শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জাতীয় সংবাদ

উন্নয়নের নামে জাবিতে হাজারো গাছ কর্তন

ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা

জাবি প্রতিনিধি | প্রকাশের সময় : ১৬ নভেম্বর, ২০২২, ১২:০০ এএম

থেমে থেমে হাজারো গাছ কেটে চলছে উন্নয়নের কর্মকাণ্ড। বিনষ্ট হচ্ছে পরিবেশ, বার বার ক্ষুব্ধ হচ্ছে ছাত্ররা। এভাবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের শুরু থেকেই চলছে প্রশাসন-শিক্ষার্থী দ্বন্দ্ব।

জানা যায়, ২০১৮ সালে প্রকল্প শুরু হওয়ার পর এখন পর্যন্ত প্রায় এক হাজার গাছ কাটা হয়েছে। শেষ করতে আরও দুই শতাধিক গাছ কাটা পড়বে। ফলে কাজের শুরু থেকেই গাছ কেটে পরিবেশ বিনষ্টের প্রতিবাদে আন্দোলন করে আসছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা বলছেন, কোনরকম পরিকল্পনা ও বাছবিচার ছাড়াই একের পর এক গাছ কাটা হচ্ছে। আর প্রশাসন থেকে বলা হচ্ছে, উন্নয়নকাজ করতে হলে গাছ কাটার বিকল্প নেই। এদিকে পরিবেশবিদদের আশঙ্কা, অপরিকল্পিতভাবে গাছ কাটার কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃতি ও পরিবেশ হুমকির মুখে পড়ছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার ভবন সূত্র জানায়, ২০১৮ সালের ২৩ অক্টোবর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়নের জন্য ১ হাজার ৪৪৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকার প্রকল্প অনুমোদন দেয় জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)। পরের বছর প্রকল্পের প্রথম ধাপে ছেলেদের তিনটি ও মেয়েদের তিনটি হল নির্মাণের কাজ শুরু হয়। প্রকল্পের নকশা অনুসারে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের তিনদিকে তিনটি হল নির্মাণের পরিকল্পনা করে প্রশাসন। সেখানে সাতশতাধিক গাছ থাকায় তখন এই পরিকল্পনার বিরোধীতা করেছিল শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একটি অংশ। এরপরেও ২০১৯ সালের ২৩ আগস্ট সকালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হল সংলগ্ন ওই এলাকার অর্ধশতাধিক গাছ কেটে ফেলা হয়। পরে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা সেখানে গিয়ে বাঁধা দিলে গাছ কাটা বন্ধ হয়। এরপর বাধ্য হয়ে স্থান পরিবর্তন করে শহীদ রফিক-জব্বার হলের তিনদিকে ছেলেদের তিনটি হল নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সেসব হলের নির্মাণকাজ প্রায় শেষ। আর মেয়েদের তিনটি হল নির্মাণের নির্ধারিত স্থানে ১৭৮টি কাঁঠাল গাছসহ বিভিন্ন প্রজাতির ২০৭টি গাছ ছিল। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্রতিবাদ সত্ত্বেও সেগুলো কেটে সেখানে হল নির্মাণ করা হয়েছে।

উন্নয়ন প্রকল্প কার্যালয় সূত্র জানান, চলতি বছরের ৮ জুন উন্নয়ন প্রকল্পের দ্বিতীয় ধাপে ১৪টি স্থাপনার নির্মাণকাজের উদ্বোধন করা হয়। এরপর সমাজবিজ্ঞান অনুষদ ভবনের পেছনে ওই অনুষদের আনুভূমিক সম্প্রসারণের জন্য ২০০টি গাছ কেটে ফেলা হয়। স্পোর্টস কমপ্লেক্স নির্মাণের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠের দক্ষিণে শতাধিক গাছ কাটা হয়। বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবের পশ্চিম দিকে অতিথি ভবন নির্মাণের জন্য আরও শতাধিক গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। সর্বশেষ গত শুক্রবার (৪ নভেম্বর) বিশ্ববিদ্যালয়ের টারজান পয়েন্ট এলাকায় ছাত্রীদের খেলার মাঠ নির্মাণের জন্য প্রায় দেড়শ’ গাছ কাটা হয়েছে।

এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জয় বাংলা ফটক সংলগ্ন আবাসিক এলাকায় হলের আবাসিক শিক্ষক, প্রাধ্যক্ষ ও কর্মকর্তাদের জন্য আলাদা তিনটি ১০ তলা ভবন নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। এখানে বিভিন্ন প্রজাতির ৫০ টি গাছ কাটা হয়েছে। সবমিলিয়ে শুধু উন্নয়ন প্রকল্পের জন্যই প্রায় এক হাজার গাছ কাটা হয়েছে। এর আগে ২০১৭ সালে ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ) ও ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন টেকনোলজির (আইআইটি) ভবন নির্মাণের জন্য ৩৫-৪০টি গাছ কেটে ফেলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। পরে আইবিএ’র ভবন নির্মাণের স্থান পরিবর্তন করা হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্প কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এগুলো ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়ের জীববিজ্ঞান অনুষদের আনুভূমিক সম্প্রসারণের জন্য ওয়াজেদ মিয়া বিজ্ঞান অনুষদের উল্টোদিকের স্থান নির্বাচন করা হয়েছে। সেখানে শতাধিক গাছ আছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ও মানবিকী অনুষদের আনুভূমিক সম্প্রসারণের জন্য নতুন প্রশাসনিক ভবন ও আ ফ ম কামালউদ্দিন হলের মাঝখানে যে জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছে সেখানেও শতাধিক গাছ আছে। উন্নয়ন প্রকল্পের বাকি কাজ সম্পন্ন করতে আরও কয়েকশ’ গাছ কাটা পড়বে।

প্রকল্পের শুরু থেকে গাছ কেটে ভবন নির্মাণ বন্ধ এবং চলমান উন্নয়ন প্রকল্পের মহাপরিকল্পনা পুননির্ধারণের দাবিতে আন্দোলন করে আসছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্লাটফর্ম ‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে জাহাঙ্গীরনগর’। প্ল্যাটফর্মটির সমন্বয়ক দর্শন বিভাগের অধ্যাপক রায়হান রাইন বলেন, ‘এখানে অপরিকল্পিতভাবে কাজ চলছে। যেকারণে নির্বিচারে হাজার হাজার গাছ কাটা হয়েছে। অথচ, এনিয়ে কারো ভ্রুক্ষেপ নেই।’

এভাবে ‘অপরিকল্পিত’ গাছ কাটার ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ-প্রকৃতির ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ছে বলে মনে করছেন পরিবেশবিজ্ঞানীরা। তারা বলছেন, ক্যাম্পাসে নানা প্রজাতির প্রাণী ও পাখির বিচরণ রয়েছেন। গুঁইসাপ, বেজি, শেয়াল, কাঁঠবিড়ালি ও অতিথি পাখিদের কথা বিবেচনায় না নিয়েই এই গাছ কাটা হচ্ছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকৃতি ও পরিবেশ হুমকির মুখে পড়বে।

এ ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি প্রফেসর জামাল উদ্দিন রুনু বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের একটি অংশের মনমতো এখানে কোন অপরিকল্পিতভাবে পরিবেশ ধ্বংস করে ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে করে প্রাণ-প্রকৃতির তথা জীববৈচিত্রের ক্ষতি হচ্ছে। বিশ^বিদ্যালয়ের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সামনে আরও বিনষ্ট হবে। একই সঙ্গে প্রকল্পের মাধ্যমে অর্থের অপচয় হচ্ছে। এসবের দায় নিয়ে তদন্ত হওয়া উচিত।
প্রকল্পের পরিচালক প্রকৌশলী মো. নাসির উদ্দিন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় তো কোন বনভূমি নয়। প্রথমদিকে জায়গা খালি থাকায় সবখানে গাছ লাগানো হয়েছিল। এখন ভবন নির্মাণের জন্য কিছু জায়গার গাছ তো কাটতেই হচ্ছে।
এদিকে গাছ কাটার প্রতিবাদে গত ৮ নভেম্বর নতুন প্রশাসনিক ভবনে অবস্থান কর্মসূচি ও ভিসির সাথে আলোচনায় বসে শিক্ষার্থীদের একাংশ।

এসময় শিক্ষার্থীরা বলেন, মাস্টারপ্ল্যান ছাড়া অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের নামে জনগণের ১৪৪৫ কোটি টাকা খরচের যে উদ্দেশ্য জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন গ্রহণ করেছে, তার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ-প্রকৃতি তথা পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে।

বিশ^বিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর নূরুল আলম বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে চলমান অধিকতর উন্নয়ন প্রকল্পের দ্বিতীয় ধাপে প্রায় সব কাজই চলমান। এক্ষেত্রে কাজ বন্ধ রাখার কোনো সুযোগ নেই। তবে যেসব কাজ এখনো শুরু হয়নি সেগুলোর বিষয়ে আলোচনা হতে পারে। টারজান পয়েন্টে খেলার মাঠ নির্মাণ বন্ধ রেখে সকল অংশীজনের সাথে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। চলমান উন্নয়ন প্রকল্পের তৃতীয় ধাপের কাজ শুরুর আগে প্ল্যান পুণঃবিবেচনা করে কাজ শুরু করা হবে বলেও জানান তিনি।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন