মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত। কেবল অঙ্গ প্রত্যেঙ্গ এর কারণে মানুষ শ্রেষ্ঠ নয় বরং শ্রেষ্ঠ মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের বিশেষ করুণার কারণে। তিনি কুলমাখলুকাত সৃষ্টি করেছেন, এর মধ্যে কেবল মানষকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় সৃষ্টি করেছেন। তিনি তাদেরকে বুকের মাঝে দিয়েছেন এমন এক মূল্যবান গোশতের টুকরা যাকে কলব বা হৃদয় বলে। প্রতিটি মানুষেরই হৃদয় আছে, কোনটি হেদায়েতের আলোয় আলোকিত আবার কোনটি গোমরাহির অন্ধকারে কলুষিত। হৃদয় মানুষকে ইতিবাচক (হক) বা নেতিবাচক (বাতিল) পথে পরিচালিত করে। যে হৃদয়ে আলো নেই সে হৃদয় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে সত্য ন্যায় ও কল্যাণের পথে চালাতে পারে না।
মানুষকে মন্দপথে, অন্যায় অবিচারে, মিথ্যা শঠতা, অমানবিকতা, লোলুপতা, স্বার্থপরতা, অবিচার সর্বোপরি হিংস্রতার পথে পরিচালিত করে। আবার যে হৃদয় হেদায়েতের আলোয় আলোকিত সে হৃদয় সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে ইহকালীন যাবতীয় কল্যাণ ও সমৃদ্ধির পথে পরিচালিত করে। মানবকল্যাণে, সমাজকল্যাণে, জাতি ও রাষ্ট্রের কল্যাণে তাকে উদ্বুদ্ধ করে। যার ফলে পার্থিব জীবনেই ঐ ব্যক্তি আলোকিত হয় না বরং পরকালীন জীবনের সুচনায়ও তার জীবনখানি আলোকিত হয়। ইহকালীন ও পরকালীন জীবনে আলোকিত হৃদয়ের মানুষটির জীবনখানি বেশ সুখময় হয়। জীবনের সুখময়তাই পুলকিত জীবন।
আল্লাহর নুর মানুষের হৃদয়কে আলোকিত করে। ইমানের নুর, কোরআনের নুর, তাকওয়ার নুর কেবল কলব বা হৃদয়কে নয় বরং দেহমনকেও আলোকিত ও ঝলকিত করে। সকল নুরের আধার স্বয়ং আল্লাহ রাব্বুল আলামিন। তাঁর জাতেপাকই নুর। এ প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ’আল্লাহ আসমানসমূহ ও যমীনের নূর, তাঁর নূরের উপমা যেন একটি দীপাধার যার মধ্যে আছে এক প্রদীপ, প্রদীপটি একটি কাঁচের আবরণের মধ্যে স্থাপিত, কাঁচের আবরণটি উজ্জ্বল নক্ষত্রের মত, তা জ্বালানো হয় বরকতময় যায়তূন গাছের তৈল দ্বারা যা শুধু পূর্ব দিকের (সূর্যের আলোকপ্রাপ্ত) নয় আবার শুধু পশ্চিম দিকের (সূর্যের আলোকপ্রাপ্তও) নয়, আগুন তাকে স্পর্শ না করলেও যেন তার তৈল উজ্জ্বল আলো দিচ্ছে; নূরের উপর নূর! আল্লাহ্ যাকে ইচ্ছে হেদায়েত করেন তাঁর নূরের দিকে। আল্লাহ্ মানুষের জন্য উপমাসমূহ বর্ণনা করে থাকেন এবং আল্লাহ্ সব কিছু সম্পর্কে সর্বজ্ঞ।’ (সুরা নুর: আয়াত: ৩৫)। পৃথিবীর বুকে যত মানুষ হেদায়েত তথা সুপথ প্রাপ্ত হয়েছে, এসবের পেছনেই মহান জাতেপাকের নুরের প্রভাব। কোন ব্যক্তির অন্ধকারসম কলুষিত হৃদয় যখনই নুর তথা হেদায়েত এর ছোঁয়া পায় তখনই তা আল্লাহর ইচ্ছা ও বিশেষ অনুগ্রহে পরিবর্তন হয়ে যায়। যার ঐ ব্যক্তির হৃদয় নুরের তথা হেদায়েতের আলোয় আলোকিত হয়। সে পরম মহাসত্যের সন্ধান পেয়ে তা গ্রহণ করে নিজে ধন্য হয়। এ প্রসঙ্গে কোরআন মাজিদে বর্ণিত হয়েছে, ‘অবশ্যই আল্লাহর নিকট থেকে এক জ্যোতি ও স্পষ্ট কিতাব তোমাদের কাছে এসেছে যারা আল্লাহর সন্তুষ্টির অনুসরণ করে, এ দ্বারা তিনি তাদেরকে শান্তির পথে পারিচালিত করেন এবং তাদেরকে নিজ অনুমতিক্রমে অন্ধকার হতে বের করে আলোর দিকে নিয়ে যান। আর তাদেরকে সরল পথের দিশা দেন।’ (সুরা মায়েদা: আয়াত: ১৫- ১৬)।
তিনি আরো বলেন, ‘বলে দিন নিঃসন্দেহে হেদায়েত সেটাই, যে হেদায়েত আল্লাহ করেন। আর এসব কিছু এ জন্য যে, তোমরা যা লাভ করেছিলে তা অন্য কেউ কেন প্রাপ্ত হবে; কিংবা তোমাদের পালনকর্তার সামনে তোমাদের উপর তারা কেন প্রবল হয়ে যাবে! বলে দিন, মর্যাদা আল্লাহরই হাতে; তিনি যাকে ইচ্ছা দান করেন এবং আল্লাহ প্রাচুর্যময় ও সর্বজ্ঞ। তিনি যাকে ইচ্ছা নিজের বিশেষ অনুগ্রহ দান করেন। আর আল্লাহ মহা অনুগ্রহশীল।’ (সুরা ইমরান: আয়াত: ৭২-৭৪) তিনি আরো ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ্ তাদের অভিভাবক যারা ঈমান আনে , তিনি তাদেরকে অন্ধকার থেকে বের করে আলোতে নিয়ে যান। আর যারা কুফরী করে তাগূত তাদের অভিভাবক, এরা তাদেরকে আলো থেকে অন্ধকারে নিয়ে যায়। তারাই আগুনের অধিবাসী, সেখানে তারা স্থায়ী হবে।’ (সুরা বাকারা: আয়াত: ২৫৭)।
দুনিয়াতে যারা ইমানী জিন্দেগী লাভ করে আল্লাহর বিধান ও রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের তরীকা অনুযায়ী যথাযথাভাবে জীবন কাটায়, আমলে সালেহ তথা নেক কাজে নিজেদেরকে সর্বদা নিয়োজিত রাখে, জীবনের সকল ক্ষেত্রে তাকওয়ার অনুশীলন করে তাদের জীবন দুনিয়া ও আখেরাতে পুলকিত তথা সুখময়। এসব বিষয়ে পবিত্র কোরআনে আল্লাহ পাকের ইরশাদ, ‘নিশ্চয়ই যারা ঈমান এনেছে এবং ভাল কাজ করেছে, তাদের রব তাদেরকে লক্ষ্য স্থলে (জান্নাতে) পৌঁছে দিবেন তাদের ঈমানের কারণে, শান্তির উদ্যানসমূহে, তাদের (বাসস্থানের) তলদেশ দিয়ে নহরসমূহ বইতে থাকবে।’ (সূরা ইউনুস: আয়াত: ১০)। তিনি আরো বলেন, ‘নিশ্চয়ই যারা ঈমান এনেছে এবং সৎ কার্যাবলী সম্পন্ন করেছে, আর নিজেদের রবের প্রতি ঝুঁকে পড়েছে এরূপ লোকেরাই হচ্ছে জান্নাতবাসী, তাতে তারা অনন্তকাল থাকবে।’ (সুরা হুদ: আয়াত: ২৩)।
তাকওয়া অবলম্বনকারী ব্যক্তিগণ যারা সর্বদা আমলে সালেহ এ নিয়োজিত থাকেন তারা পরকালীন সকল বিপদ আপদে মুক্ত থেকে আলোকিত জীবন লাভ করবেন। আল্লাহপাক বলেন, ‘সেদিন আপনি দেখবেন মুমিন নর-নারীদেরকে তাদের সামনে ও ডানে তাদের নূর ছুটতে থাকবে। বলা হবে, ‘আজ তোমাদের জন্য সুসংবাদ জান্নাতের, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত, সেখানে তোমরা স্থায়ী হবে, এটাই তো মহাসাফল্য।’ (সুরা হাদিদ: আয়াত: ১২)। এ প্রসঙ্গে হাদিস বর্ণিত রয়েছে, আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, তাদেরকে তাদের আমল অনুযায়ী নূর দেয়া হবে। তাদের কারও কারও নূর হবে পাহাড়সম। তাদের মধ্যে সবচেয়ে কম নূরের যে অধিকারী হবে তার নূর থাকবে তার বৃদ্ধাঙ্গুলীতে। যা একবার জ্বলবে আরেকবার নিভবে। (মুসতাদরাকে হাকিম ২/৪৭৮)।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন