জীবনে চলার পথে একজন মুমিনের আদর্শ হবে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। সর্বক্ষেত্রেই তাঁর অনুসরণ-অনুকরণ করে চলবে। তাঁর সুন্নতের পুরোপুরি পাবন্দি করবে। আর এটাই আল্লাহ তাআ’লার নির্দেশ। আল্লাহ তাআ’লা বলেন—তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও আখিরাতের প্রতি বিশ্বাস রাখে এবং আল্লাহকে অধিক স্মরণ করে তাদের জন্য রাসূলের অনুসরণের মধ্যে রয়েছে উত্তম আদর্শ। (সূরা আহযাব-২১) এ আয়াত থেকে একথা প্রমাণিত হয় যে, মুমিনের আদর্শ হবে একমাত্র রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তিনি ব্যতীত অন্য কেউ মুমিনের আদর্শ বা আইডল নন। যেকোনো দৃষ্টিকোণ থেকেই তাঁকে বিবেচনা করা হোক না কেন! তাঁর চেয়ে উত্তম আদর্শ আর কেউ হতে পারে না। যুদ্ধের ময়দানে তিনি সর্বশ্রেষ্ঠ বীর। বাবা হিসেবে তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ বাবা। স্বামী হিসেবে বিবেচনা করলে তিনি সর্বোত্তম স্বামী। শিক্ষক হিসেবে বিবেচনা করলে তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ এবং আদর্শবান শিক্ষক। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবায়ে কেরামগনকে (রা.) দীন শেখানোর ক্ষেত্রে বিভিন্ন হেকমত অবলম্বন করেছেন। শিক্ষা দিয়েছেন অভিনব পদ্ধতিতে। তার কিছু নমুনা নিম্নে পেশ করেছি।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর শিক্ষাদানের পদ্ধতি : হযরত আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আমি তোমাদের জন্য পিতৃতুল্য। তোমাদেরকে আমি দীন শিক্ষা দিয়ে থাকি। তোমাদের কেউ পায়খানায় গেলে কিবলামুখী হয়ে বসবে না এবং কিবলার দিকে পিঠ দিয়েও বসবে না। আর ডান হাত দিয়ে শৌচ করবে না। তিনি ঢিলা ব্যবহারের নির্দেশ দিতেন এবং গোবর ও হাড় দ্বারা শৌচ করতে নিষেধ করতেন। (সূনানে আবু দাউদ, ৮)। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হলেন মুমিনের জন্য পিতৃতুল্য। অর্থাৎ একজন পিতা যেমন তার সন্তানদেরকে বিভিন্ন আদব শিষ্টাচার শিক্ষা দিয়ে থাকেন ঠিক তেমনই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামও আমাদেরকে মাসআলা-মাসায়েল, ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নত, মুস্তাহাব ইত্যাদি বিষয়াবলি শিক্ষা দেন।
অন্য হাদিসে রাসূলের শিক্ষাদানের সুনিপুণ পদ্ধতি ফুটে উঠেছে আরও চমৎকারভাবে। মুআবিয়াহ ইবনুল হাকাম আস-সুলামী (রা.) থেকে বর্নিত, তিনি বলেন—একদা আমি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সাথে সালাত আদায় করি। সালাত অবস্থায় লোকজনের মধ্যকার এক ব্যক্তি হাঁচি দিলে জবাবে আমি ইয়ারহামুকল্লাহ বলায় সকলেই আমার দিকে (রাগের) দৃষ্টিতে তাকালো। তখন আমি মনে মনে বললাম, তোমাদের মাতা তোমাদেরকে হারাক। তোমরা আমার দিকে এভাবে দৃষ্টি নিক্ষেপ করছো কেন? মুআবিয়াহ (রা.) বলেন, সকলেই রানের উপর হাত মেরে শব্দ করতে থাকলে আমি বুঝতে পারি যে, তারা আমাকে চুপ করাতে চাইছে। বর্ণনাকারী উসমানের বর্ণনায় রয়েছে: আমি যখন দেখলাম যে, তারা আমাকে চুুপ করাতে চাচ্ছিল, তখন (অনিচ্ছা সত্বেও) আমি চুপ হলাম। অতঃপর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাত শেষ করলেন।
আমার পিতা-মাতা তাঁর জন্য কুরবান হোক! তিনি আমাকে প্রহার করলেন না, রাগ করলেন না এবং গালিও দিলেন না। তিনি বললেন, সালাতের অবস্থায় তাসবিহ, তাকবির ও কুরআন তেলাওয়াত ব্যতীত কোন কথা বলা মানুষের জন্য বৈধ নয় অথবা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যেরূপ বলার বললেন। এরপর দীর্ঘ হাদিসে উক্ত সাহাবি আরও বিভিন্ন বিষয়ে রাসূলের নিকট প্রশ্ন করলেন। (সুনানে আবু দাউদ-৯৩০)। সুনানে নাসায়ির বর্ণনায় এসেছে, উক্ত সাহাবি (রা.) বলেন, আমি তাঁর পূর্বে বা পরে তাঁর থেকে উত্তম শিক্ষক দেখিনি। এই ঘটনায় রাসূল (সা.) উক্ত সাহাবির উপর রেগে যাননি এবং বকাঝকা করেননি। বরং খুব শান্তভাবে তাকে বুঝিয়ে বললেন যে, এটা তো নামাজ এখানে আল্লাহর জিকির, কুরআন তেলাওয়াত ইত্যাদি ছাড়া অন্য কোনো কথা বলা বৈধ নয়। এ থেকে বোঝা যায় তিনি উম্মতকে শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে কতটা উদার এবং বিনয়ী ছিলেন।
অন্য এক হাদিসে হযরত আবু হুরায়রা থেকে বর্ণিত —এক ব্যক্তি মসজিদে প্রবেশ করল। তখন রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মসজিদের একপার্শ্বে উপবিষ্ট ছিলেন। সে সালাত আদায় করে এসে তাঁকে সালাম দিলো। নবী (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বললেন: ওয়ালাইকুমুসসালাম; তুমি ফিরে যাও এবং সালাত আদায় করো। কারণ তুমি সালাত আদায় করোনি। সে ফিরে গিয়ে সালাত আদায় করে এসে আবার সালাম দিল। তিনি বললেন, ওয়ালাইকুমুসসালাম; তুমি ফিরে যাও এবং সালাত আদায় করো। কারণ তুমি সালাত আদায় করোনি। সে ফিরে গিয়ে সালাত আদায় করে এসে তাঁকে সালাম দিল। তখন সে দ্বিতীয়বার অথবা তার পরের বার বলল: হে আল্লাহর রাসূল! আপনি আমাকে সালাত শিখিয়ে দিন। তিনি বললেন, যখন তুমি সালাতে দাঁড়ানোর ইচ্ছে করবে, তখন প্রথমে তুমি যথানিয়মে অযু করবে। তারপর কিবলামুখী দাঁড়িয়ে তাকবির বলবে। তারপর কুরআন থেকে যে অংশ তোমার পক্ষে সহজ হবে, তা তিলাওয়াত করবে। তারপর তুমি রুকু’ করবে ধীরস্থিরভাবে। তারপর মাথা তুলে ঠিক সোজা হয়ে দাঁড়াবে। তারপর সাজদাহ ধীরস্থিরভাবে। তারপর আবার মাথা তুলে বসবে ধীরস্থিরভাবে। তারপর এভাবেই তোমার সালাতের যাবতীয় কাজ সমাধা করবে।আবু উসমা (রহ.) বলেন, এমনকি শেষে তুমি সোজা হয়ে দন্ডায়মান হবে। (সহিহ বুখারি-৬২৫১)।
উক্ত হাদিসে ওই সাহাবিকে বারবার নামাজের নির্দেশ দেওয়ার কারণ ছিল, তিনি নামাজ পড়েছেন ঠিকই কিন্তু তাড়াহুড়া করেছেন। ধীরস্থিরভাবে রুক-সিজদা আদায় করেননি। অর্থাৎ তা’দিলে আরকান পালন করেননি। এজন্যই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বারবার বলেছেন যে, তুমি ফিরে যাও এবং সালাত আদায় করো। প্রথমেই তিনি ধমক দেননি। পরে দ্বিতীয়বার বা তৃতীয়বার ওই সাহাবি বিনয়ের সাথে বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! আপনি আমাকে নামাজ শিখিয়ে দেন। পরে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে যথারীতি পূর্ণ নামাজ শিখিয়ে দিলেন। এই ছিল রাসূলের শিক্ষাদানের পদ্ধতি।
উপরিউক্ত হাদিসগুলো থেকে একথা প্রমাণিত হয় যে, দীনি তালিম দেওয়া এবং ছাত্রদেরকে শাসন করার ক্ষেত্রে খুব সতর্কতা এবং হেকমত অবলম্বন করতে হবে। তবে সবসময় যে, শুধু হেকমত আর নসিহত করে বোঝাতে হবে বিষয়টা এমন নয়। মাঝে মধ্যে যদি ছাত্র শরিয়ত গর্হিত কোনো কাজে লিপ্ত হয় তাহলে তাকে যথাযথ শাস্তি দিতে হবে। তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই নির্ধারিত সীমারেখা মেনেই শাস্তি দিতে হবে। অন্যথায় আল্লাহ না করুন যদি কোনো শিক্ষক রাগের বশবর্তী হয়ে অপরাধের চেয়ে বেশি শাস্তি দিয়ে থাকেন তাহলে এর জন্য অবশ্যই আল্লাহ তাআ’লার নিকটে জবাবদিহি করতে হবে। আল্লাহ তাআ’লা আমাদেরকে সর্বক্ষেত্রে প্রিয় নবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আদর্শ মেনে চলার তাওফিক দান করুন, আমিন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন