্ভোগের বিআরটি প্রকল্প আগামী বছরের জুন মাসে চালু করার পরিকল্পনা করা হয়েছে। কিন্তু অপরিকল্পিত নির্মাণ কাজ ও অব্যবস্থাপনার কারণে সঠিক সময়ে প্রকল্পটি পুরোপুরি চালু করা নিয়েও রয়েছে নানা সংশয়। বছরের পর বছর মানুষকে ভোগান্তি পোহাতে হয়েছে। এ অবর্ণনীয় ভোগান্তির কারণে এই প্রকল্পটিকে সাধারণ মানুষ মহাদুর্ভোগের প্রকল্প হিসেবে নামকরণ করেছে।
প্রতিদিন এই সড়কে (বিআরটি প্রকল্পের নিচ) হাজার হাজার যানবাহন চলাচল করে। অসংখ্য স্কুল, কলেজ, মাদরাসায় লাখো শিক্ষার্থী চলাচল করেন। অরক্ষিত এই প্রকল্পে গার্ডার পড়ে ভয়াবহ দুর্ঘটনায় ৫ জন নিহতের ঘটনায় উত্তরা এলাকার বসবাসকারীদের মধ্যে আতঙ্ক-উদ্বেগের সৃষ্টি হয়েছে। সরেজমিন প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা যায়, এখনো বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর চৌরাস্তা এলাকা পর্যন্ত নির্মাণসামগ্রী রাখা হয়েছে রাস্তার মাঝে। রাস্তার মাঝখানে আগের মতোই একের পর এক রাখা রয়েছে বিআরটি প্রকল্পের গার্ডার। খোলা অবস্থায় বালুর স্তুপ রাস্তার মাঝেই রাখা হয়েছে। ব্যস্ত রাস্তায় গাড়ি চলাচলের সময় এই বালি ছড়িয়ে ছিটিয়ে যায়। কোনো কোনো স্থানে রাস্তার পাশে বিশাল প্রকল্পের গর্ত। এসব গর্তে পানি জমে যায়। এতে যানজট বাড়ে, ভোগান্তি বাড়ে সাধারণ মানুষের। মূল সড়কের উপরে রাখা হয়েছে নির্মাণসামগ্রী। দেখার যেন কেউ নেই। এতে প্রতিনিয়ত বিপাকে পড়তে হচ্ছে যাত্রীদের। রোগী পারাপারে অ্যাম্বুলেন্সও আটকে থাকতে হচ্ছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। বিআরটি প্রকল্পের কাজ শুরু হওয়ার পর ব্যস্ততম এই সড়কটি সরু হয়ে যায়। এতে প্রশস্ততা কোথাও কোথাও হয়ে গেছে অর্ধেক। সড়কের মাঝ বরাবর বিআরটি প্রকল্পের পিলার বসানো হয়েছে। সড়কের পাশে ও উপরে পড়ে আছে বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রী। কোথাও কোথাও দীর্ঘদিন কাজ না হলেও তা সংস্কার করা হচ্ছে না।
বিমানবন্দর থেকে গাজীপুর পর্যন্ত যেন ধ্বংসস্তূপ। যুদ্ধে বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ এসে লন্ডভন্ড করে দিয়েছে সবকিছু। উত্তরাকে ধরা হয় অভিজাত এলাকা হিসেবে। সেই উত্তরা যাতায়াতে রাস্তার মাঝখানে রাখা হয়েছে বালুর স্তূপ; যা মাসের পর মাস পড়ে রয়েছে। টঙ্গী এলাকায় ফ্লাইওভারের নিচের পুরো সড়কজুড়ে খানাখন্দ। রাস্তার দুই পাশে নেই কোনো মানুষের হাঁটার রাস্তা। দীর্ঘদিন নির্মাণকাজ চলার কারণে ভাঙা আর গর্তের রাস্তা দিয়েই চলতে হয় লোকজনকে। বিমানবন্দর-গাজীপুর সড়কের জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় রাস্তার মাঝেই নির্মাণসামগ্রী রাখা হয়েছে ছড়িয়ে ছিটিয়ে। এই সড়কের বাইপাস এলাকায় পিলার বসানো হলেও বিশাল আকারের গার্ডারগুলো রাখা হয়েছে রাস্তার মাঝখানেই। গাজীপুর চৌরাস্তা এলাকায় নির্মাণকাজ চলছে। পিলারের উপর গার্ডার বসানো হয়েছে তবে নিচের রাস্তায় অব্যবস্থাপনার কারণে সরু হয়ে গেছে। নোংরা-আবর্জনার কারণে সাধারণ মানুষের চলাচলে সৃষ্টি হচ্ছে দুর্ভোগ। গাজীপুর চৌরাস্তা থেকে ময়মনসিংহ সড়কের মাঝখানে রাখা হয়েছে নির্মাণসামগ্রী। নির্মাণকাজ চলমান থাকার কারণে জয়দেবপুর সড়কের অবস্থা সবচেয়ে বেশি খারাপ। এই সড়কে খানাখন্দক ও ভাঙ্গার কারণে লোকজনকে চলতে হচ্ছে কষ্ট করে।
দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সড়ক বিমানবন্দর-টঙ্গী-গাজীপুর চৌরাস্তা। র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের কাজের জন্য দীর্ঘদিন থেকে প্রতিদিন এই গুরুত্বপূর্ণ ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ভোগান্তিতে পড়ছে লাখো মানুষ। ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে থাকছে যানবাহন। এজন্য উন্নয়ন কাজ নিয়ে শুরু হয় বিতর্ক। মানুষের এই চরম দুর্ভোগের মধ্যেই নির্মাণকাজ অসমাপ্ত রেখেই কাল ৬ নভেম্বর খুলেছে বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের একাংশ। উত্তরা থেকে টঙ্গী রেলগেট ফ্লাইওভার এবং মাঝের টঙ্গী সেতুর একাংশ যানবাহন চলাচলে খুলে দেয়া হয়। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের প্রকল্প পরিদর্শনের পর যান চলাচল শুরু হয়।
বিআরটি প্রকল্পটি ২০১২ সালে সরকারের অনুমোদন পায়। নির্মাণ কাজ শুরু হয় ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে। গত আগস্ট পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ এগিয়েছে ৮১ দশমিক ৬৫ শতাংশ। নির্মাণ কাজের কারণে চার বছর চরম দুর্ভোগ চলছে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের উত্তরা থেকে জয়দেবপুর অংশে। এই পরিস্থিতিতে কাজ বাকি রেখেই উত্তরা থেকে টঙ্গী পর্যন্ত ফ্লাইওভারের একাংশ যানবাহন চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয়। সড়কে বিশাল খানাখন্দ ও পানিবদ্ধতায় টানা কয়েকদিন দীর্ঘ যানজট হয় উত্তরা থেকে জয়দেবপুর চৌরাস্তা সড়কে।
চীনের তিনটি এবং বাংলাদেশের একটি কোম্পানি এই প্রকল্পের ঠিকাদার হিসেবে কাজ করছে। এর মধ্যে উড়াল সড়ক ও নিচের সড়ক নির্মাণের কাজ পেয়েছে চায়না গ্যাঝুবা গ্রুপ করপোরেশন (সিজিজিসি), জিয়াংশু প্রভিনশিয়াল ট্রান্সপোর্টেশন ইঞ্জিনিয়ারিং গ্রুপ এবং ওয়েহেই ইন্টারন্যাশনাল ইকোনমিক অ্যান্ড টেকনিক্যাল কো-অপারেটিভ। আর গাজীপুরে বিআরটির ডিপো নির্মাণের দায়িত্বে রয়েছে দেশীয় কোম্পানি সেল-ইউডিসি।
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের ঢাকামুখী যানবাহনের চাপ কমবে বলে আশা কর্তৃপক্ষের। তবে পুলিশ ও সড়ক ব্যবহারকারীরা বলছেন, নিরাপত্তা ঝুঁকি ও কারিগরী সমস্যা রেখে দুটি লেন খুলে দেয়া হলে পুরোপুরি যানজট নিরসন হবে না। পুরো বিআরটি প্রকল্পের কাজ শেষ না হলে ভোগান্তি থাকছেই।
সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের দাবি, গাজীপুরে মহাসড়কে দুর্ভোগ কমাতে রাজধানীমুখী ফ্লাইওভারের ২ দশমিক ২ কিলোমিটার দুটি লেন খুলে দেয়া হলো। আগামী বছরের জুনের মধ্যে বিআরটির প্রকল্প সম্পূর্ণ খুলে দেয়া সম্ভব হবে। ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে যানজটের ভোগান্তি কমাতে আপাতত আংশিক খুলে দেয়া হয়।
উত্তরা, টঙ্গীর স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, ফ্লাইওভারের উপরের দুই লেন উন্মুক্ত করা হলেও সাধারণ গণপরিবহন বা যাত্রীবাহী বাস যদি ব্যবহার না করে তাহলে কাক্সিক্ষত উপকার পাওয়া যাবে না। নিচের অংশে খানাখন্দ থাকলেও অধিক যাত্রী পাওয়ার আশায় ফ্লাইওভাব ব্যবহার করছে না। আর ফ্লাইওভার ব্যবহার না করলে গাড়ির চাপ ও যানজটের ঘটনা ঘটবেই। প্রকল্পের অব্যবস্থাপনায় গ্রীষ্মকালে ধুলায় অন্ধকার থাকে পুরো এলাকা। বর্ষায় কাদা, পানি ও খানাখন্দে ভরা পুরো সড়ক। এখনও সেই অবস্থা বিরাজমান। এ অবস্থা চলছে বছরের পর বছর ধরে। এতে করে টঙ্গী থেকে গাজীপুর পর্যন্ত সড়কের দুপাশের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো লোকসান গুনতে গুনতে ধ্বংসের পথে। অনেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছেন।
টঙ্গীর বাসিন্দা আমিনুল ইনকিলাবকে বলেন, বিআরটি প্রকল্পের কাজ চলমান থাকায় প্রতিদিন এই সড়কে যানজট হয়। যানজটের কারণে এই সড়ক কেউ ব্যবহার করতে চান না। এখন কয়েকদিন শুষ্ক থাকার কারণে রাস্তায় প্রচুর পরিমাণে বেড়েছে ধুলা। ধুলার কারণে টঙ্গী স্টেশন রোড এলাকায় লোকজন চলাচল করতে পারছে না। বিআরটি কর্তৃপক্ষের এ ব্যপারে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।
উত্তরা এলাকার বাসিন্দা জাকির হোসেন বলেন, এই প্রকল্পটি আমাদের এলাকার জন্য যেন অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বছরের পর বছর চলাচলে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। এখন আবার প্রকল্পের লোকজনের অব্যবস্থাপনার কারণে মানুষকে মরতে হয়। আমরা এখন মনে হয় নিরাপত্তাহীনতায় আছি।
বাস চালকরা জানান, সারাদিনে একটি বাস দুটির বেশি ট্রিপ দিতে পারে না। যানজটে আটকে থাকতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। যাত্রীরা ধুলায় অতিষ্ঠ।
ঢাকা বাস র্যাপিড ট্রানজিট কোম্পানি লিমিডেট (বিআরটি) প্রকল্পের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সফিকুল ইসলাম দাবি করে বলেন, ৬ নভেম্বর বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পের উত্তরা থেকে টঙ্গী রেলগেট ফ্লাইওভার এবং মাঝে টঙ্গী সেতুর একাংশ টঙ্গী আব্দুল্লাহপুর অংশের যানজট কমে এসেছে। এখন দুর্ভোগ অনেকটা সমাধান হবে।
সেভ দ্য রোড-এর মহাসচিব শান্তা ফারজানা ইনকিলাবকে বলেন, সংশোধনীর মাধ্যমে প্রাক্কলিত ব্যয় বাড়িয়ে নির্ধারিত সময়েও বিআরটির কাজ শেষ করা যায়নি। কারণ ঠিকাদারদের গ্রহণযোগ্য কর্মপরিকল্পনা তৈরির মতো দক্ষ জনবল, সরঞ্জাম, অর্থ, প্রয়োজনীয় উপকরণ কিছুই নেই। এ কারণে মিল ছিলো না তাদের কর্মপরিকল্পনার সঙ্গে বাস্তবেরও। তিনি বলেন, গত ১০ বছর ৪ দশমিক ৫ কিলোমিটার এলাকায় জমেছে ইকুইপমেন্ট জঞ্জাল। এই জঞ্জাল অপরিকল্পিত অব্যবস্থাপনার মধ্যে ১০ বছর সাধারণ মানুষকে যেমন কষ্ট দিয়েছে, তেমন কেড়েঁ নিয়েছে সময় এবং অর্থ।
জানতে চাইলে বুয়েটের অধ্যাপক ড. শামসুল হক ইনকিলাবকে বলেন, রাজধানীর একটি চলাচলরত রাস্তায় এভাবে এতো বড় প্রকল্পের কাজ হচ্ছে কোনো প্রকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়া। এখন আমাদের উন্নয়ন যন্ত্রণা পোহাতে হচ্ছে। প্রকল্পের নিরাপত্তা ব্যবস্থা দুর্বল বলেই দুর্ঘটনা ঘটছে। তাছাড়া প্রকল্পের নিচের রাস্তা মেরামত না করায় মানুষকে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন