মঙ্গলবার ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ইসলামী জীবন

সন্ত্রাস মোকাবেলায় মহানবী সা.-এর কার্যক্রম

| প্রকাশের সময় : ১৮ ডিসেম্বর, ২০১৬, ১২:০০ এএম

মুহাম্মদ মনজুর হোসেন খান

॥ শেষ কিস্তি ॥
অতঃপর তাঁরা মদীনায় এসে মহানবী (সা.)-এর সাথে সাক্ষাত করলেন। তিনি তাদেরকে ইয়াহুদীদের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতার কথা জানালেন এবং সকলকে রণপ্রস্তুতি নিয়ে তাদের মুকাবিলা করার জন্য বের হবার নির্দেশ দিলেন। অতঃপর আব্দুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুম রা. কে মদীনার দেখাশোনার দায়িত্ব দিয়ে তিনি সেনা সমভিব্যবহারে বানু নাযীরের বসতিতে পৌঁছেন। সেখানে পৌঁছে তিনি তাদেরকে চর্তুদিকে থেকে অবরোধ করেন। ছয়দিন অবরোধ করার পর তাদের মনোবল ভেঙ্গে দেয়ার জন্য তাদের খেজুর গাছ কেটে ফেলেন এবং বাগান জ্বালিয়ে দেন।” তখন মহানবী (সা.) এর সমর্থনে আয়াত নাযিল হয়। “তোমরা যে খেজুর বৃক্ষগুলো কর্তন করেছ এবং যেগুলো কা-ের উপর স্থির রেখে দিয়েছ, তা তো আল্লাহরই অনুমতিক্রমে; তা  এজন্য যে, আল্লাহ পাপচারীদেরকে লাঞ্ছিত করবেন”।
মূলত সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধে যুদ্ধকৌশল হিসাবে এ ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজন ছিল। অবশেষে বানূ নাযীরের মনে মহান আল্লাহ ভীতির সঞ্চার করে দিলেন। তারা নিজেদেরই প্রস্তাব দিয়ে দেশ ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যাবার পথ বেছে নিল। অন্যত্র গিয়ে যাতে তারা আবার সন্ত্রাস করতে না পারে সেজন্য মহানবী (সা.) তাদেরকে সাথে করে অস্ত্র নিয়ে যেতে দেন নি। শুধুমাত্র নিজেদের উটের পিঠে করে যে পরিমাণ মালপত্র নেয়া যায় সে পরিমাণই নেয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছিল। এ আদেশ এত কঠোর ছিল যে, তিলতিল করে গড়ে তোলা নিজেদের ঘরবাড়ি তাদের নিজেদের হাতেই ভেঙ্গে ফেলতে হল। আর তার যতটুকু পারা যায় ততটুকু সাথে নিয়ে অবশিষ্ট আসবাবপত্র ছেড়ে যেতে হল। তাদের কতক খায়বারে গিয়ে বসতি স্থাপন করে, আর কতক চলে যায় সিরিয়ায়। ফলে মদীনা মুনাওয়ারা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চল অভিশপ্ত ইয়াহুদীদের এ গোত্রটির কুটির ষড়যন্ত্র ও সন্ত্রাসী কর্মকা-ের হাত থেকে রেহাই পায়।
সন্ত্রাসীদের নির্মূল করে দেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে মহানবী (সা.) প্রয়োজন হলেই সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে আভিযান পরিচালনা করতেন। এমনই একটি অভিযান তিনি তৃতীয় হিজরীর আউয়াল মাসে মদীনার নিকটবর্তী যু’আমর নামক স্থানে মুসলিমদের পরাজিত ও নিঃশেষ করার দৃঢ় সংকল্পে একত্রিত বনী ছা’লাবা এবং বনী মুহারিব গোত্রদ্বয়ের এক বিরাট বাহিনীর বিরুদ্ধে পরিচালনা করেছিলেন। কিন্তু সন্ত্রাসীরা মুসলিম সৈন্যবাহিনীর আগমনের সংবাদে ছত্রভঙ্গ হয়ে আশপাশে পাহাড়গুলোতে আত্মগোপন করে। রাসূল (সা.) তাঁর অভিযান অব্যাহত রাখেন এবং সৈন্যবাহিনীসহ সন্ত্রাসীদের অবস্থানস্থল পর্যন্ত গমন করেন এবং কিছু দিন সেখানে অতিবাহিত করে মদীনায় ফিরে আসেন।
এই অভিযানের পর পরই মুহারিব গোত্র সন্ত্রাসের পথ পরিহার করে ইসলামী রাষ্ট্রের পক্ষে চলে এসেছিল। তবে ছা’লাবা গোত্র এর পরও কিছু দিন ধরে ইসলামী রাষ্ট্রের বিরুদ্ধাচরণ অব্যাহত রাখে। এর ফল হিসাবে ৬২৬-৬২৯ খ্রিষ্টাব্দে পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে তাদের বিরুদ্ধে আরো ৫টি অভিযান প্রেরণ করা হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল যাতুর রিকার বিরুদ্ধে মহানবী (সা.)-এর নেতৃত্ব পরিচালিত অভিযান। পঞ্চম হিজরীর মুহাররম মাসে পরিচালিত এই অভিযান যাতুর রিকাহ গোত্রের অবাধ্যতামূলক সন্ত্রাসী কর্মকা-ের বিরুদ্ধে এক বিরাট নিবৃত্তকারী প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। এরপর থেকে মহানবী (সা.)-এর বিরুদ্ধে ছা’লাবার তীব্র বিরোধিতার অবসান ঘটে। এবং সপ্তম হিজরীর শেষ নাগাদ ছা’লাবা গোত্রের মধ্যে ইসলামের দৃঢ় ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল।
এভাবে মহানবী (সা.) তাঁর সমগ্র মাদানী জীবনে দেশী ও বিদেশী সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর হাত থেকে সমসাময়িক মদীনা কেন্দ্রিক ইসলামী রাষ্ট্রের এবং পরবর্তীকালের সমগ্র আর উপদ্বীপকে সন্ত্রাসমুক্ত করে সন্ত্রাস নির্মূলে বিশ্ববাসীল সামনে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রেখে যান। সন্ত্রাস নির্মূলে তাঁর কার্যক্রমের উপর আত্মবিশ্বাস থেকে তিনি ঘোষণা দিয়ে যান যে, এমন একদিন আসবে যেদিন একজন আরোহী একাকী সানআ থেকে হাযরামাউত পর্যন্ত ভ্রমণ করবে এবং সে একমাত্র আল্লাহ ছাড়া কাউকে (কোন সন্ত্রাসীকে) ভয় পাবে না।”
এ প্রবন্ধে সন্ত্রাস প্রতিরোধে কুরআন ও সুন্নাহর নির্দেশনা ও রাসূল (সা.)-এর কার্যক্রম বর্ণনা করার চেষ্টা করা হয়েছে। এছাড়াও সন্ত্রাস প্রতিরোধে ইসলাম মানবীয় মর্যাদা প্রতিষ্ঠা, সামাজিক সাম্য ও অর্থনৈতিক সুবিচার প্রতিষ্ঠা, দুষ্টের দমন ও শিষ্টের লালন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, ধর্মীয় সহনশীলতা বৃদ্ধি, ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি রোধ, আদর্শ সমাজ গঠন, নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছে। আর ইসলামী দ-বিধি প্রতিষ্ঠা সন্ত্রাসসহ যে কোন অপরাধ প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ হতে পারে। যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলো বর্তমান সৌদি আরব। সেখানে ইসলামী দ-বিধি কার্যকর থাকায় অপরাধের হার সারাবিশ্বের চেয়ে অনেক নিচে।
বিশ্ববাসী ইসলামের ব্যাপক আবেদন থাকা সত্ত্বেও হিংসা ও স্বভাবজাত শত্রুতাবশত অন্যান্য ধর্মালম্বীরা বিশেষ করে ইহুদী ও খ্রিষ্টানরা ইসলাম ও মুসলিমদের নামে অন্যান্য নানা কুৎসা রটাচ্ছে। ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতায় ইসলাম ও এর অনুসারীরা ইসলাম বিরোধীর নিকট থেকে যেসব ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে বর্তমান সন্ত্রাসকে ইসলামের সাথে সম্পৃক্ত করার অপচেষ্টাও সেসবের অন্যতম। একদিকে ইহুদী-খ্রিষ্টান-পৌত্তলিকদের ষড়যন্ত্র অপরদিকে জন্মগতভাবে ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞতা ও ভ্রান্তি, এদুয়ে মিলে ইসলাম আজ পৃথিবীতে ভুলবোঝা ধর্মে” (ঞযব গরংঁহফবৎংঃড়ড়ফ জবষরমরড়হ) পরিণত হয়েছে, মেযনটি বলেছেন বিংশ শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইসলামী চিন্তাবিদ মুহাম্মদ কুতুব র.। গঁযধসসধফ  ছঁঃয, ওংষধস-ঞযব গরংঁহফবৎংঃড়ড়ফ জবষরমরড়হ, কঁধিরঃ: ওহঃবৎহধঃরড়হধষ ওংষধসরপ ঋবফধৎধঃরড়হ ড়ভ ঝঃঁফবহঃ ঙৎমধহরুধঃরড়হং, ১৪০১ অ.ঐ./১৯৮১ অউ. তবে আশার কথা, মুসলিমরা এখন ধীরে ধীরে তাদের অজ্ঞতা ও ভ্রান্তির বেড়াজাল ছিন্ন করার চেষ্টা শুরু করেছে। সন্ত্রাসের সাথে যে ইসলামের কোন রকম সম্পর্ক নেই সে কথা উপযুক্ত আলোচনায় কিছুটা হলেও স্পষ্ট হয়েছে। ইসলামের অবস্থান কুরআন, হাদীস ও রাসূল (সা.)-এর জীবনাদর্শে চমৎকারভাবে বিধৃত হয়েছে। কুরআন, হাদীস ও রাসূল (সা.)-এর জীবনাদর্শ দ্বারা এ কথা প্রমাণিত যে ইসলামের সাথে সন্ত্রাসের সম্পর্ক বন্ধুত্বপূর্ণ নয় বরং চরম বিরোধী। শান্তিকে বিঘিœত করে এমন কোন কর্মকা-কে ইসলাম সমর্থন করে না, উপরন্তু বিশ্বে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা করাই ইসলামের চিরন্তন নীতি। ইসলাম স্বভাবগত কারণেই কখনো সন্ত্রাসে বা বিশ্বশান্তি নষ্ট করে এমন কর্মে উৎসাহ, সমর্থন, অনুমোদন দেয় না। মুসলিম কখনো সন্ত্রাসী হতে পারে না। তাছাড়া গুটিকতক তথাকথিত মুসলিমের কর্মবিচার করে বিশ্বের সর্ববৃহৎ ধর্ম ও পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান ইসলামকে সন্ত্রাসের সাথে সম্পকৃক্ত করা কখনোই  উচিত নয়।

 

Thank you for your decesion. Show Result
সর্বমোট মন্তব্য (0)

মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন