অক্টোবরের ২৯ তারিখ ২০২২। দিনটি ছিল শনিবার। ব্যবসায়ী জাহিদুর রহমানের মোবাইল ফোনে একটি অপরিচিত নম্বর থেকে কল আসে। রিসিভ করতেই একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কল সেন্টার থেকে ফোন করেছে বলে জানিয়ে ক্রেডিট কার্ডের পাসওয়ার্ড আপডেট করার কথা বলা হয়। অপরিচিত ব্যক্তির কথায় ক্রেডিট কার্ডের পেছনে থাকা সিভিডি নম্বরসহ বিভিন্ন তথ্য দেন তিনি। তথ্য দেয়ার পরপরই ২০ হাজার টাকা করে ৪ বার ট্রানজেকশন করে ৮০ হাজার টাকা তার ক্রেডিট কার্ড থেকে তুলে নেয়া হয়।
রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাসিন্দা জাহিদ হোসেন জানান, গত ১০ সেপ্টেম্বর রাতে বিকাশ কাস্টমার কেয়ারের কর্মকর্তা পরিচয়ে তার কাছে ফোন করে কৌশলে ওটিপি পিন নম্বর নিয়ে অ্যাকাউন্ট থেকে ৬১ হাজার ৭০০ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে প্রতারক চক্র। এ ঘটনায় তিনি মোহাম্মদপুর থানায় সাধারণ ডায়েরি করেছেন।
থামছে না ক্রেডিট কার্ড ও ব্যাংক জালিয়াতির ঘটনা। জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতারক চক্র। হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে পুরো ব্যাংকিং খাতে এক ভয়াবহ চক্র গড়ে উঠেছে। তারা গ্রাহকদের ভিসা কার্ড, ডেবিট কার্ড, ক্রেডিট কার্ড বিভিন্ন ভাবে হ্যাক করে হাতিয়ে নিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। রাজধানীসহ সারাদেশে সক্রিয় দেড় শতাধিক ক্রেডিট কার্ড জালিয়াত চক্র অভিনব প্রাতরণায় সাধারণ মানুষের অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে।
সূত্র জানায়, বিভিন্ন ব্যাংকের গ্রাহকদের ক্রেডিট কার্ডের সিস্টেম আপডেটের কথা বলে এবং ওটিপি (ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড) নম্বর নিয়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে ক্রেডিট কার্ড প্রতারকচক্র। বেশ কয়েক মাস ধরে একাধিক ব্যাংকের একাধিক গ্রাহক এই প্রতারকচক্রের খপ্পরে পড়ে খুইয়েছেন মোটা অঙ্কের টাকা। কয়েকজন ভুক্তভোগী থানায় মামলাও করেছেন। জড়িতরা বার বার গ্রেফতারের পর জামিনে বেরিয়ে এসে আবারো একই ধরনের অপরাধে জড়াচ্ছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সিআইডি, র্যাব ও ডিবির কর্মকর্তারা বলছেন, সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের কর্মী সেজে পাসওয়ার্ড চেয়ে প্রতারকচক্র হাতিয়ে নেয় লাখ লাখ টাকা। অভিনব পদ্ধতিতে ক্রেডিট কার্ড থেকে টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতারকচক্র। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কল সেন্টার নম্বর ক্লোন করে প্রতিনিধি সেজে ওটিপি এবং সিভিডি (কার্ড ভ্যালিডেশন ডিজিট) কোড নম্বর চান চক্রের সদস্যরা। এগুলো দিলেই ক্রেডিট কার্ড থেকে খোয়া যায় টাকা। ভুক্তভোগীদের অভিযোগের ভিত্তিতে এমন বেশ কয়েকটি চক্রের সদস্যদের গ্রেফতারে চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডিএমপি অতিরিক্ত কমিশনার (গোয়েন্দা) হারুন অর রশীদ বলেন, ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতির বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। এ বিষয়ে এরই মধ্যে আমাদের টিম কাজ শুরু করেছে। আশা করছি, চক্রের সদস্যদের দ্রুতই আইনের আওতায় আনতে পারব।
জানতে চাইলে ডিবির ডিসি তারেক বিন রশিদ বলেন, ক্রেডিট কার্ড প্রতারণার বিষয়ে বেশ কয়েকটি অভিযোগ আমরা পেয়েছি। এসব প্রতারণায় কে বা কারা জড়িত তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। জড়িতদের দ্রুত সময়ের মধ্যে আইনের আওতায় আনা হবে।
তিনি বলেন, প্রতারক চক্র মোবাইল ব্যাংকিং অফিসের কর্মকর্তার পরিচয় দিয়ে আর্থিক লেনদেনের প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে সাধারণ মানুষের ডেবিট-ক্রেডিট কার্ড থেকে প্রতারণা করে টাকা হাতিয়ে নেয়। এ চক্রের একাধিক সদস্য রয়েছে। চক্রের সব সদস্যের সম্মিলিত প্রয়াসে বিকাশ অথবা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কর্মকর্তা পরিচয়ে প্রতারণার কাজটি করতো। তাদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।
ব্যাংক কর্মকর্তারাই তথ্য দিচ্ছে প্রতারক চক্রকে : তদন্ত সংশ্লিষ্ট সিআইডি, র্যাব ও ডিবির কর্মকর্তারা বলছেন, ক্রেডিট কার্ডের গোপন তথ্য প্রতারক চক্রের কাছে ব্যাংক কর্মকর্তাদের মাধ্যমে চলে যায়। এরপর প্রতারক চক্র ব্যাংকের কাস্টমার কেয়ার নম্বর ক্লোন করে। ওই নম্বর থেকে গ্রাহকের কাছে ফোন দেয়া হয়। গ্রাহককের নাম, কার্ড নম্বর, মেয়াদোত্তীর্ণের নম্বর জানানোর পর সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের কাছে সন্দেহের কোনো অবকাশ থাকে না। এরপর গ্রাহকের কাছে ক্রেডিট কার্ডের পিনকোড চাওয়া হয়। গ্রাহক পিনকোড জানানোর পর কাস্টমার কেয়ার থেকে ধন্যবাদ জানানো হয়। এরপর প্রতারক চক্র বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিংয়ের অ্যাপসে ঢুকে ওই ক্রেডিট কার্ডের তথ্য দিয়ে সব টাকা তার মোবাইল ব্যাংকিং একাউন্টে স্থানান্তর করে নেয়।
গত ১৩ নভেম্বর সিআইডির একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা ইনকিলাবকে বলেন, ক্রেডিট কার্ড জালিয়াত চক্রের সদস্যদের গ্রেফতারের পর জিজ্ঞাসাবাদে কয়েকটি ব্যাংকের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তাদের (ক্রেডিট কার্ড জালিয়াত চক্র) বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করার তথ্য পেয়েছি। এসব তথ্য সরকারের উচ্চ পর্যায়ে অবহিত করা হয়েছে।
কেন জড়িত ব্যাংক কর্মকর্তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে না? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, যারা ব্যাংক কর্মকর্তাদের সম্পর্কে তথ্য দিয়েছেন তারা পেশাদার অপরাধী। গ্রেফতারকৃতদের সাথে চক্রের সদস্যদের যোগাযোগ ছিল। কিন্তু ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতির সাথে জড়িত থাকার তথ্য প্রমাণ এখনও পাওয়া যায়নি। আমরা ওই সব কর্মকর্তাদের নজরদারির মধ্যে রেখেছি। তাছাড়া গ্রেফতারকৃতরা কাউকে ফাঁসাতে মিথ্যা তথ্য দিয়েছে কিনা তাও তদন্ত করা হচ্ছে বলে ওই কর্মকর্তা মন্তব্য করেন।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এটিএম কার্ড স্কিমিং, কার্ড ক্লোনিং ও সর্বশেষ ‘জ্যাকপট’ ম্যালওয়্যার দিয়ে গ্রাহকের অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটেছে। ২০১৪ সালে পোলান্ডের নাগরিক পিউটর কার্ড স্কিমিং ডিভাইস দিয়ে কয়েক কোটি টাকা চুরি করে দেশ থেকে পালিয়ে যায়। ২০১৯ সালে ছয় ইউক্রেনীয় নাগরিক ডাচ-বাংলা ব্যাংকের ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতি করে ৪০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করে। এ ঘটনায় ডিবি পুলিশ তাদেরকে গ্রেফতার করার ছয় মাস পর তারা জামিনে মুক্ত হয়ে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে যায়।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন