গ্রিসের প্রায় ২০ হাজার অনিয়মিত বাংলাদেশি চরম উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছে। আটক কেন্দ্রগুলোতে অবরুদ্ধ প্রায় ৬ হাজার অনিয়মিত বাংলাদেশি প্রবাসী ফেরত পাঠানোর আতঙ্কে ভুগছেন। গ্রিস ও বাংলাদেশের মাঝে চুক্তির প্রায় এক বছর পরেও ১৫ হাজার অবৈধ বাংলাদেশিকে বৈধকরণের উদ্যোগ নেয়া হয়নি এবং প্রতি বছর নতুন ৪ হাজার কর্মী নিয়োগের কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হয়নি। দেশটির এথেন্সস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস এ ব্যাপারে নীরব ভূমিকা পালন করছে। এ চুক্তির পর দেশটি প্রবাসী বাংলাদেশিদের ব্যাপক হারে ধরপাকড় শুরু হয়েছে। গতকাল শনিবার গ্রিসের মিনিদি ক্যাম্প থেকে কারাবন্দি বরিশালের জয়নুল আবেদীন মিন্টু এতথ্য জানিয়েছেন।
কারাবন্দি প্রবাসী জয়নুল আবেদীন মিন্টু ইনকিলাবকে বলেন, দেশটিতে ‘অনিয়মিত’ বাংলাদেশিরা গ্রেফতার আতঙ্কে রয়েছেন। গ্রিস কর্তৃপক্ষ জোর করে দেশে ফেরত পাঠাতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, গত ফেব্রুয়ারিতে উভয় দেশের মাঝে চুক্তি হবার পর দেশটিতে প্রবাসী বাংলাদেশিদের ধরপাকড়ের ঘটনা ব্যাপক হারে বাড়ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের আশ্রয় আবেদন থাকা সত্ত্বেও সাদা পোশাকধারী পুলিশ অভিযান চালিয়ে বাংলাদেশিদের ধরে দেশটির পুলিশ হেডকোয়াটার আলোদাপুনে নিয়ে আশ্রয় আবেদনপত্র সার্ভার থেকে কেনসেল করে কারাগারে পাঠিয়ে দিচ্ছে। এসব ঘটনা বাংলাদেশ দূতাবাসকে অবহিত করার পরেও দূতাবাস নীরব ভূমিকা পালন করছে। রাতে এ ব্যাপারে এথেন্সস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসের শ্রম সচিবের মোবাইল ফোনে যোগযোগ করা হলে তিনি ফোন ধরেননি।
উভয় দেশের উচ্চ পর্যায়ের কূটনৈতিক প্রচেষ্টায় দেশটিতে বসবাসকারী অনিয়মিত কর্মীদের বৈধতা লাভের সুযোগ সৃষ্টিতে জোরালো ভূমিকা নেয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন তিনি। স্বপ্নের দেশ ইউরোপে প্রবেশ করে ভাগ্যের চাকা ঘুরাতে এসব অনিয়মিত বাংলাদেশিরা দালাল চক্রের খপ্পরে পড়ে গ্রিসে গিয়ে আশ্রয় নেয়। মানবপাচারকারী এসব দালাল চক্র প্রবাসী যুবকদের কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। মিনিদি ক্যাম্পে অবরুদ্ধ নোয়াখালীর রাকিব, বগুড়ার আব্দুল খালেক, করিমতোশ ক্যাম্পের মোর্শেদ পালোয়ান ও সিলেটের আব্দুস সালামও ৬ মাস, ১৩ মাস ও কেউ কেউ ১৮ মাস যাবত কারাভোগ করছে। দেশটির সেলেনিকি ডিষ্ট্রিকের একসানতিয়া ক্যাম্পে প্রায় ২ হাজার বাংলাদেশি এবং করিমতোশ ক্যাম্পে ১ হাজার বাংলাদেশি এবং মিনিদি ক্যাম্পে প্রায় ২ হাজার বাংলাদেশি চরম দুর্ভোগ পোহাচ্ছে। এসব কারাবন্দি প্রবাসীরা বাংলাদেশ দূতাবাসের সহায়তা চেয়েও তেমন সহযোগিতা পাচ্ছে না বলে অভিযোগ উঠছে।
সূত্র জানায়, গত ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশ ও হেলেনিক রিপাবলিক গ্রিসের মধ্যে জনশক্তি রফতানি সংক্রান্ত বিষয়ে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। এ সমঝোতা স্মারক সইয়ের ফলে প্রতিবছর চার হাজার বাংলাদেশি কর্মীকে কাজ করার সুযোগ দেবে গ্রিস। এতে বাংলাদেশের পক্ষে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থানমন্ত্রী ইমরান আহমদ এবং গ্রিসের পক্ষে দেশটির মিনিস্টার অফ মাইগ্রেশন অ্যান্ড অ্যাসাইলাম প্যানাইয়োটিস মিতারাচি সই করেন। সমঝোতা স্মারকের বিষয়ে গ্রিসের অভিবাসন ও শরণার্থী বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে।
এতে উল্লেখ করা হয়- বর্তমানে গ্রিসে অবস্থান করছেন এমন ১৫ হাজার বাংলাদেশিকে মৌসুমি কাজের অনুমতি দেয়া হবে। এর বাইরে বছরে ৪০০০ বাংলাদেশি নাগরিককে মৌসুমি কাজের ভিসা দিবে দেশটির সরকার। যা পাঁচ বছর ধরে চলমান থাকবে। আবেদনকারীর অবশ্যই কাজের নিয়োগপত্র থাকতে হবে, যা দিবেন গ্রিসের নিয়োগকর্তা। এই ভিসার অধীনে গ্রিসে বছরে ৯ মাস পর্যন্ত রেসিডেন্স পারমিট বা থাকার অনুমিত মিলবে। ভিসাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা স্থায়ীভাবে বসবাস বা নাগরিকত্বের আবেদন করতে পারবেন না। ইউরোপের মৌসুমি শ্রমিক আইন অনুযায়ী, তারা পরিবারের সদস্যদের আনারও অনুমতি পাবেন না।
সমঝোতা স্মারক সই অনুষ্ঠানে গ্রিসের মন্ত্রী জানান, এই চুক্তিটি গ্রিসের পার্লামেন্টে অনুমোদনের মাধ্যমে শিগগিরই বাস্তবায়ন করা হবে। এরপর প্রক্রিয়া নির্ধারণ হবে। কোন কোন খাতে লোক নেয়া হবে, সেটাও এখনো নির্ধারণ হয়নি। তবে প্রথমেই কৃষি খাতে নেয়ার পর অন্যান্য খাতে কর্মী নেয়া সম্ভবনা রয়েছে। গ্রিসের মন্ত্রী প্যানাইয়োটিস মিতারাচি বলেন, বাংলাদেশি কর্মীরা পরিশ্রমি হলেও মানবপাচারকারীরা তাদের ফাঁদে ফেলে সর্বস্বান্ত করছে। এ চুক্তির ফলে বাংলাদেশি কর্মীদের স্বার্থ সংরক্ষিত হবে বলে উল্লেখ করেন তিনি। সমঝোতা স্মারকের ফলে বাংলাদেশের কর্মীদের জন্য গ্রিসে কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হলো বলে জানায় মন্ত্রণালয়। একইসঙ্গে গ্রিসে অবস্থানরত বাংলাদেশি প্রবাসীরা পর্যায়ক্রমে বৈধভাবে কাজ করার সুযোগ পাবেন। কিন্তু যারা এখনো অ্যাসাইলাম আবেদনের সুযোগই পাননি তারা রয়েছেন আতঙ্কে। তবে চলতি বছরের নভেম্বর মাস শেষ হবার পথে এখনো দ্বিপাক্ষিক চুক্তি অনুযায়ী দেশটিতে কোন কর্মী নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করা সম্ভব হয়নি।
আশ্রয় আবেদন প্রত্যাখ্যান হলে অনিয়মিত অভিবাসীদের নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর বিষয়টি নিশ্চিত করতে আরো কঠোর হচ্ছে ইউরোপ। ২০১৬ সালের পর অনিয়মিত বাংলাদেশি অভিবাসীদের ফেরত পাঠাতে শুরু করেছে ইউরোপের দেশ গ্রিস। গত ডিসেম্বরে প্রথমে একটি চার্টার ফ্লাইটে করে ১৯ জনকে ফেরত পাঠানোর ঘটনায় আতঙ্ক বিরাজ করছে বাংলাদেশি অভিবাসীদের মাঝে। গ্রিসে বসবাস করেন প্রায় ৩০ হাজার বাংলাদেশি। গ্রিক সরকারের পরিসংখ্যান অনুযায়ী বৈধ অনুমতি নিয়ে দেশটিতে বসবাস করা বাংলাদেশিদের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ১২ হাজার। এর বাইরে অনেকে রয়েছেন যাদের বসবাসের অনুমতি নেই বা আশ্রয় আবেদন বাতিল হয়েছে। অবৈধ উপায়ে গ্রিসে প্রবেশ বন্ধে কড়াকড়ির পাশাপাশি সম্প্রতি এমন অভিবাসীদের বিরুদ্ধেও তৎপর হয়েছে কর্তৃপক্ষ।
ইতিপূর্বে মিতারাচি দেশটির গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সুরক্ষার আওতায় যারা নেই তাদেরকে ফেরত পাঠাচ্ছে গ্রিস।’ নতুন সমঝোতা স্মারকে ফেরত পাঠানোর এই প্রক্রিয়া আরো জোরদারের কথা বলা হয়েছে। গ্রিসের অভিবাসী ও শরণার্থী মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘অবৈধ অভিবাসনের বিরুদ্ধে লড়াই ও অবৈধভাবে যারা বসবাস করছে, তাদের জোরপূর্বক ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে দুই দেশ একসঙ্গে কাজ করবে। পাচারচক্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের ক্ষেত্রে গ্রিসের অবস্থান পরিষ্কার।’
ইউরোপের দেশগুলো থেকে এমন অভিবাসীদের ফেরত পাঠানোর ক্ষেত্রে ২০১৭ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের স্ট্যান্ডার্ড অপারেশন প্রসিডিউর্স (এসওপি) চুক্তি হয়। এর আওতায় ডিসেম্বরে ১৯ বাংলাদেশিকে ফেরত পাঠানো হয়েছিল। গ্রিক মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে এই প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, ‘এখন আমাদের দেশের অনুরোধে বাংলাদেশে সরাসরি প্রত্যাবর্তনের প্রক্রিয়া আরও দ্রুততর হবে।’ গ্রিস থেকে বাংলাদেশি প্রবাসী অধিকার পরিষদ গ্রিস শাখার কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব আরিফুর রহমান আরিফ গতকাল শনিবার ইনকিলাবকে জানান, দেশটি প্রায় ২০ থেকে ২২ হাজার বাংলাদেশি অবৈধ রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৬ হাজার কারাবন্দি রয়েছে। কারাবন্দিদের মুক্ত করে বৈধতা লাভের কোনো উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। অনেকেই ১৮ মাস, কেউ ১৩ মাস কেউ ৬ মাস ধরে বন্দি জীবনযাপন করছে। তিনি গ্রিসে অবস্থানরত অবৈধ প্রবাসীদের আগে বৈধ করে পরে যেন নতুন করে কর্মী নেয়ার ব্যবস্থা করা জোর দাবি জানান।
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
মন্তব্য করুন