স্বাধীনতার ৫১ বছরের ইতিহাসে চলতি অর্থবছরে ২০২২-২৩ প্রথমবারের মতো ‘অফশোর ট্যাক্স অ্যামনেস্টি’ সুবিধার আওতায় পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার সুযোগ দিয়েছে সরকার। এরফলে অপ্রদর্শিত টাকা ও বিদেশে পাচারকৃত সম্পদের সন্ধানে আঁটসাঁট বেধে নেমেছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। সংস্থাটি চলতি অর্থবছরে এ খাত থেকে ২৫ হাজার কোটি টাকা অর্থনীতির মূলধারায় যুক্ত হবে বলে আশা করছে। তবে চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) কোন টাকা আদায় হয়নি। এনবিআর সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। যদিও এনবিআর সূত্র বলছে, সাধারণত ক্যালেন্ডার বছরের শেষ দিকে এবং অর্থবছরের শেষ দিকে এসব টাকা আসে এবং এবারও তার ব্যতিক্রম হবে না।
এনবিআর সূত্র জানিয়েছে, এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), বাংলাদেশ ফিনান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্ট ইউনিট (বিএফআইইউ), এনবিআরের আয়কর গোয়েন্দা বিভাগ সেন্ট্রাল ইন্টিলিজেন্ট সেল (সিআইসি) কাজ করছে। এছাড়া কর অঞ্চল ২ থেকেও কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। এরই মধ্যে সম্মিলিতভাবে কাজ শুরু করেছে।
অর্থপাচারের দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারতের পরই বাংলাদেশের অবস্থান। গত বছর ৭৮০ কোটি ডলার পাচার হয়েছে, যে টাকা দিয়ে দুটি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা যেতো। এমনকি সম্প্রতি বাংলাদেশের একজন শীর্ষ ব্যবসায়ী সিঙ্গাপুরের ৪২তম ধনী বলে জানিয়েছে ফোর্বস। এ ধরণের ধনাঢ্য ব্যক্তি আরো অনেকের সম্পদ বিদেশে রয়েছে বলে তথ্য রয়েছে।
চলতি বছরের ১৬ জুন সুইস ন্যাশনাল ব্যাংক যে প্রতিবেদন প্রকাশ করে তাতে দেখা যায়, বাংলাদেশিদের টাকার পাহাড় জমেছে। ২০২১ সালে এ অর্থের পরিমাণ ছিল ৮৭ কোটি ১১ লাখ ফ্রাঙ্ক। স্থানীয় মুদ্রায় যা ৮ হাজার ২৭৫ কোটি টাকা। আগের বছরের চেয়ে এ আমানত প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। আর ২০২০ সালে ব্যাংকটি বাংলাদেশিদের জমা করা অর্থের পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ৩৪৩ কোটি টাকা।
এনবিআর আশা করছে, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে অন্তত ২৫ হাজার কোটি টাকা অর্থনীতির মূল স্রোতে যুক্ত হবে। এতে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় হতে পারে। ‘অফশোর ট্যাক্স অ্যামনেস্টি’ নামে এই কার্যক্রম ৩০ জুন ২০২৩ সাল পর্যন্ত চলবে।
ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক সকল বাণিজ্যিক ব্যাংকের শাখায় অর্থ ফেরত আনার বিষয়টি প্রচার করার নির্দেশ দিয়েছে। বিদেশে অর্জিত অর্থ সহজে দেশে আনতে ‘অফশোর ট্যাক্স অ্যামনেস্টি’ কার্যক্রম নিয়ে ব্যাংকগুলোর শাখা পর্যায়ে বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রদর্শন ও প্রচার করার নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত ৮ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রা ও নীতি বিভাগ এ সংক্রান্ত একটি নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
কোনো করদাতা বাংলাদেশের বাইরে কোনো সম্পদের মালিক হলে এবং সেই সম্পদ আয়কর বিবরণীতে প্রদর্শিত না হলে আগামী অর্থবছরে কর দেওয়ার মাধ্যমে তা প্রদর্শনের সুযোগ পাবেন।
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটে বাংলাদেশের বাইরে নগদ অর্থ, ব্যাংক জমা, সিকিউরিটিজ এবং ফাইনান্সিয়াল ইন্সট্রুমেন্টসহ সব অস্থাবর সম্পদ দেশে ফেরত আনা হলে তার জন্য ৭ শতাংশ হারে কর দেয়ার সুযোগ রাখা হয়। আর বিদেশের কোনো স্থাবর সম্পত্তি দেশে ফিরিয়ে না আনলে ওই সম্পত্তির মোট মূল্যের ওপর ১৫ শতাংশ এবং বিদেশে থাকা অস্থাবর সম্পত্তি দেশে আনলে তার ওপর ১০ শতাংশ হারে কর দিতে হবে। এক বছরের জন্য এই সুযোগ দেয়া হয়।
এদিকে বিগত ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে প্রায় এক হাজার ৬৬৩ কোটি কালো টাকা বৈধ হয়েছে। এর মাধ্যমে ১১৬ কোটি ২৭ লাখ টাকা কর অর্জন করেছে এনবিআর। অথচ ২০২০-২১ অর্থবছরে রেকর্ড প্রায় ২০ হাজার ৬৫০ কোটি অপ্রদর্শিত অর্থ বা কালো টাকা বৈধ বা সাদা করা হয়েছিল। এর মাধ্যমে ২ হাজার ৬৪ কোটি টাকার রাজস্ব সংগ্রহ করে এনবিআর। যদিও অর্থনীতিবিদেরা মনে করেন, করোনা মহামারির কারণে বিদেশে টাকা পাচারের সুযোগ সীমিত হয়ে পড়ায় ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে এতো বেশি কালো টাকা সাদা হয়েছে। এর আগে ২০০৭ ও ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে দুই বছরে ৯ হাজার ৬৮২ কোটি ৯৯ লাখ টাকা সাদা করা হয়েছিল এবং করদাতার সংখ্যা ছিল ৩২ হাজার ৫৫৮ জন।
চলতি অর্থবছরে বিদেশ থেকে পাচারকৃত অর্থ আনার সুযোগ দেয়ায় এবছরও রেকর্ড অর্থ বৈধ হবে বলে আশা করছে এনবিআর। এখনো অর্থ ফেরত আনা শুরু হয়নি। সাধারণত ক্যালেন্ডার বছরের শেষ দিকে এবং অর্থবছরের শেষ দিকে এসব টাকা আসে। এবারও এর ব্যতিক্রম হবে না বলে মনে করছে এনবিআর। সবাই হয়তো একবারে টাকা আনবে না। পর্যায়ক্রমে আসবে।
তবে অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বিভিন্নভাবে বারবার বাংলাদেশে কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়ায় উদ্যোগটি সফল হচ্ছে না। দেশে ঘোষণা দিয়ে প্রথম কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল ১৯৭৫ সালে, সামরিক আইনের আওতায়। এরপর এ পর্যন্ত ১৭ বার কালো টাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হয়েছে। এবছর যেটি করা হয়েছে সেটি আরো খারাপ। যারা দেশের টাকা পাচার করেছে তাদেরকে সুযোগ দেয়া আরো অনৈতিক।
যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকার যদি কঠোর অবস্থান নেয়, তাহলে পাচার রোধ করতে পারে। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনা সম্ভব নয় বলে মনে করেন তারা। আর ফেরত আসলেও তার পরিমান হবে খুবই কম। যা কোন উল্লেখযোগ্য অবদান রাখবে না। এতে শুধুমাত্র দুর্নীতিকেই উৎসাহিত করা হয়েছে বলে মত তাদের।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান ড. এম মাসরুর রিয়াজ বলেন, আসলে পাচার হওয়া টাকা ফেরত আসারও কথা না। যে লোক টাকা ঐ দেশে নিয়ে গেছে, সে কি টাকা আর বাংলাদেশে আনবে? কারন সেসব দেশে মুদ্রার মান বৈশ্বিক মানদণ্ডে শক্তিশালী। সেসব জায়গায় হয়তো জীবনযাত্রার মান উন্নত। বিশেষ করে এখন টাকার মান পড়তির দিকে, আরো পড়তে পারে। সুতরাং কেউই সে পাচার করা টাকা যেটা ডলারে বা অন্য কারেন্সিতে আছে, এ সময়ে কেউই টাকাটা বাংলাদেশে আনতে চাবে না। কারন তার পরবর্তীতে ক্ষতি হতে পারে টাকার অবমূল্যায়ণের মাধ্যমে। সর্বসাকূল্যে বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য খুব একটা সহায়ক হবে না।
এই অর্থনীতিবিদ বলেন, এই সুবিধাটা দেয়া ঠিক হয়নি। পাচার হওয়া টাকা ফেরত আনার সুযোগ দেয়াটা অবৈধতো বটেই সেই সঙ্গে অনৈতিক। এতে পরবর্তীতে টাকা পাচার বা দুর্নীতিকে উৎসাহিত করে। বৈশ্বিক মানদণ্ডে এবং দেশের ভেতরেও আসলে এটা নেতিবাচক ধারণা তৈরি করে। এই সুবিধা বাতিল করে নেয়াই ভালো হবে বলে মনে করেন তিনি।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহ উদ্দীন আহমেদ বলেন, এগুলো কোন কাজ হয়না। যারা একবার নিয়ে গেছে তারা কিন্তু এগুলোতে আসবেনা আর। পাঠালে হয়তো পাঠাবে অল্প। কারন এসময়টাতে কেন পাঠাবে? এখন কি বাংলাদেশে টাকা ফেরত পাঠানোর কোন অবস্থা আছে? বাইরে থাকাইতো বেটার। ডলারতো অনেক বেশি শক্তিশালী। হতে পারে টাকার মান আর কমবে না, কিন্তু টাকার মান যদি পরে আরো কমতির দিকে যায়, তখনতো টাকা সাদা কাগজের মতো হবে। টাকার পারচেজিং পাওয়ারতো কমে যাবে। আর অফশোর হিসেবে যদি ফেরত না দেয়, কি কোন অ্যাকশন নেবে? ইতিপূর্বে এমন কোন শাস্তি হয়নি কারো। যারা এগুলো পাঠাবে ব্যাংক এগুলো রেকর্ড রাখবে, ওরাতো রেকর্ডেড গতে চায় না। এসব কারনে আসলে খুব কঠিন। অতএব এটা হয় না। সাধারনত খুবই রেয়ার।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন