ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ইতিহাসের সবচেয়ে বড় সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে। গতকাল শনিবার বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় খেলার মাঠে ৫৩তম এ সমাবর্তন উপলক্ষে আয়োজন করা হয় জাকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন প্রেসিডেন্ট ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) চ্যান্সেলর আবদুল হামিদ। এসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রাজুয়েট ও গবেষকদের হাতে সনদপত্র তুলে দেন প্রেসিডেন্ট। গ্রাজুয়েট শিক্ষার্থীদের জন্য এদিনটি ছিল মিশ্র অনুভূতির, কারণ এদিন তারা তাদের বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সফল সমাপ্তি উদযাপন করেছিল। এটি ছিল সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা আর উচ্ছ্বাস-উদ্দীপনার দিন। কারণ এদিনে দীর্ঘদিনের সহপাঠী, বন্ধু-বান্ধব আর প্রিয় ক্যাম্পাস, যেটিকে শিক্ষার্থীরা নিজের বাড়ি মনে করতো, তাকে বিদায় জানাতে হয়েছে। তাই তো কালো গাউন আর সমাবর্তনের বিশেষ টুপি পরে ফ্রেমবন্দী করেছিল নিজেদের। বাতাসে টুপি ছুঁড়ে উদযাপন করেছিল জীবনের অন্যতম সুন্দর একটি দিন।
গত তিন-চার দিন ধরেই বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শেষ দিনগুলিকে স্মৃতির ডায়েরিতে আটকে রাখতে নানাভাবে প্রয়াস চালিয়েছে গ্রাজুয়েট শিক্ষার্থীরা। গতকাল সমাবর্তনের দিন ও এর আগের তিনদিন ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্য, শহীদ মিনার, ভিসি চত্বর, অপরাজেয় বাংলা, মধুর ক্যান্টিন, কেন্দ্রীয় গ্রন্থাগার ও ডাকসু ভবনের মতো গুরুত্বপূর্ণ সব জায়গা কালো পোশাকে গ্রাজুয়েটদের পদচারণায় ছিল মুখরিত। ক্যাম্পাস জুড়ে অসম্ভব মুগ্ধতা ছড়িয়ে বিদায় নিয়েছে বিদায়ীরা।
সমাবর্তন মানে একসাথে মিলিত হওয়া। সমাবর্তন মানে আনন্দ-উল্লাস আর বিদায়ের বেদনা। সমাবর্তন মানে শিক্ষাজীবনের অর্জনের স্বীকৃতি। সমাবর্তনের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা জীবন শেষে মূল সনদপত্র দেয়া হয়। তারজন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ ফি দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে হয় গ্রাজুয়েটদের। যে কারণে অনেক শিক্ষার্থীই অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণে সমাবর্তনে অংশ নেয় না। কিন্তু থেমে থাকে না হৈ-হুল্লোড় আর উল্লাস। আনন্দের বাঁধভাঙা জোয়ারে ভেসে বেড়ান সকলে। জুলকার নাইন নামের এক গ্রাজুয়েট বলেন, সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা আর রাজপথের এই ক্যাম্পাস ছেড়ে যেতে হচ্ছে আজ। আজ থেকে হয়ে গেলাম প্রিয় শিক্ষাঙ্গনে সাবেক শিক্ষার্থী। তাই তো শিক্ষাজীবনের এই শেষ দিনটিকে স্মৃতির পাতায় বন্দী করতে বন্ধুদের সাথে ফ্রেমবন্দী হচ্ছি।
গতকাল অনুষ্ঠানের মূল্য ভেন্যুতে ১৫৩ জন কৃতি শিক্ষার্থী ও গবেষককে স্বর্ণপদক প্রদান করেন প্রেসিডেন্ট। এসময় তাদের চোখে মুখে দৃশ্যমান ছিল উচ্ছ্বাস। কৃতিত্বের বাঁধভাঙা সুখের ঢেউতে ভেসেছেন তারা। সম্ভবত তাদের অনেকেই তখন বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের প্রথম দিনটিকে স্মরণ করেছেন। মনে মনে নিশ্চয় ভেবেছেন, তিনি কি সেদিন ভাবতে পেরেছিল এই দিনটির সাক্ষী হবে? প্রিয় রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের হাত থেকে স্বর্ণপদক গ্রহণ করবে! বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের দীর্ঘ চার বছরের অর্জিত সহপাঠী, বন্ধু-বান্ধব আর প্রিয় শিক্ষকদেরও হয়তো স্মরণ করেছে এক সেকেন্ডে। তাদের পিতামাতা ও শিক্ষকরাও ভাগাভাগি করেছে প্রিয় সন্তান, শিক্ষার্থীর সফলতার আনন্দ। সমাবর্তন ঘিরে যত প্রয়াস, তার মধ্যে সবথেকে সুন্দর দৃশ্য ছিল বোধহয় বৃদ্ধ বাবা-মায়ের গায়ে গাউন আর মাথায় টুপি পরিয়ে গ্রাজুয়েটদের শিক্ষাজীবনের অর্জনের স্বীকৃতি উদযাপন। বিজনেস স্টাডিজের গ্রাজুয়েট আহমেদ সেকাতুরে বলেন, ইউনিভার্সিটি লাইফটা হলো জীবনের একটি ক্ষুদ্র অংশ মাত্র, যা আমাদেরকে অতিক্রম করতে হয়। এবং সমাবর্তনের দিনরা মূলত এই অংশটাকেই স্মরণ করার দিন। এদিন পেছনে তাকালে মনে হয় এটা একটা জার্নি ছিল যা আমাদের হৃদয়ে জায়গা করে নেয়। জীবনের এই বিশেষ দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতেই মূলত এই আয়োজন। গাউন আর টুপি পরে সেলফি তোলার হিড়িক।
অনুষ্ঠানে সমাবর্তন বক্তা হিসেবে উপস্থিত ছিলেন নোবেল বিজয়ী ফরাসি অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. জ্যাঁ তিরোল। এতে তাকে সম্মানসূচক ‘ডক্টর অব ল’স’ ডিগ্রী প্রদান করা হয়। সাইটেশন পাঠ করেন ঢাবি প্রো-ভিসি (শিক্ষা) প্রফেসর ড. এ এস এম মাকসুদ কামাল। এদিন ভিসির শোভাযাত্রার পর দুপুর ১২ টায় সমাবর্তন শুরু হয়। সমাবর্তনে মোট ৩০ হাজার ৩৪৮ জন গ্র্যাজুয়েট ও গবেষক অংশগ্রহণ করেন। তন্মধ্যে ২২ হাজার ২৮৭ জন মুল ভেন্যুতে এবং ৭ হাজার ৭৯৬ জন ঢাকা কলেজ ও ইডেন কলেজ ভেন্যুতে। অনুষ্ঠানে ১৩১ জন কৃতী শিক্ষক, গবেষক ও শিক্ষার্থীকে ১৫৩টি স্বর্ণপদক, ১৭ জনকে পিএইচডি, ২ জনকে ডিবিএ এবং ৩৫ জনকে এমফিল ডিগ্রি প্রদান করা হয়।
অধিভুক্ত সাত কলেজের নিবন্ধনকৃত গ্র্যাজুয়েটরা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বর্ধিত ঢাকা কলেজ ও ইডেন মহিলা কলেজ ভেন্যু থেকে সরাসরি সমাবর্তন অনুষ্ঠানে অংশ নেন। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন অনুষদের ডিন, সিনেট, সিন্ডিকেট, হল প্রভোস্টসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-কর্মকর্তারা এতে উপস্থিত ছিলেন।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন