শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

পাপ মোচনে তওবার গুরুত্ব ও ভূমিকা

মেহেদী হাসান বিপ্লব | প্রকাশের সময় : ১৯ নভেম্বর, ২০২২, ১২:০১ এএম

পৃথিবীতে মহান আল্লাহ তা’আলা শুধুমাত্র তার ইবাদত করার জন্য মানবজাতীকে সৃষ্টি করেছেন। তাই আল্লাহ তা’আলা এই মনুষ্য জাতী কিভাবে তার জীবন অতিবাহিত করবে এবং কি করলে দুনিয়া ও আখেরাতে সফলকাম হতে পারবে ইত্যাদি বিষয়ে যাবতীয় নিয়ম কানুন ও বিধিবিধান সম্বলিত সংবিধান অর্থাৎ আল কুরআন অবতীর্ণ করেছেন। আল্লাহ তা’আলা মানবজাতির দৈনন্দিন জীবনের সকল সমস্যার সমাধান, যাবতীয় দিকনির্দেশনা ও বিভিন্ন বিষয়ে আদেশ নিষেধ ইত্যাদি পবিত্র কুরআনুল কারীমের মধ্যে বিস্তারিতভাবে আলোকপাত করেছেন। এরপরও জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষ শয়তানের ধোঁকায় পড়ে আল্লাহর আদেশ- নিষেধ অমান্য করে নানা অন্যায়, অপরাধে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে। এই পাপ বা গুনাহ বড়ও হতে পারে আবার ছোটও হতে পারে । কখনও কখনও মানুষ এতটাই পাপে নিজেকে সম্পৃক্ত করে যে দুনিয়াটা তার জন্য জাহান্নামে পরিণত হয়। পাপী মনে করে তার জীবন অর্থহীন এবং সে ভাবতে থাকে বা চিন্তা করে এত পাপ, এত অন্যায় করার পরও কি মহান আল্লাহ তা’আলা তাকে ক্ষমা করবেন? তার তওবাহ কি আল্লাহ কবুল করবেন? তিনি কি তাকে জাহান্নাম থেকে মুক্তি দিবেন? ইত্যাদি
এসব প্রশ্নের ব্যপারে অর্থাৎ তওবাহর বিষয়ে পবিত্র কুরআন ও হাদিসে অসংখ্য জায়গায় আলোকপাত করা হয়েছে।
যেমন: এবিষয়ে মহান আল্লাহ তা’আলা বলেন : হে মুমিনগণ, তোমরা সকলেই আল্লাহর নিকট তাওবাহ কর, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার (সুরা নূর, আয়াত: ৩১)। তিনি আরও বলেন : তোমরা তোমাদের রবের কাছে ক্ষমা চাও। অতঃপর তার কাছে ফিরে যাও (সুরা হূদ,আয়াত: ৩)। অন্যত্র বলেন : হে ঈমানদারগণ, তোমরা আল্লাহ তা’আলার কাছে তওবাহ কর-আন্তরিক তওবাহ। আশা করা যায়, তোমাদের পালনকর্তা তোমাদের মন্দ কর্মসমূহ মোচন করে দেবেন এবং তোমাদেরকে দাখিল করবেন জান্নাতে, যার তলদেশে নদী প্রবাহিত। সেদিন আল্লাহ নবী এবং তাঁর বিশ্বাসী সহচরদেরকে অপদস্থ করবেন না। তাদের নূর তাদের সামনে ও ডানদিকে ছুটোছুটি করবে। তারা বলবেঃ হে আমাদের পালনকর্তা, আমাদের নূরকে পূর্ণ করে দিন এবং আমাদেরকে ক্ষমা করুন। নিশ্চয় আপনি সবকিছুর উপর সর্ব শক্তিমান (সুরা তাহরীম,আয়াত : ৮)।
হাদিস শরীফে এরশাদ হয়েছে : আবূ হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি, ‘‘আল্লাহর কসম! আমি প্রত্যহ ৭০ বারের অধিক আল্লাহর নিকট ক্ষমাপ্রার্থনা ও তওবাহ করি।’’(সহীহুল বুখারী ৬৩০৭, তিরমিযী ৩২৫৯, ইবনুূু মাজাহ ৩৮১৬, আহমাদ ৭৭৩৪, ৮২৮৮, ৯৫১৫)। আরও এরশাদ হয়েছে : আগার্র ইবনু ইয়াসার মুযানী (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘হে লোক সকল! তোমরা আল্লাহর সমীপে তওবাহ কর ও তাঁর নিকট ক্ষমা চাও! কেননা, আমি প্রতিদিন ১০০ বার করে তওবাহ করে থাকি।’ (মুসলিম ২৭০২, আবূ দাউদ ১৫১৫, আহমাদ ১৭৩৯১, ১৭৮২৭)। অন্যত্র এরশাদ হয়েছে: আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর খাদেম, আবূ হামযাহ আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) থেকে বর্ণিত : তিনি বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহ তা‘আলা স্বীয় বান্দার তওবাহ করার জন্য ঐ ব্যক্তি অপেক্ষা বেশী আনন্দিত হন, যে তার উট জঙ্গলে হারিয়ে ফেলার পর পুনরায় ফিরে পায়।’ (বুখারী ৬৩০৯, মুসলিম ২৭৪৭, আহমাদ ১২৮১৫)।
মুসলিমের অন্য বর্ণনায় এইভাবে এসেছে যে, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দার তওবাহয় যখন সে তওবাহ করে তোমাদের সেই ব্যক্তির চেয়ে বেশী খুশী হন, যে তার বাহনের উপর চড়ে কোনো মরুভূমি বা জনহীন প্রান্তর অতিক্রমকালে বাহনটি তার নিকট থেকে পালিয়ে যায়। আর খাদ্য ও পানীয় সব ওর পিঠের উপর থাকে। অতঃপর বহু খোঁজাখুঁজির পর নিরাশ হয়ে সে একটি গাছের ছায়ায় ঘুমিয়ে পড়ে। ইতোমধ্যে বাহনটি হঠাৎ তার সম্মুখে দাঁড়িয়ে যায়। সে তার লাগাম ধরে খুশীর চোটে বলে ওঠে, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমার দাস, আর আমি তোমার প্রভু!’ সীমাহীন খুশীর কারণে সে ভুল করে ফেলে। (রিয়াদুস সলেহিন, হাদিস নং ১৬)।
হাদীসে এসেছে : আবূ মূসা আশ‘আরী (রা.) থেকে বর্ণিত : নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘নিশ্চয় আল্লাহ তা‘আলা নিজ হাত রাতে প্রসারিত করেন; যেন দিনে পাপকারী (রাতে) তওবাহ করে এবং দিনে তাঁর হাত প্রসারিত করেন; যেন রাতে পাপকারী (দিনে) তওবাহ করে। যে পর্যন্ত পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয় না হবে, সে পর্যন্ত এই রীতি চালু থাকবে।’ ( মুসলিম ২৭৫৯, আহমাদ ১৯০৩৫, ১৯১২২)। হাদীসে আরও বর্ণিত হয়েছে: আবূ হুরাইরাহ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি পশ্চিম দিক থেকে সূর্যোদয় হওয়ার পূর্বে তওবাহ করবে, আল্লাহ তার তওবাহ গ্রহণ করবেন।’ (মুসলিম ২৭০৩, আহমাদ ৭৬৫৪, ৮৮৮৫, ৯২২৫, ১০০৪৭, ১০২০৩ )।
একটা কথা মনে রাখতে হবে, মহান আল্লাহ তা’আলা পরম করুণাময়, অশেষ দয়ালু ও ক্ষমাশীল। তিনি তার সৃষ্টি করা মনুষ্যজাতিকে অত্যন্ত ভালোবাসেন। এজন্য তিনি যেকোনো পরিস্থিতিতে বান্দা তার কৃত অন্যায়, অপরাধ বা পাপ থেকে অনুতপ্ত ও লজ্জিত হয়ে তওবাহর মাধ্যমে তার দিকে ফিরে আসার পথ খোলা রেখেছেন । যা কুরআন ও হাদিস দ্বারা সুস্পষ্টভাবে প্রতিয়মান হয়। সুতরাং কোনো পাপী যদি তওবাহর শর্ত পূরণ করে আল্লাহ তা’আলার নিকট মন থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করে, তবে অবশ্যই আল্লাহ তা’আলা তার তওবাহ কবুল করবেন আশা করা যায়। আর সমস্ত পাপ থেকে তওবাহ করা ওয়াজিব। তওবাহর শর্তসমূহ : যদি গোনাহর সম্পর্ক আল্লাহর সঙ্গে থাকে। যেমন : শিরক, আল্লাহর হুকুম অমান্য করা , আল্লাহর অবাধ্যতা ইত্যাদি। তাহলে এ ধরনের তওবাহ কবুলের জন্য তিনটি শর্ত রয়েছে। (ক) পাপ পুরোপুরি বর্জন করতে হবে (খ) পাপের জন্য অনুতপ্ত ও লজ্জিত হতে হবে (গ) পাপের পুনরাবৃত্তি না করার দৃঢ় সঙ্কল্প করতে হবে। আর যদি সেই পাপ মানুষের অধিকার সম্পর্কিত হয়, তাহলে তা গ্রহণীয় হওয়ার জন্য চারটি শর্ত আছে। উপরোক্ত তিনটি এবং চতুর্থ শর্ত হল, হকদারদের হক ফিরিয়ে দিতে হবে। যেমন: অবৈধ পন্থায় কিছু নিয়ে থাকলে তা ফিরিয়ে দিতে হবে, অপবাদ দিলে বা কোনো দোষ করে থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কাছে শাস্তি নিতে হবে বা তার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে ইত্যাদি। এক কথায় গুনাহটা আল্লাহ তা’আলার সাথে সম্পর্কিত হলে আল্লাহ তা’আলার নিকট তওবাহ করতে হবে এবং মানুষের সাথে সম্পর্কিত হলে আগে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নিকট পরবর্তীতে আল্লাহ তা’আলার নিকট ক্ষমা চেয়ে নিতে হবে।
অতএব, পরিশেষে বলা যায় যে প্রকৃত তওবাহ অবশ্যই পাপ মোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, প্রকৃত তওবাহ জাহান্নাম থেকে জান্নাতের দিকে পরিচালিত করে, প্রকৃত তওবাহ মানুষকে পাপের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে বাধা প্রদান করে, প্রকৃত তওবাহ মানুষকে আল্লাহ তা’আলার নিকটবর্তী হতে সহযোগিতা করে ইত্যাদি। তাই আসুন পাপ থেকে বিরত থাকি, কুরআন- সুন্নাহ অনুযায়ী জীবন গড়ি। ভুলে যদি পাপ করি, তওবাহর মাধ্যমে ফিরে আসি। মহান আল্লাহ তা’আলা আমাদেরকে সকল প্রকার ছোট- বড় পাপ বা গুনাহ থেকে হেফাজত করুন, আমিন।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন